উপন্যাস
টানাপোড়েন১০৩
মানসিক যন্ত্রণা
মমতা রায় চৌধুরী
রেখা আজ স্কুলে ঢুকে স্টাফ রুম দেখে মনে হলো যে ঘরে এত শব্দ, এত আলো, আজ সে ঘড় নিস্তেজ হয়ে গেছে। চেয়ারটা ফাঁকা দেখেই বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। কি করে বসবে ?সেই ভাবনা ক্রমশ কুরেকুরে খেতে লাগলো। একটা কেমন দম বন্ধ করা পরিবেশ মনে হচ্ছে।
এর মধ্যে অনিন্দিতা স্কুলে এসেছে । রেখা দেখছে রেখার টেবিল চেয়ারে বসে আছে অনিন্দিতা। রেখা অত্যন্ত স্নেহের সুরে বলল ' অনিন্দিতা পাশের চেয়ার-টেবিলটায় বসবি?
অনিন্দিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রেখার দিকে তাকাল তারপর ক্রুদ্ধভাবে বলল 'কেন এখানে বসে আছি তো কি হয়েছে?_
রেখা নিম্নস্বরে বলে' না কিছু হয়নি পাশের চেয়ার-টেবিল ফাঁকা আছে ওখানে বসলে আমার একটু সুবিধা হত?'
অনিন্দিতা ডেসপারেটলি বলল_ না না এই স্কুলে তো এরকম কোনো নিয়ম নেই যে, সবার জায়গা ফিক্সট?'
রেখা বলল ;'না ,না আমি সে ভাবে বলতে
চাইনি ।আমি বলছি, আমার এখানে খাতাপত্র সব আছে তো, এখানটাতে বসে আমার দেখতে সুবিধা হবে ।'
অনিন্দিতা একগুয়ে মনভাবে বলল _আমিও তো খাতা দেখবো।'
রেখা বলল _' কেন মিছে মিছি এত কথা বাড়াচ্ছিস?'
অনিন্দিতা ঝগড়ার মুডে বলল_ কথা তো আমি বাড়াচ্ছি না তুমি বাড়াচ্ছ রেখা দি।'
রেখা বলল' স্কুলে এসে ঝগড়া করতে একদমই ভালো লাগে না আর তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে তুই গায়ে পড়ে ঝগড়া করছিস?'
অনিন্দিতা বলল' আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু জানি আমরা কে কোথা থেকে এসেছি। তাই ঝগড়া করব এরকম মানসিকতা আমার তৈরি
হয়নি। তোমার ভেতরে হয়তো এটা আছে। তাই সেটারই প্রকাশ ঘটাচ্ছ।'
রেখা বলল-'কেন অকারণে এত কথা বলছিস?'
অনিন্দিতা বলল-"এটা অকারণ?'
রেখা বলল "তবে না তো কি?'
অনিন্দিতা বলে 'এবার কিন্তু রেখাদি তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছ,।'
রেখা বলল _আমি এখানটায় বসি, ন্যাচারেলি সেই কারণেই তোকে বলেছি। আরও তো ফাঁকা জায়গায় রয়েছে সেখানে বোস না?'
রেখা অনিন্দিতার মধ্যে একটা হট টপ চলছে অথচ সিনিয়র টিচার যারা ছিলেন তারা কিন্তু কেউ কিছু বললেন না যে এটা ঠিক নয়।
কিছু টিচার আছেন যারা অনেক হম্বিতম্বি করেন কিন্তু সঠিক কথা বলার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই অনিন্দিতাকে তারা ধমক দেন না যে কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি।
রেখার খুব রিম্পাদির জন্য মন খারাপ হতে
লাগল ।আজ রিম্পাদি থাকলে এর প্রতিবাদ করত ।রিম্পাদি থাকাকালীন এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি ।
আজ বড়দিও নেই আর যদি বড়দি থাকতেন তাহলে কোথায় এরকম একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।
রেখার ঘরখানাকে দেখে তাই মনে হল যেন যে ঘরে এত শব্দ, এত আলো ,এত কলতান, এত আড্ডা, হাসি তামাশা নিমেষে কেমন যেন ঘর খানা খালি খালি মনে হতে লাগল। রেখার মনটা নিস্তেজ হয়ে পড়ল। কন্ঠ বাকরুদ্ধ হলো ,চোখ ছলছল।আরো বেশি মন খারাপ হতে লাগল অনিন্দিতার এই ব্যবহারে ।কেমন যেন সমাধির মত নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ ,বধির পরিবেশ মনে হতে লাগল ।শুধু সে একা।একা কি করে এই স্টাফ রুমে থাকবে ?ভাবতেই তার কেমন মনটা হু হু করে উঠলো।
শুধু মনে হতে লাগলো একসময় কি এই ভালোলাগার সুখের অনুভূতিগুলো থাকবে
না ।নাকি চোখের সামনে না থাকলেও রিম্পাদির অনুভূতিটুকু ,সচেতনাটুকু তার মনের অস্তিত্বে অনুভব করবে। নাকি একেবারেই নতুন ছোঁয়া নতুন আলপনার মত হয়ে যাবে সবকিছু। কেমন যেন একটা বিচ্ছেদের বেদনায় ম্রিয়মান হয়ে পড়ল রেখা।
অনেকক্ষণ নিজের টেবিল চেয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে যখন অনিন্দিতা উঠলো না ।তখন নিজে থেকেই সরে গেল ।যাবার আগে শুধু বললো 'কাজটা তুই ঠিক করলি না অনিন্দিতা।'
অনিন্দিতা বলল 'কোনটা ঠিক , বেঠিক তোমার কাছ থেকে শিখব না রেখাদি ।দরকার হলে তুমি যেভাবে কথা বলছো ,তাতে আমার মনে হয় তোমার শিক্ষা, রুচি বোধের কোথাও বোধহয় কমতি আছে।'
রেখার মাথাটা কেমন হঠাৎই গরম হয়ে
গেল । আর জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল 'আমার শিক্ষা, রুচিবোধ? কেন রে ,আমি কি এমন শিক্ষা হীনতা,রুচিহীনতার পরিচয় দিলাম?'
