পরিকল্পিত বিলোপপ্রবণতা - ব্যবসার ফাঁদে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ
অর্থনীতি বিভাগ (চতুর্থ বর্ষ)
(জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় )
"উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা,
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জ্বীন পরী দেও-দানা।"
যথার্থই বলেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। পুরো পৃথিবী এখন অনেক টাই আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। কোনো তথ্য জানতে এখন আর ধূলাময় বইয়ের স্তুপ ঘাটতে হয় না, হাতে থাকা স্মার্টফোনে কিছু গুতাগুতি করলেই তথ্য হাজির - আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দৈত্য এখন প্রদীপ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে আমাদের মুঠোফোনে। তবে আরব্য রজনীর সেই দৈত্যের দীর্ঘায়ু থাকলেও আমাদের হাতে থাকা নব্য স্মার্টফোন রূপী দৈত্যের বয়স খুবই সীমিত এবং অবাক করা বিষয় হচ্ছে এটি করা হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে।
কেবল স্মার্টফোন নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল ইলেকট্রিক সামগ্রীর ই বয়সকাল ইচ্ছাকৃত ভাবেই কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেতাবি ভাষায় যার নাম পরিকল্পিত বিলোপ প্রবণতা (planned obsolescence)। প্রতিটি পণ্য ই এখন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এমন ভাবে তৈরি করে যাতে ওয়ারেন্টির সময় টুকু কিংবা তার কিছু বেশিদিন ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে পণ্যটি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে গ্রাহক সেবা বঞ্চিত হয়ে ও গ্রাহক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেনা, কারণ কোম্পানী গুলো তখন তাদের চমকদার পূর্ণ বিজ্ঞাপনের নিচে ছোট্ট করে লিখে রাখা একটি লাইন দেখিয়ে দেয় - যেটি হচ্ছে Terms and conditions বা শর্ত প্রযোজ্য। পরিকল্পিত এই পদ্ধতিতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলছে একশ্রেণী, আরেক শ্রেণী ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের দুষ্টচক্রে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এক রকম অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা হয়েছে, সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে নতুন নতুন মডেল বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে যে প্রতারণা করা হচ্ছে তা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
গত কয়েক দশকে মানুষের মধ্যে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েই চলেছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে প্রস্ততকারক কোম্পানী গুলোর নিজেদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা। একটি পর্যায় পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা সুস্থ ছিল, গ্রাহক পর্যায়ে স্বল্প খরচে মান সম্পন্ন পণ্য পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এখন এই প্রতিযোগিতা আর কোম্পানী গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এর সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। ফলে রাজনীতির বেড়াজালে বিশেষ কিছু কোম্পানীর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবী এবং তার বাসিন্দারা।
যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে এমনিতেই পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিকল্প শক্তির উৎসের জন্য একদিকে যেমন বিজ্ঞানীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন, অন্যদিকে মুনাফালোভী কোম্পানী গুলো অল্প সময় মেয়াদি পণ্য তৈরি করে সম্পদের পরিমাণ আরও কমিয়ে ফেলছেন। পাশাপাশি দ্রুত ইলেকট্রনিক পণ্য পালটানোর সুবাদে ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পরিমাণ ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে - তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে আমাদের আবাসস্থল টি। উন্নত দেশ গুলো তে এসব রিসাইকল করা হলেও অনুন্নত দেশ গুলো এ বিষয়ে উদাসীন। তাদের গুগল সার্চ হিস্ট্রি ঘাটলে নতুন পণ্য মুক্তির খবর বা আন্তর্জাতিক বাজারের খবর পাওয়া যাবে - কিন্তু পুরনো পণ্য গুলো কে কিভাবে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে গড়ে তোলা যায় সেসব প্রযুক্তির খবরের হদিস পাওয়া যায়না। যার ফলশ্রুতিতে একদিকে পরিবেশ দূষণ করে আমরা পৃথিবীর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি, আবার ধরীত্রি বাচানোর স্লোগান তুলে অর্থায়নের জন্য সেই উন্নত বিশ্বের কাছেই আর্জি জানাচ্ছি। মুনাফার একটি অংশ দান করে তারা বাহবা কুড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমরা বুঝতেই পারছিনা যে আদতে আমাদের অর্থ ই দান হয়ে ফিরে আসছে আমাদের কাছে। বুঝতে পারবো ও বা কিভাবে - নতুন নতুন গ্যাজেট সাজিয়ে রঙিন চশমা পরিয়ে অন্ধ করে রাখা হয়েছে আমাদের। আমরা ও উন্নত হওয়ার তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে হাত বাড়াচ্ছি অপ্রয়োজনীয় নতুন কোনো পণ্যের দিকে - কেবল সামাজিক মান মর্যাদা বাড়ানোর উদ্দেশ্য। সেজন্য মধ্যবিত্তের ঘরে এখন শোভা পাচ্ছে এয়ারকুলার। গ্যারেজে গাড়ি না থাকা এখন অপমানজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় যানজটে পড়লে এখন সারিবদ্ধ জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দেখা মেলে, যেটিকে আমরা উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ও দেখি!!
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন - ইতালিতে যে মধ্যবিত্ত রেনেসাঁসের সূত্রপাত করেছিলো, সেই মধ্যবিত্ত এদেশে আসবে না। এদেশে মধ্যবিত্ত বই কেনে না, কিন্তু আশি হাজার টাকার আইফোন কিনতে রাজি। অথচ আইফোনের চেয়েও এখন আমাদের বেশি প্রয়োজন বই। আমাদের দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার রা যদি আমাদের চাহিদার যোগান দিতে পারে এবং দেশেই মান সম্পন্ন পণ্য তৈরি করতে পারি - তাহলে দেশের টাকা যেমন দেশেই থাকবে তেমনি ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের রাশ টেনে ধরা যাবে। আমাদের শুধু বিনিয়োগ করতে হবে সচেতনতা এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারের ইচ্ছে। পৃথিবী কে বাচিঁয়ে রাখার জন্য হলেও সবাইকে এই পরিকল্পিত বিলোপ প্রবণতার বিরুদ্ধে একজোট হতে হবে।
অসাধারণ ❤️
উত্তরমুছুনঅসাধারণ ❤️
উত্তরমুছুন