২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী'র উপন্যাস "টানাপোড়েন"৭

অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয়  মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন  



                                                                      টানাপোড়েন (পর্ব-)
                                                                             
                                                                                            যন্ত্রণা


বৌদি কালকে আমি কাজে আসব না -বলেই তৃপ্তির কথা বলার অপেক্ষা না করেই ঝাটাতে শুরু করে । তৃপ্তি বলল  'হ্যাঁরে রাধা, এই তো চারদিন কাজে আসলি না? এর মধ্যে আবার কালকে আসবি না?
রাধা ঝাড় দিতে দিতে বলে"কি করবো বৌদি বলো ,ডাক্তারের কাছে যাব যে।'ডাক্তারের কাছে যাবি !কেন কি হয়েছে তোর? তৃপ্তিএকটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলে।
এবার রাধা একটু আহ্লাদের স্বরে বলে  ' ও বৌদি, আমার পেটে যে একজন আসছে গো সেই জন্যই তো?'
তৃপ্তি অবাক হয়ে যায় আর বলে 'হ্যাঁরে রাধা, তোদের ভাষাতেই বলি কবার বিউইতে হয়? ঘরে তো তিনটে বাচ্চা রয়েছে তারপরেও তোর হচ্ছে না? সত্যি সুন্দর শরীরের বাঁধুনি রাধার। কচি পানপাতার মতো ঢলঢলে মুখ আর গায়ের রং চাপা বলে এই রংটা যেন বেশি খোলতাই হয়।
রাধা বলে ' কি করবো বলো ।নইলে তো পুরুষ মানুষ অন্য মাগীতে...?  তুমি কি বুঝবে তোমার তো আর বাচ্চা হয়নি আর তোমার স্বামীর মত তো সবার স্বামী নয়।
রাধার মুখে এই কথা শুনে তৃপ্তি যেন আকাশ থেকে পড়ে ।রাধা কি শোনাচ্ছে ওকে।
আর কোন কথা বলে না ।রাধা ওর মাতৃত্বে ঘা দিয়ে কথা বলেছে ।ঠিকই তো সন্তানের জন্ম দিতে পারে নি। কিন্তু সে দুঃখের কথা কাকে বলবে? আদতে কার দোষ ছিল জন্ম দেবার ব্যাপারে? তার তো কোন দোষই ছিল না ।সমস্ত দোষ ওর স্বামীর? কিন্তু সমাজ-সংসারে তৃপ্তিকেই কথা শুনে মরতে হয়। আবার বাইরে প্রকাশ্ও করতে পারে না। রাধা কাজ করে চলে যাবার পর থেকে তৃপ্তির মনের ভেতরে তোলপাড় হতে থাকে ।তাকে কত দিন এভাবে মাতৃত্বে অপারগ কথা শুনতে হবে।
এই তো এক বছর আগের কথা যখন শেখর তৃপ্তিকে বলেছিল একটা সন্তান উপহার দেবার ক্ষমতা তোমার নেই ।তখন ও গোপনে নিজের সমস্ত কিছু টেস্ট করেছিল ,তাতে দেখা গেছে তৃপ্তির কোন দোষ নেই ।তাতে সাহস ভোরে সে একদিন বলেছিল  'ঠিক আছে চলো আমরা দুজনে ডাক্তারের কাছে টেস্ট করাব ।'
এতে শেখর রেগে গেছিল এবং বলেছিল -'তাকে প্রমাণ দিতে হবে নাকি?সে কোনো প্রমাণ দিতে পারবে না।  সে জানে তার কোন দোষ নেই।'তৃপ্তি শুধু হেসেছিল আর মনে মনে ভেবেছিল হ্যাঁ ,সেই আদিকাল থেকে তো মেয়েদেরই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছে ।সীতা পর্যন্ত বাদ যায় নি তাঁকেও অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
তখন তৃপ্তি বলেছিল" শুধু তুমি কেন প্রমাণ দেবে সে ও প্রমাণ দেবে?"
ডক্টর ঘোষকে আমি অ্যাপয়নমেন্ট নিয়ে রেখেছি তোমাকে যেতেই হবে।
শেষ পর্যন্ত যদিও শেখর গিয়েছিল কিন্তু টেস্টের রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জানায় নি। একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে গেছে। কিন্তু তৃপ্তি জানে নিশ্চয়ই কিছু ফল্ট আছে। তারপর থেকে শেখর আর তৃপ্তির সঙ্গে কোন কথা বাড়ায়নি। 
চলে যাচ্ছিল দিন। সপ্তাহ ,মাস ,বছর। হঠাৎ রাধার কথায় এতদিনকার যন্ত্রণার পাহাড় থেকে যেন লাভা উদ্গীরণ হল। সে তো ভেবেছিল তার একটা সুন্দর সংসার হবে তাতে ছোট্ট কচিকাঁচারা আসবে তাদের হাসি খুশিতে তাদের জীবনটা ভরিয়ে তুলবে। সে আশা বোধহয় আর তার জীবনে পরিপূর্ণতা পাবে না। হঠাৎ ফোন আসে তৃপ্তির সম্বিৎ ফিরে'ফোনটা গিয়ে ধরে। হ্যালো, 