অনিন্দিতা বলল _কেন এই বসা নিয়ে যেসব রুচিহীন কথা তুমি বলছো ,আমাকে সরে যেতে বলছ, এটা কি তার যথেষ্ট প্রমাণ নয়?'
রেখা বললো 'তুই এসব কি কথা বলছিস? এই জায়গাটায় আমি বসি, তাই তোকে বলেছি।'
অনিন্দিতা বললো 'এখানে তো কারো জায়গা ফিক্সট নয়।'
রেখা বললো 'আমরা প্রত্যেকে জানি কারোরই জায়গা ফিক্সট নয় ।তবুও আমরা যখন এখানে এসেছি ,একটা কাজ করছি ,প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে, সেখানে সে নির্দিষ্ট দিনে বসবে ,সেখানে তার ব্যাগটা রাখবে, সে সেখানে কাজগুলো করবে। নইলে তো উদ্দেশ্যহীন যাযাবরদের মতো ঘুরে বেড়াতে হবে আজ এক জায়গায় কাল অমুক জায়গায়।
অনিন্দিতা বলল 'এটা তোমার ভুল ধারণা । আমার এই আজকে যদি জায়গাটা ভালো লাগে তাহলে কি আমি বসবো না ?তুমি কি আপত্তি করতে পারো ?এটা তো কারো কেনা জায়গা নয় বল?'
রেখা বলল_ আমি একবারও বলিনি যে কারো কেনা জায়গা ।আমি তোকে বোঝাতে চাইছি কেউ তো আর সারাদিন ধরে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াবে না ।একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকলে সে তার নির্দিষ্ট জায়গায় এসে তার ব্যাগটা রাখবে, সেখানে কাজ করবে বসে। শান্তিতে কাজ করতে বসে একটা মনের প্রশান্তি।'
অনিন্দিতা বলল 'কাজ করতে জানলে প্রশান্তি এমনি ফিরে পাবে রেখাদি ।জায়গা নিয়ে কোনো প্রশান্তির কথা তুমি বলো না? জায়গাটা কোন ম্যাটার করে না।'
রেখা বললো 'তুই কি আজকে শুধুমাত্র আমার সঙ্গে অকারণে কথাগুলো শোনাবি বলে এরকম ব্যবহার করছিস?'
অনিন্দিতা বললো 'তোমার কি তাই মনে হচ্ছে আমার কি কোন খেয়ে কাজ নেই। আমি তোমার সঙ্গে যেচে পড়ে এই সমস্ত কাজগুলো করতে
যাব ।বরঞ্চ তুমি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছ?'
রেখা বলল 'দেখ আমি সেরকম কোন কিছুই করতে চাইছি না ।আমি তোকে শুধু সেই ব্যাপারটাই বোঝাতে চাইছিলাম। তোর একটা জায়গায় এত দিন বসে এসেছিস ,কেউ কি গিয়ে তোর জায়গায় বসেছে ভাই এইভাবে কথা বলেছে? হ্যাঁ এটা হতে পারে ক্ষণিকের জন্য হয়তো বসেছে আবার তুই গেলে নিশ্চয়ই সেখান থেকে উঠে এসেছে। এরকম তো হয়।'
অনিন্দিতার রেখার এই সমস্ত কান্ড-কারখানা দেখে কেউ কিন্তু কোন প্রতিবাদ করছে
না ।প্রত্যেকেই নিজের মনে বিষয়গুলো উপভোগ করছে । কাওকে তো দেখে বোঝা গেল যে পুরোটাই অনিন্দিতাকে সাপোর্ট করছে কিন্তু
কেন ? কেন এমন করছে? রেখা তো এরকম চায়না ।প্রত্যেককে ভালোবেসে, প্রত্যেকের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায়। তাহলে কেন তার সঙ্গে এরকম হচ্ছে?'
