১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস ৫৮




শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ৫৮)
শামীমা আহমেদ 

রীতিমতো একটা ঝড় মোকাবেলা করে শিহাব আর সুমাইয়া মায়ের ঘরে গেলো।তখনো  আরাফ সুমাইয়ার কাঁধে।  মাথা গুঁজে দিয়ে একেবারে সুমাইয়ার বুকে গা লেপ্টে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে! শিহাবকেও বেশ বিধ্বস্ত লাগছে। সকালবেলা যেমন সুন্দর ফুরফুরে মেজাজে শায়লাকে নিয়ে এসেছিল এখন  কেমন যেন অগোছালো লাগছে। শিহাব  শায়লারকে  নিজের সবটা জানাতে   চোখে মুখে আকুতি নিয়ে শায়লার দিকে তাকিয়ে রইল।শিহাবকে দেখে  শায়লা এক অজানা আশংকায় অস্থির হয়ে উঠলো! শায়লার চোখের জিজ্ঞাস্যও শিহাবের চোখে ধরা পড়েছে। সে শায়লাকে নিয়ে মায়ের ঘরের সাথের খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
শায়লাকে সব জানাতে হবে।শিহাব কিছুই লুকাবে না। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আরাফ আর রিশতিনাকে নিয়ে আজ যা ঘটে গেলো শায়লার তা জেনে রাখা উচিত।
শিহাব শায়লার হাত ধরে সব খুলে বললো।
শিহাব একে একে তার যুক্তি পালটা যুক্তি দিয়ে রিশতিনার সাথে সব কথোপকথনের শেষটা পর্যন্ত বলে গেলো।শায়লা খুবই অবাক হলো, পাশের ঘরে বসে সে কিছুই টের পেলোনা!   
শায়লা বুঝে নিলো রিশতিনা তার প্রাপ্যটাই চাইতে এসেছে।তবে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার সাথে শিহাব আজ অনেকটাই জড়িয়ে গেছে।যার দুঃখ ভুলাতে শায়লা শিহাবের
আপন হলো, যার দুঃখ ভুলতে শিহাব শায়লাকে আপন করে নিলো আজ ঘটনার দৃশ্যে তারই উপস্থিতি!
শায়লা শিহাবের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো।সে শিহাবকে শান্ত করতে চাইলো। খুবই সহজ করে বললো, আমি হলেও এটাই করতাম শিহাব।রিশতিনা কোন ভুল করেনি। তবে ঐ মূহুর্তে  ভেবে চিন্তে তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো সেটাই মেনে নাও। চলো, তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাই।তার কাছে গেলে তোমরা ভালো লাগবে।শিহাব শায়লার মাঝে, শায়লার কথার মাঝে সান্ত্বনা খুঁজে পেলো।
শায়লার চোখে চোখ রেখে আশ্বাস আর ভরসার সাড়া পেলো।
ঘরে সুমাইয়ার কোল থেকে আরাফ দাদুর কোলে ঝঁপিয়ে পড়লো।মনে হলো কোন ভয়ংকর কিছু দেখেছে সে, তাইতো দাদুর কাছে আশ্রয় নিতে চাইছে। আরাফকে কাছে নিয়ে দাদু কান্নায় ভেঙে পড়লো। এই কান্না, একটি শিশু তার আপন মায়ের আদর বঞ্চিত হওয়ার,এই কান্না এক দরদী মায়ের নিজ সন্তানকে ফিরে না পাওয়ার, একজন স্ত্রী তার স্বামীর ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার,নিজের ছেলের জীবন এলোমেলো হয়ে যাওয়ায়।
