০২ অক্টোবর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৮

কান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক।  তার নিত্যদিনের  আসা  যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "। 





                                                         টানাপোড়েন (১৮)

                                                     সোনালী রোদ্দুরে মেঘ


আজকে স্কুলে গিয়ে রেখার খুব ভালো লেগেছে। দীর্ঘ দিনের ক্লান্তি যেন কিছুটা রিম্পাদির সঙ্গে কথা বলে হালকা হতে পেরেছে। কত কথা জমেছিল দুজনার। আজ যেন মনে হল সোনালী রোদ্দুর উঁকি দিয়েছে।সোমদত্তার পার্থর কথাটা বলাতে রিম্পাদি বলল  ' দেখ ,এখন ওরা প্রাপ্তবয়স্ক ।বড় জোর বোঝানো যেতে পারে ।তার বাইরে তো আর তোর কিছু করার নেই। দেখ কি হয়?'
রেখা বলল  'সমুর ক্রাইসিস যে কী ?সেটাই তো বলছে না। ও মেটাতে চাইলে তবে তো মিটবে বলো। আমার তো বিরক্তি লাগছে আমার নিজের বোন বলে নয় চিরকালটাই শুধু ব্যক্তি স্বার্থ দেখে গেল। একবার কাকিমা কাকুর কথাটা তো ভাবা উচিত ছিল? ।আমাদের পরিবারের তো একটা রেপুটেশন আছে রিম্পা দি। তাছাড়া পাবলোর কথাটা ভাবল না ,ভাবো ..?
রিম্পা দি বলল   'জানিস তো আজকাল না এটা যেন একটা ক্রেজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে যে কার কখন ক্রাশ হয় কে জানে? আর তোকে বলেছিলাম না,  আরে ওই সৌরভের কথা ।সে তো দিব্যি মজেছে সেই তৃপ্তি না কার সঙ্গে?'
রেখা বলল  'তুমি কি না শিখার জন্য ওই পাত্র খুঁজছিলে?'
রিম্পাদি বলল  'আমি কি ছাই জানতাম? জেনে বুঝে কখনো এরকম একটা সম্বন্ধে দিতাম বল?'
রেখা বলল  'তা ঠিক?'
রিম্পাদি বলল  'হ্যাঁরে আজকাল কি পরকীয়াটাই বেশি প্রাধান্য পেল?'
রেখা একটু ভেবে বলল  'মন্দ কি? চেষ্টা করে দেখলে হয় ,কি বলো রিম্পা দি?'
রিম্পাদি হেসে বলল  'রেখা তোর দ্বারা এই কাজ হবে না। তোর দৌড় কতদূর আমি জানি?'
রেখা বলল  'কেন?তুমি জানো ,এখনো কতজন আমার হার্ট থ্রব?
রিম্পাদি বলল  'সেই জন্যই তো বলছি, যদি তাই হতো তাহলে কবে তুই...?
নে ছাড় তো অফ পিরিওডটা ছিল ভাগ্যিস। তাই এত কথা শেয়ার করতে পারলাম।'
রিম্পাদি বোকে যেতে লাগলো।জানিস তো এই কটা দিন আমার পেট ফুলে গেছিল ,তোর সাথে কথা না বলতে পেরে।'
রেখা রিম্পাদিকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলে ' তুমি পারোও বটে।'
রিম্পাদি বলল  ,'সত্যি বলছি রেখা।'
রেখা বলল  :সেটা আমি জানি। এবার ওঠ  ট্রেন ধরতে হবে তো ,নাকি?