রেখা মনে মনে ভাবছে' কাউকে পছন্দ না করে ভালোবাসা যায় কিন্তু এটা কি হচ্ছে অনিন্দিতাকেও ভালোবাসে। আজকে অনিন্দিতার ব্যবহার রেখাকে বুকের ভিতর শুল বিঁধিয়ে
দিচ্ছে ।সমস্ত মনটা কেমন যেন বেদনায় দগ্ধ হচ্ছে ।যেন মনে হচ্ছে উঠোনে নর্দমা থেকে একটা শিরশিরে শীত আর দুর্গন্ধ আছে।
রেখা তবুও তার সুবাস ছড়িয়ে দিতে চায় অনিন্দিতার ভেতরে ।
তাই মিষ্টি সুরে রিকোয়েস্ট করল ' তাহলে তুই সত্যিই এখানে বসবি? তুই তোর জায়গায় যাবি না?'
অনিন্দিতা বলল' তুমি কি পাগল? আমার মনে হয় তোমার কোন মেন্টালি সমস্যা হচ্ছে, আর না হলে তোমার কোন সাইকো সমস্যা হচ্ছে? তুমি এক কাজ করো আজকে বাড়ি গিয়ে দাদাকে বলে তোমাকে একজন সাইক্রেটিস ডাক্তার কাছে নিয়ে যেতে।'
রেখা বলল _কেন রে আমি কেন সাইকো ডাক্তার দেখাতে যাব?'
অনিন্দিতা বলল_ তোমার ব্যবহার সেটা বলে দিচ্ছে।'
রেখা বলল' ঠিক আছে তোর যখন একান্ত এই জায়গাটাই পছন্দ তুই এখানে বোস। আমি বরং অন্য জায়গায় গিয়ে বসি।_
অনিন্দিতা এমন তাচ্ছিলভাবে রেখার দিকে তাকাল সকলে উপস্থিত সহকর্মীরা হেসে উঠলো।"
রেখা মনে মনে ভাবল_ কাদের দেখছে? দীর্ঘদিনের চাকরিজীবনে এরাই তার
সহকর্মী ।একজন সিনিয়র টিচার কে একজন জুনিয়র টিচার অপমান করছে আর এরা তার সাথে তাল মিলিয়ে হয় চুপ করে থাকছে, চুপ করে তার সাপোর্ট করছে । নয়তো প্রকাশ্যেই হেসে উঠছে ।এর থেকে অপমান আর কি হতে
পারে ?রেখা নিতে পারছে না ।রেখা সত্যিই কাজের জায়গাটা মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে মানসিক দিক থেকে শান্তির বিষয়টা উড়ে চলে যাচ্ছে।'
একসময় ভেবেছিল রেখা যে শেষ পর্যন্ত হয়তো অনিন্দিতার মত বদলাবে একটা ক্ষীণ আশা তার মনের ভেতরে ছিল। তাই সে শেষবারের মত আরেকবার অনিন্দিতাকে বলেছিল কিন্তু যখন টের পেল না এই আশা লালন করা তার ব্যর্থ হয়েছে ।চোখের পাতা দুটো তাই জ্বালা করে উঠলো ।এত নীচ, এত স্বার্থপর কেউ হতে
পারে? মনে মনে একটা পরিমাণ হীন অভিমান উদ্বেল হয়ে উঠলো ,যেন মনে হচ্ছে জায়গাটা নেবার জন্য বা বসার জন্য নয় ,এই যে কুরুচিকর কথাবার্তাগুলো বলল ।সেই বলার জন্যই তার মনের ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে। কোন কারণ
নেই ।তবুও কেমন যেন মনে হয়েছিল একবার গিয়ে অন্তত অনুরোধ করে যদি বলে, যদি জায়গাটা ছেড়ে দেয় ।কিন্তু সেটা হলো না। রেখা তারপর মনে মনে ভাবতে লাগল 'ছি : একটা জায়গার জন্য এরকম কাজ ,এত কথা
কাটাকাটি ?কি দরকার ?সত্যিই তো তাই কেউ কি জায়গা সঙ্গে করে এনেছে নাকি বা নিয়ে যাবে নাকি?কারো জায়গা নির্দিষ্ট নয় । প্রত্যেকে জায়গায় একটা নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। তাই কথাটা তো একদম ঠিক বলেছে। সুতরাং এটাকে মেনে নেয়াই উচিত সমস্ত সম্পর্কের নিবিড়তা, সমস্ত পরিচয় গভীরতার দিকটা আজকাল মনে হচ্ছে যেন কেমন যেন অন্ধকার। মনের দেয়া সেখানে কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে তালা। তাই আঘাতের মুহূর্তটিকে রেখা কিছুটা ভেঙে পড়েছিল ।যেন মুষ্টিযুদ্ধে মুখ থুবরে পড়ে যাওয়ার মত ।তাই শুধু দৈহিক যন্ত্রণা নয় ,একটা মানসিক অপমানবোধ ও তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে ছিল ।যেন কুকুর তাড়া করেছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much