মা হয়ে খুবই কষ্ট এইসব মেনে নেয়া।সুমাইয়া তার শ্বাশুড়িকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।সুমাইয়াও বারবার শাড়ীর আচলে চোখ মুছছে। তার বিয়ের পরে শিহাবকে সে কলেজ পড়ুয়া পেয়েছে। এতোটা গোছানো আর সুন্দর আচার ব্যবহারের শান্ত ছেলেটির জীবনে যে এত ঝড় বয়ে যাবে তাই বা কে জানতো! 
শায়লা শিহাব মায়ের ঘরে ঢুকলো।শায়লা এই প্রথম আরাফকে দেখলো। মানে দাদুর কোলে জাপ্টে ধরা আরাফকে। মুখটা এখনো দেখা হয়নি। শায়লা ভেবে নিলো, যে করেই হউক আরাফকে আপন করতে হবে।আজ সকালে ওর জীবনে যা ঘটে গেলো  একটা  শিশুর জন্য সেটা খুবই শকিং। 
শিহাব আরাফকে সহজ করার জন্য বাবা বাবা বলে ডাকতেই আরাফের সাড়া মিললো। সে বাবার দিকে তাকালো  কিন্তু তার পাশে শায়লার মুখটা চেনা না অচেনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার বাবার ঘরে সকালে দেখা মুখটা যে বলেছে, সে তার মা, এই কি সেই জন? শিশুটির চোখে প্রশ্ন খেকে যাচ্ছে। শায়লা তার চোখের ভাষায়  আরাফকে কাছে ডাকছে। আরাফ একবার শিহাব  আর একবার শায়লাকে দেখছে। শিহাব হাত বাড়িয়ে কাছে নিতে চাইলে এক ঝাঁপ দিয়ে  বাবার কোলে উঠে গেলো। শায়লা শিহাবের কাছে একটু ঘেঁষে দাঁড়াতেই আরাফের চোখ যেন বিস্ময়ে বিস্ফারিত!  কেন সে তার বাবার কাছে ঘেঁষে দাড়াচ্ছে? বাবাতো সকালে মায়ের সাথে অনেক রাগ হয়েছে।আরাফের ভীত চোখ আর ভেতরে বয়ে যাওয়া নানান প্রশ্ন ঘরের সবাই বুঝতে পারছে।দাদু কেন কাঁদছে এটাও তার জিজ্ঞাসা।  সব মিলিয়ে সে যেন একটা প্রশ্নের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।  শিহাব আরাফকে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরে রইল। কিন্তু খোল চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে শায়লাকে দেখছে। শায়লা যেন বুঝেও না বুঝার মত করে এই প্রথম  আড়চোখে আরাফের মুখটা দেখে নিলো।কী ভীষণ মিষ্টি  মুখখানা। মুখের গঠন শিহাবের সাথে খুব একটা মিলছে না।বুঝা গেলো সে মায়ের মতই হয়েছে। শায়লা কল্পনায় রিশতিনার মুখটা ভেবে নিলো। তখনই নিজের ভেতরে কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করলো। পরক্ষণেই তার চোখের দিকে আরাফের দৃষ্টি পড়তেই আরাফ তাকে চেনার চেষ্টা করছে।

