অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয় মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন
টানাপোড়েন (পর্ব ১২)
কষ্ট
সারারাত রেখা দু'চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন এসেছে। ঠিক তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো,। সেই আওয়াজে ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে বালিশের কাছ থেকে তুলে নিয়ে দেখল। গ্রুপে মেসেজ ঢুকেছে। চোখটা রোগরে নিয়ে দেখল। আরে সাংঘাতিক ব্যাপার।
একদিক আনন্দের দিন -এই কারণেই 26 শে সেপ্টেম্বর 'বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক এবং নারী শিক্ষার মূল কান্ডারী ,বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ঋত্বিক পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় 'এর জন্মদিন । তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য বিদ্যালয় এর তরফ থেকে ক্ষুদ্র আয়োজনের দায়িত্ব রেখার উপর পড়েছে। অন্যদিকে আরেকটি মেসেজ ঢুকেছে রিম্পদির ট্রান্সফারের রেকমেন্ডেশন এর।কালচারাল ফাংশন এর দায়িত্ব রেখার উপর বরাবরের জন্য পড়ে ,সঙ্গে রিম্পাদি ,পায়েল ,অনুরাধা সকলে সহযোগিতা করে। রিম্পাদির সঙ্গে রেখার জীবনটা এতটাই জড়িয়ে আছে যে ,রেখা এই মেসেজটা মন থেকে মানতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ।তবুও ভাবছে রিম্পাদি এতদূর যাতায়াত করে ট্রান্সফার এর প্রয়োজন আছে ।কিন্তু রিম্পাদিকে যে এত সব কথা শেয়ার করে ,কখনো কখনো রেখার জীবনের পরামর্শদাত্রী হয়ে উঠেছে। সেখানে রেখা ভাবতেই পারছে না রিম্পাদি আর রেখার পাশের চেয়ারে বসবে না আর কখনও আদর করে গিয়ে বলবে না 'আয় তোর মাথাটা টিপে দি ,চা খা ফ্রেশ লাগবে,কখনো বলবে না তোর মনটা কি খারাপ ?আমাকে বল দেখ জলের মতো সব সহজ করে দেবো। জীবনের ঘটে যাওয়া দিনটির কথা গত রাতে যেভাবে মনে অনুরণন তুলেছিল।আজকে স্মরণ করতে পারছে না ।আজ তার হৃদয়ে বিদ্যালয়ে কিভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বটা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করবে ,সেই দিকটার প্রতি তার ধ্যান ।অন্যদিকে রিম্পাদির চলে যাবার মেসেজ তার জীবনে এনেছে এক দুঃসহনীয় কষ্ট ।রেখা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না ,তার কি করা উচিত ?রেখা আজকের সকালে কোন কাজে মন দিতে পারল না । রিম্পাদিকে ফোনে মেসেজ করতে পারলো না। রেখা সকাল থেকে কোনো রকমে যেটুকু কাজ না করলে নয় ,সেটুকু করে নিয়ে তাড়াতাড়ি স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেল । ওদিকে কাজের মেয়েটির খবর নেওয়া সম্ভব হয় নি। স্কুলে গিয়ে রিম্পাদি দেখছে গেটের কাছে একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সেই হাসির ভেতরে ছিল মলিনতা ,ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট । আসলে এতদিন ধরে তো একটা আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিল । রেখা রিম্পাদিকে দেখার পর গেটেই জড়িয়ে ধরল ,ছাত্রীরা কোথায় ? সেদিকে কোথাও তার নজর নেই আর ঝর ঝর করে চোখ থেকে জল পড়তে লাগল ।রিম্পাদিও কেঁদে ফেলল।