রিম্পাদি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল 'আরে সাড়ে চারটে বেজে গেল,? এই রেখা চল চল টো টো    ধরতে হবে।'
বাড়ি ফিরে এসে রেখা এই কথাগুলোই ভাবছে। আজ মনোজ অফিসে যায় নি ।তাই সন্ধ্যে থেকেই বাড়িতে ছিল। বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মনোজ একেবারে ব্ল্যাক কফি এনে হাতে তুলে দিল। সত্যি মনোজ আমার মনের কথাটা ভাল করে পড়ে ফেলেছে।
ট্রেনের ক্লান্তির রেস ,উস্কোখুস্কো চুল গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই মনোজ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। মনোজ এভাবে তাকালে ভীষণ  লজ্জা লাগে। গেট থেকেই ব্যাগগুলো আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। সত্যি রেখা কোনদিন গেট থেকে  মনোজের ব্যাগপত্র নিয়ে ঢোকে নি।
ঘরে ঢুকেই মনোজ রেখাকে জড়িয়ে ধরে বলল  'আমি 'তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।'
রেখা অবাক হয়ে বলল  'সে তো আমি জানি। কিন্তু এখন তুমি আমাকে ছাড়ো ।আমি ট্রেনে  করে এসেছি, নানা লোকজনের ঘাটাঘাটি ,করোণা পরিস্থিতিতে এগুলো মাথায় রাখো?'
মনোজ তবু রেখাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে রইলো।
রেখা মনোজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কারণ রেখা জানে মনোজকে যদি একটু মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়া হয় ।তাহলেই ওর শান্তি।
মনোজ বলল  'ঠিক আছে যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও বাকিটা রাত্রে?'
রেখা ওয়াস রুমে চলে যায়।
ওদিকে মনোজ বলল  ,'রেখা পুটুর বাড়িতে একটা অশান্তি হয়েছে। ও আসতে পারবে না। কালকে একটি নতুন মেয়ে আসবে ,সুমিতা।'
রেখা দরজাটা ফাঁক করে গলাটা বাড়িয়ে বলল ' কি হয়েছে গো? আর এই সুমিতাটাই বা কে?'
মনোজ বলল 'পুটুর জানাশোনা।'
রেখা বলল  'যাক  বাবা। দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।'
বাথরুমে ফ্রেশ হতে হতে ভাবছিল পুটু যখন পাঠিয়ে ছে, তাহলে ভালই হবে। এই ব্যাপারে পুটুর প্রতি অগাধ আস্থা।'
রেখা বাথরুম থেকে টাওয়াল মাথায় জড়িয়ে যখন বেরোলো মনোজ তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সদ্য স্নান করে ওঠা কমনীয় স্নিগ্ধ ভাব মনোজের বরাবরই ভালো লাগে। 
তবুও মনোজ বলে  'ওঠে রোজ রোজ চুলটা কেন ভেজাও ?তুমি তো জানো তোমার ঠান্ডার ধাত আছে।'
রেখার এটা বরাবরের স্বভাব ।তাই বলে ওঠে ' কি করবো বলো, আমি যে, পারি না।'
নিরিবিলি ঘরটায় ধূপের গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে
আর রেখাকে ও কি স্নিগ্ধ, কি মিষ্টি লাগছিলো ।মানোজ তো চোখ ফেরাতে পারছিলো না।
মনোজ যেদিন অফিস ছুটি নেয় বা অফিস ছুটি থাকে সেদিন ঠিকই এমনি করেই রেখাকে বেঁধে রাখতে চায়। হঠাৎই মনোজ বলল  'রেখা সমু ফোন করেছিল?'
রেখা অবাক হয়ে বলল   'তোমাকে? কেন?'
মনোজ বলল  'সেই একই কথা। মাথাটা বোধহয় গেছে। তোমার বোন হয়ে এরকম শিক্ষা কি করে পেলো?'
রেখা বলল  'এটা তো আমিও ভাবি। কাকু কাকিমাকে যে কি বলব ?আমার না কিছু মাথায় ঢুকছে না
হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে। মনোজ ই ফোনটা রিসিভ করে বলে '' হ্যালো'।
অন্যদিক থেকে আওয়াজ আসে 'আমি রিম্পা দি বলছি।'
কিন্তু কণ্ঠটায় যেন একটু বেদনা জড়িত।
 মনোজ বলল  'ঠিক আছে ।ধরুন দিদি। আমি রেখাকে দিচ্ছি।'
রেখা ফোনটা নিয়ে বলল  'হ্যাঁ। বলো রিম্পাদি। ঠিকঠাক পৌঁছেছো?'