তিনতলা থেকে সুনায়রা আর আরুশ  সরাসরি দাদুর ঘরে চলে এলো। সবার মাঝে একটা থমথমে ভাব দেখে ওরা প্রথমে একটু থমকে গেলো।শিহাবের কোল থেকে   আরাফ ওদের দেখে একটু স্বাভাবিক হলো।
ঘরে একজন নতুন অতিথি দেখেচসুনায়্রা আর আরুশ একটু  সিঁটিয়ে গেলো। সিমাইয়া ওদের সাথে শায়লাকে  কি  নামে পরিচয় করাবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। শিহাবই বাচ্চাদের সাথে শায়লার পরিচয় করিয়ে দিলো। 
শিহাব জানালো,উনি হচ্ছেন শায়লা,উনি  তোমাদের নতুন চাচী হবেন।তবে  তোমরা এখনই চাচী ডাকতে পারো। শায়লা চাচী।এই কথায় সবার সেই থমথমে ভাবটা কেটে গেলো।সবার মুখে হাসি ফুটলো।আজ সকাল থেকে যা,একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

শিহাব এবার আরাফকেও একটু সহজ করে নেয়ার চেষ্টা করলো।  আরাফের মুখের দিকে জানালো, আরাফ এইটা তোমার মা। শায়লা মা। যাও, বাবা মায়ের কাছে যাও। মা তোমাকে অনেক আদর করবে। শিহাব আরাফকে শায়লার কাছে দিতে চাইলো। শায়লাও হাত বাড়িয়ে আরাফকে কাছে নিতে চাইল।আরাফ কিছুটাক্ষণ নিশ্চুপ থেকে চাচীমা বলে সুমাইয়ার দিকে হাত বাড়ালো।  চাচীমা, আরাফকে এই ডাকটি তার দাদুই শিখিয়েছে। মা ডাকটি যেন সে ডাকতে পারে।মুরুব্বিরা অনেককিছুই আগাম বুঝতে পারে।তিনি আগেই ভেবে রেখেছিলেন,আরাফের মা যেহেতু বেঁচে আছে কোন না কোনদিন  সন্তানের খোঁজে আসবেই। তখন নিজের মাকে মা ডাকলেও চাচী ডাকটি থেকে যাবে।আর যেভাবে মায়ের আদরে সুমাইয়া আরাফকে বড় করেছে মা ডাক তারও প্রাপ্য।

সুনায়রা আর আরুশ কিছুক্ষণ শাআকে অবজার্ভ করে হাত এগিয়ে নতুন চাচীর হাত ধরলো।শায়লাও ওদের কাছে টেনে নিয়ে আদর করলো।  সুনায়রা বললো, চলো চাচী আমদের সাথে ক্যারাম খেলবে। বলেই শায়লাকে টেনে দাদুর রুম থেকে নিয়ে যেতে চাইলো। শায়লাও ওদের সাথে পা বাড়ালো।আরাফ তখনো, সুমাইয়ার কোলে।চোখ গোল গোল করে শায়লার চলে যাওয়া দেখছে। সুমাইয়াও ওদের সাথে আগালো।দিনের সব রান্নাবান্না পড়ে আছে। 
সুনায়রা আর আরুশ  দাদুর ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে ক্যারাম খেলার প্রস্তুতি নিলো।সুমাইয়া আরাফকে সেখানে মেশাতে চাইলেও সম্ভব হলোনা।সে চাচীমার কোলেই বেশ আছে। সুমাইয়া আরাফকে নিয়েই তিনতলায় চলে গেলো। বাচ্চারা শায়লাকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠলো। ওরা ভুলেই গেলো, এটা তাদের চাচী।খেলার আনন্দে শায়লা খুব দ্রুতই অনেক বন্ধু হয়ে ওদের সাথে মিশে গেলো।

মায়ের বিছানাত শিহাব মাকে শুইয়ে দিলো। মায়ের পাশে বসে মায়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। জানতে চাইলো, শায়লাকে তোমার কেমন লাগলো মা।
মা জানালেন, খুব ভাল লেগেছে বাবা।খুবই মায়াকাড়া মুখটা। আরাফকে যেন মায়ের আদরে রাখে এটাই চাওয়া।আমি আর কয়দিন? বড় বৌমা আর কতদিন দেখবে? তার নিজের সন্তানরা বড় হয়েছে। এসব বলে মা  কাঁদতেই শিহাব তাকে  তাকে সান্ত্বনা দিলো।দেখে নিও মা, শায়লা কেমন করে তোমাদের সবাইকে আপন করে নেয়।আর আরাফের মা হয়ে আরাফেরও যত্ন নেয়।ও খুব ভালো  একটা মেয়ে, মা। আরাফকে মায়ের অভাব বুঝতে বুঝতেই দিবেনা।
মা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,  আল্লাহ যেন তাই করেন।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much