রিম্পাদি বললো 'দেখ ,যেতে তো আমাকে হতোই ।মেয়েটাকে একটু সময় দিতে পারি না ।তোর দাদাও অফিসে চলে যায় ।আমি সারাটা সময় এখানে পড়ে থাকি ।মেয়েটাএখন উঁচু ক্লাসে উঠছে বুঝতেই পারছিস ।কিন্তু এত দ্রুত যে ট্রানস্ফারটা হবে এটা আমিও কল্পনা করতে পারি নি । দীর্ঘদিনের এই বিদ্যালয়ে কাজ করা (তাকে), অন্যান্য কলিগ এবং এবং স্নেহের ছাত্রীরা, সঙ্গে তোকে ছেড়ে যাবার কষ্ট ,যন্ত্রণা প্রতিক্ষণে অনুভব করছি ।এই বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কালচারাল অনুষ্ঠান ,ক্লাস,বিভিন্ন ধরনের কম্পিটিটিভ পরীক্ষার ডিউটি দেয়া , টিফিন আওয়ার্স, অফ টাইম,তার ফাঁকে দুজনার গল্পগুজব ,কখনো এই ফাঁকেই আধ ঘন্টা সময়ের জন্য ব্রেক, বেরিয়ে পড়া,মারকেটিং ,কত মজা, আড্ডা ,সাংসারিক নানা দুঃখকষ্ট শেয়ার ।নতুন স্কুলে গিয়ে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হবে ।কিন্তু রেখা তোকে আমি বলি মনের টানটা কোনদিনও শেষ হবে না ।মনের মন্দিরে এই টান সব সময চিরভাস্বর হয়ে থাকবে ।আর পারিবারিক বন্ধন তো আমাদের তৈরি হয়েই গেছে । মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে চলে আসবি ।আমিও তোর বাড়িতে আসব ।শত ব্যস্ততায় অন্তত একদিন যেন আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা ,অন্তত মেসেজ করে জানা-এই ব্যাপারগুলো যেন আমরা রাখতে পারি ।এটা ধরে রাখিস। নে, চোখের জল মোছ।চল আজকে আমাদের নারী শিক্ষার অগ্রগতির ঋত্বিক ,আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অনুষ্ঠান খুব সুন্দরভাবে পালন করি ।
রেখা বলল,'আমি আজকে কিভাবে সঞ্চালনা করব রিম্পাদি ।আমার কন্ঠ বাকরুদ্ধ, চক্ষু অশ্রুসিক্ত ,হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত ,বলো আমি কি করবো?
আমি বড়দিকে বলবো আজকের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে পারবো না।'
রিম্পা দি বলল 'রেখা কখনো এরকম কাজ করতে পারে না। যে মহান আদর্শ পুরুষের জন্য আজকে আমরা এই শিক্ষার আলোতে আসতে পেরেছি এবং আমাদের কর্ম জীবনে আমরা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি ,সবই ওনার জন্য ।তাই আমার মত একজন ক্ষুদ্র নারীর জন্য আজকের দিনটাকে অবহেলা করতে পারিস না ।রেখা চল তোকে নতুন উদ্যমে আজকের অনুষ্ঠান খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হবে। আমি তোর পাশে আছি। রেখাকে রিম্পাদি নিয়ে স্টাফরুমে আসলে ,বড়দি বললেন 'মেইল চেক করতে গিয়ে এই কথাই ভাবছিলেন।কী আর করবে।আসা যাওয়া এটাই তো নিয়ম। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন স্টেডি হ ও ।'
এরপর রেখাও অনুষ্ঠানের কাজ করতে গিয়ে দেখে অর্ধেক কাজ গুছিয়ে রেখেছে রিম্পিদি।বিদ্যাসাগর মহাশয় এর প্রতিকৃতি ভালো করে সাজান ,বাকি কাজগুলো রিম্পাদি আগেই করে রেখেছে ।আর যে দায়িত্বটুকু ছিল সেটুকু রেখা বুঝে নিয়ে তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শুরু করে দিলো ।বড়দিকে প্রথমে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান এর মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা এবং আগুনের পরশমণি গান দিয়ে উদ্বোধনী সংগীতে এই মহতী দিনের তাৎপর্যকে সামনে রেখে পরবর্তী অনুষ্ঠানটি ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল ।এরপর প্রতিটি শ্রেণীর থেকে এবং শিক্ষিকাদের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য ,মাল্যদানের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হলো ,তারপর বক্তৃতা ,গান এবং বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটা ক্ষুদ্র কুইজের অনুষ্ঠান করা হয়েছিল ।বিদ্যাসাগরের জীবনকে কেন্দ্র করে নানা প্রশ্নোত্তর ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছিল এবং পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ।সমগ্র অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে যাবার পর রেখা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে ।
বড়দি আসলেন ও স্নেহের সুরে বললেন
'রেখা কাঁদছো কেন ? রিম্পার খুব দরকার ছিল ।এটা তোমাকে বুঝতে হবে ।'
রিম্পাদি বলল 'আমিও তো সে কথাই বলছি দিদি। দূরে সরে গেলেই কি আমরা মন থেকে মুছে যেতে পারি ?তা তো নয় ।আমরা তো পারিবারিক এক মিষ্টি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছি ।আমরা নিশ্চয়ই পরস্পর পরস্পরের প্রতি সে দায়িত্ব পালন করব ।
রেখা বলছে 'বড়দি আমার মন মেজাজ ভালো নেই ।আমি কিছু ভাবতে পারছি না ।'
বড়দি বললেন 'দেখো ,তোমাকেও একদিন হয়তো ট্রানস্ফার নিতে হবে?
এতদিন তুমি ভাবো নি ।এবার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবো ।কারণ দেখো তোমার প্রথম ইস্যুটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে ,এতদূর যাতায়াত এটা তো একটা তোমার জীবনে বড় বাঁধা তাই না ?তুমিও এবার ভাবো।'
সত্যিই রেখা এতদিন ভেবে দেখে নি । মনোজ অনেকবার রেখাকে এটা বোঝাতে চেয়েছে। এমন কি টিপ্পনী পর্যন্ত কেটেছে , 'তুমি কার মোহে এতদূর যাতায়াত করো? '
আসলে রিম্পাদি সঙ্গে এতটা মনের মিল খুঁজে পেয়েছিল। কখনো ভাবতে পারে নি ।রিম্পাদি যখন চলে যাচ্ছে ,এবার হয়তো রেখাও করবে এপ্লাই। যদি পাওয়া যায় কাছেপিঠে। কিন্তু সেই নতুন জায়গায় ,নতুন পরিবেশে নতুন করে সকলকে মানিয়ে নেয়া কি সম্ভব? রিম্পাদি শুধু স্কুলের কলিগ নয় ,একজন পরামর্শদাত্রী, দিদি, বন্ধু । অনুষ্ঠান শেষ করে রেখা স্টাফ রুমে মাথা নিচু করে বসে থাকল। শুধু মনে হচ্ছে সে সম্পূর্ণ একা ।উত্তাল সমুদ্রে কম্পাস বিহীন যেন একটা দিকভ্রান্ত জাহাজ, সামনে যেন ডুবো পাহাড়।
রিম্পাদি হিম গলায় এসে বলল 'তুই কি পাগল হয়ে গেলি? আমি কি বিদেশ চলে যাচ্ছি?'
রেখা জলভরা চোখে আর ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল 'তা হয়তো নয় কিন্তু আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছ ।ইচ্ছে করলেও আর প্রতিদিনকার মতো আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারবো না ।তোমার বুকে মাথা রেখে হিম শীতল ছায়ায় শ্বাস নিতে পারব না। স্নেহের হাত দুটিকে মাথায় রেখে আমাকে কে আশ্বাস যোগাবে বলো?-বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো আর রিম্পাদিকে কাছে টেনে বললো ' তুমি আমার বুকের কাছে কান পেতে শোনো ,দেখো কি রকম কষ্টের ধুকপুকুনি।'
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১২ ক্রমশ
দারুন ও অনবদ্য
উত্তরমুছুন