রিম্পাদি কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল 'হ্যাঁ একটু আগে পৌঁছেছি।'
রেখা ভাবল রিম্পাদি এভাবে কখনো কথা বলে না কিছু একটা হয়েছে।
রিম্পাদি বলল ' তোকে কেউ ফোন করেছিল?'
রেখা বলল ' কি ব্যাপারে? কোথা থেকে ?বল তো?
রিম্পাদি বলল  'স্কুল থেকে। 'রেখা বলল  'না ফোন তো কেউ করেনি? হোয়াটসঅ্যাপটা চেক করি নি।'
রিম্পাদি ফোনেতে কাঁদছে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । রেখা উদগ্রীব হয়ে বলল  'কি হয়েছে বলো না ?আমার তো এবার হার্টফেল হবার অবস্থা ।কী হয়েছে বলো, প্লিজ।'
গৌরীদি বলেই আবার কাঁদতে শুরু করল।
রেখা বলল-'হ্যাঁ গৌরীদির কি হয়েছে?'
রিম্পাদি বলল  'আমি একজন অভিভাবিকাকে হারালাম।'
রেখা বলল-'কি বলছ রিম্পা দি? হারালাম মানে?'
রিম্পাদি বলল  'গৌরীদি আর আমাদের মধ্যে নেই রে।
রিটায়ার করার পর থেকেই একটা অবসাদে ভুগছিলেন ,বাড়িতে ভাই ভাইয়ের বউদের অসহযোগিতা ,নানা কারণ।'
রেখা বলল অথচ দেখো গৌরীদিকে কিন্তু দেখে কখনো বোঝা যেত না ।সব সময় একটা হাসি মুখ ছিল।'
রিম্পাদি বলল ' কিন্তু আমি আমার পরামর্শদাত্রী 'আমার শ্রদ্ধেয় দিদি ,তাকে আর কখনোই কোনো কথা বলতে পারব না ।দেখতে পারবো না ।এটা আমি ভাবতে পারছি না ।রেখা জানিস আমার জীবনেও কত ক্রাইসিস  এসেছিল ।সবকিছু আমি গৌরীদির  সঙ্গে শেয়ার করেছি ।গৌরীদি আমাকে রাস্তা দেখিয়েছে।'
রেখা বলল  'তুমি শান্ত হও রিম্পাদি, ভেঙে পড়ো না কি করবে বলো ?আসা যাওয়া এটাই তো আমাদের জীবন। সবকিছুই তো মেনে নিতে হবে বলো। তুমি ভেঙ্গে পড়লে আমি কোথায় দাঁড়াবো বল তো। রিম্পা দি তুমি আমাকে কত স্নেহ করো ।তুমিও আমার অভিভাবিকা স্বরূপ ।আমি চাইনা আমার এরকম একটি সুন্দর দিদিরৎমন ভেঙে যাক'।
রিম্পাদি বলল  'ঠিক আছে। রাখছি।'
ফোনটা ছাড়তেই মনোজ বলল ' গৌরীদির ?'
রেখা বলল গৌরীদি আর আমাদের মধ্যে নেই। কিছুদিন আগেই দীপ্তিদি এরপর গৌরীদি ভাবতেই পারছি না।'
রেখা ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ভাবতে লাগলো এই গৌরী দি যে পরিবারের জন্য তার ভালবাসাটাকে স্যাক্রিফাইস করেছিল আর সেই পরিবার আজ গৌরী দিকে অসহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটু শান্তি পেলো না জীবনে কিন্তু কখনো গৌরীদিকে দেখে বোঝা যেত না। এর মধ্যেই একটা রিক্সা পো পো শব্দ করতে করতে বেরিয়ে গেল। রাস্তার কুকুরগুলো কাঁদছে। রাত্রি নামলে অন্ধকার যেমন পৃথিবীকে গ্রাস করতে থাকে ঠিক তেমনি করে মনে হল যেন জীবন টাকে কেউ গ্রাস করে নিচ্ছে। কার স্থায়িত্ব কতটুকু কে জানে? কতদিনই বা এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ পান করবে? মৃত্যু এমন জিনিস যার হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হল সোনালী রোদ্দুরে কখন মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে গেছে। একটা চাপা দুঃখ কষ্ট থেকে রেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৮ ক্রমশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much