কি রে তৃপ্তি বলছিস?
এপার থেকে উত্তর দেয়-'হ্যাঁ বলছি? আপনি কে বলছেন?'
'আরে চিনতে পারছিস না?
আমি সৌরভ।
তৃপ্তি একটু মনে করার চেষ্টা করে ,তারপরে বলে  'কোন সৌরভ? আরে কলেজ লাইফে তুই আমার হার্টথ্রব ছিলি।
তৃপ্তি (অবাক হয়ে)আরে ,'সৌরভ কবে ফিরলি দেশে? আর আমার ফোন নম্বর কোথায় পেলি? কেমন আছিস?'
সৌরভ বলে  'আমাকে কিছু বলতে দে ,না নিজেই সব বলবি? লিলির কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়েছি। লিলির সাথে আমার যোগাযোগ আছে। আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করবি?'বহুদিন পর যেন সে কারোর জন্য বেরোবে, এই বেরোনোতে আছে একটু ভাল লাগা অনাবিল আনন্দের বার্তা।
তৃপ্তি বলে 'আজ? (ভেবে বলল)হ্যাঁ পারব ।কোথায় বল?
সৌরভ বলে 'সেই পুরনো জায়গায়।'
তৃপ্তি ভিতরে ভিতরে একটা কেমন উত্তেজনা অনুভব করছিল । এতদিন পর এরকম উত্তেজনা আবার সে অনুভব করলো।সে যথাসময়ে বেরিয়ে গেল ।
বহু কাল বাদে বৃষ্টিতে ধোয়া ময়দান পেরিয়ে যখন তার গন্তব্যস্থলে দিকে যাচ্ছে ।তখন তার মনে হচ্ছিল কলকাতায় তো আগের সেই বনভূমি নেই ,নেই সে স্বচ্ছ জলের নদীর ধারা। তবুও মানুষ ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারে ।ভেতরে নদীর সহস্রধারা তুলতে পারে ,সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। কিন্তু আজ কেন সৌরভের প্রতি সে এতটা আকর্ষণ অনুভব করছে। অথচ বছর পাঁচেক আগে যদি এই আকর্ষণ অনুভব করতো ,তাহলে হয়তো তার জীবনটা অন্যরকম হতো। হঠাৎ তার গন্তব্য স্থানে এসে পৌঁছাতে সৌরভ ডাকলো ' তৃপ্তি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে তৃপ্তি বলল  'আমাকে কি করে চিনলে?' সৌরভ 'চিনব না ।তোর গায়ের গন্ধটা আজও আমার মনে লেগে রয়েছে।
নে গাড়িতে ওঠ। হাত ধরে তৃপ্তিকে গাড়িতে তোলে।'
তৃপ্তি বলে-কোথায় যাব?
সৌরভ বলে  'আজ তোকে নিয়ে পালিয়ে যাবো।'
কেন হঠাৎ বন্ধুর বউকে নিয়ে পালাবি কেন? বিদেশে কি মেয়ে পেলি না?
সৌরভ বলে  হ্যাঁ পেয়েছি।কিন্তু তৃপ্তিকে নয়।তৃপ্তির হাতদুটো কাছে টেনে নেয়। আজ যেন তৃপ্তিও অতৃপ্ত মনের তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করছিল। মুহূর্তের মধ্যে যে কি হয়ে গেল তৃপ্তিকে আরও কাছে টেনে নিল বুকের কাছে। তৃপ্তি যেন এরকমটাই চাইছিল। সৌরভ বলে আমি তোর সব খবর রাখি ।তোর তো এখনো পর্যন্ত একটি ও সন্তান হয়নি। দোষটা কার রে ,শেখরের? আমি তো তোর আশা পূর্ণ করতে পারি। চল আমরা বিয়ে করে নি ই। তুই শেখরকে  ডিভোর্স দিয়ে দে। তৃপ্তি আবার সংশয় যন্ত্রণা ভোগ করে। সত্যিই জীবনটা টানতে পারছে না। কি করবে সে?
সৌরভ তৃপ্তিকে জোরে ধাক্কা মারে  'কিরে ,কি হলো?'
তৃপ্তি বলে  'ভাবছি?'
সৌরভ বলে  'ভেবেই যা ,তারপর বুড়িয়ে যা। আমি তো বিদেশ থেকে তোর জন্যই আসলাম। ঠিক আছে ভাব আমি একটা সপ্তাহ আছি এর মধ্যে যা করবি আমাকে জানাবি। আজকের সন্ধ্যাটা আমরা একটু লং ড্রাইভ করেই ইনজয় করি ডার্লিং।
রাত আটটা নাগাদ সৌরভ তৃপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে যায়। সারাটা রাত তৃপ্তি সৌরভের সেই ক্ষণিকের ছোঁয়া ভুলতে পারে না। তাকে যেন আরো পাগল করে তুললো সিদ্ধান্ত নিতে ।সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে?'তার শূন্য হৃদয় কাননে এবার কি সত্যিই পুষ্পরাজি প্রস্ফুটিত হবে ।



ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" ক্রমশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much