উপন্যাস
টানাপোড়েন১০২
মন ক্যানভাসের চরিত্র
মমতা রায় চৌধুর
মকর সংক্রান্তির ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে চারিদিক। এরই মাঝে কি মনে হলো বারান্দায় ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো রেখা রান্নাবান্না কমপ্লিট করেছে। এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে চেয়ারটিতে। রেখা গিয়ে বসেছে পিঠটাকে রোদের দিকে রেখে ।খোলা চুলে আলতো চুমু যেন এঁকে দিয়ে যাচ্ছে এক চিলতে রোদ্দুর। রেখা এক প্লাস্টিকের মাঝারি ঝুড়িতে মটরশুটি নিয়ে খোসা ছাড়াতে বসলো। মটরশুঁটির খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কখন যেন চোখ দুটো চেয়ারে বসে বসে ঘুমে ঢুলুনি।
একবার তো ব্যালেন্স হারিয়ে প্রায় পড়ে যায় যায় অবস্থা তখনই ধরফরিয়ে উঠে বসে রেখা চারিদিকে একটু দেখে নেয় ,কেউ দেখে ফেলে নি তো। তারপর নিজেই আপন মনে হেসে ওঠে।
মটরশুঁটির খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আপন মনে ভাবতে থাকে। ঘটে যাওয়া মন ক্যানভাসের স্মৃতি।
মনে পড়ে ছোটবেলাকার কথা মা,কাকিমা , জেঠিমারা যখন মটরশুঁটির খোসা ছাড়াতে বসতো, তার অর্ধেক মটরশুটি আমরাই খেয়ে শেষ করে দিতাম।
মা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতেন আর বলতেন
,তোদের পেটে কি রাক্ষস ঢুকেছে?'
কাকিমা বলতেন 'ছাড়ো না দিদি, দুটো তো খাবে?'
মা বলতেন 'এই ছোট তোদের এই আশকারাতে ওরা কিন্তু গোল্লায় যাচ্ছে। বিশেষ করে ননী।'
কাকিমা হেসে উড়িয়ে দিতেন ।
আমরা কখনও জেঠিমা, কাকিমা, মায়ের মধ্যে মনোমালিন্য হতে দেখিনি।
যদিও বা কখনো কিছু হয়েছে , সেটা কিন্তু আমরা বুঝতেই পারতাম না। প্রত্যেকে নিজের নিজের তাগিদেই সে সব ভুলে গিয়ে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।
রেখাএসব ভাবছে আর একা একা হাসছে।
হঠাৎ পাশের বাড়ির ছাদের থেকে ডাক শোনা গেল' ও দিদি. ও দিদি .দিদি।'
রেখার শৈশবস্মৃতিতে বাঁধা পড়ে। ও বাড়ির ছাদ থেকে চৈতির মা রেখাকে ডাকছে।
রেখা গলাটা বাড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বলল ' কি গো দিদি?'
চৈতির মার খুবই ঠাণ্ডা লেগেছে বোঝাই যাচ্ছে ।ছাদেতেও বেশ ভালো করে সোয়েটার ,চাদর, সঙ্গে আবার একটা মাথায় বউ টুপি পরেছে।
বলল ' দিদি, পিঠে করেছেন?
রেখা ঈষৎ হেসে বলল ''না গো
দিদি ,সেভাবে কিছুই করি নি ।ওই পিঠের সাজ একটু পুড়িয়ে রেখেছি । কয়েকটা আসকে পিঠে করেছিলাম।'
রেখা জিজ্ঞেস করল 'তুমি করেছ?'
চৈতির মা বলল 'আমি আবার কি করেছি বলুন তো ,আমি একটু দুধ পুলি করেছি।'
রেখা বলল 'বাহ ভালো জিনিস বানিয়েছ।'
চৈতির মা বলল'ওই হয়েছে আর কি?
রেখা বলল 'চৈতি আসে নি?'
চৈতির মা বলল হিমশীতল কন্ঠে"আর বলবেন না দিদি, ওর শাশুড়িমা তো গঙ্গাসাগর মেলায় গেছেন।
রেখা অবাক হয়ে বলল 'সে কি? ওনার না শরীর খারাপ বলছিলে?'
চৈতির মা একটু উৎসুক ভঙ্গিতে বলল'তাহলেই বুঝুন। ছেলে কত বারণ করেছে এই অবস্থায় যেওনা। উনি যেটা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। কারো কথা থরি না তোয়াক্কা করেন।'
রেখা হেসে বলল 'বুঝতে পারবেন মেলা থেকে এসে শুধু ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ কর।
চৈতির মা বিরক্তি কন্ঠে বলল ' ওনার আর কি এসে শুয়ে পড়বেন, যত ঝামেলা আমার মেয়ের।'
রেখা হেসে বলল' এটাই তো মেয়েদের জীবন দিদি। তারপর বলল না এখন যাই দিদি। পরে কথা হবে ।কাজ পড়ে রয়েছে মেলা ।'
চৈতির ছাড়ানো মটরশুঁটির খোসাগুলো একটা ঝুড়িতে নিল আর মটরশুঁটিগুলো একটা ক্যারি ব্যাগে রাখল আর বলল 'হ্যাঁ আমারও কাজ পড়ে রয়েছে।"
রেখা মটরশুঁটির ক্যারি ব্যাগ নিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিল। আজকে রাত্রির মেনু হবে আলুর পরোটা আর মেথি মালাই। মনোজ যেটা খেতে খুব ভালোবাসে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রিজ খুলে দেখল ' ফ্রেশ ক্রিমটা আছে কিনা?'
সবই আছে কিন্তু ফ্রেশ ক্রিমটা তো একদমই অল্প আছে। তারপর মনে মনে ভাবলো না থাকে না থাকুক এখন কাকে পাঠাবো দোকানে? উনার তো আবার কি কারনে মুড অফ হয়ে আছে, কিছুতো বলাও যাবে না। ঘরে দুধ আছে ও দিয়ে চালিয়ে নেব।'
তারপর রেখা মনে মনে ভাবে কেন যে মাঝে মাঝে মনোজ এরকম হয়ে যায় বুঝতে পারিনা। মনে হয় পোকাগুলো নড়েচড়ে ওঠে।হঠাৎই ভাবতে ভাবতে ফোনটা ঘাঁটছে এমন সময় দেখল বেশ কয়েকটা মেসেজ এসে পড়ে
রয়েছে। রেখা মনোযোগের সাথে মেসেজগুলো পড়ল। দেখল যে কটা মেসেজ এসেছে তারমধ্যে দুটো স্কুলের গ্রুপ থেকে এসেছে, বাকি মেসেজ এসেছে 'সিঁড়ি'পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে ।বেশ মজা করে লিখেছেন তো ভদ্রলোক। মজার ছলে কবিতা
লিখেছেন ।ভালো লেখেন আবার উনি আমাকে বলেন কিনা আমি লেখিকা ।যাই হোক শুরু করতে বলেছেন
উপন্যাস লিখতে। সাহস করে কলম ধরবো ।একটা মেসেজ লিখলাম।
উনি দেখছি সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স
করলেন ।'সাহস করে তো ধরতেই
হবে ।আপনার দ্বারা হবে আমি জানি ।আমরা সবাইকে বলি না আপনি চেষ্টা করুন নিশ্চয়ই পারবেন। '
রেখা লিখল'লেখা তো আমার নেশা আমি ভালোবাসি কিন্তু উপন্যাস?'
ভদ্রলোক লিখলেন 'কেন নয়?'
রেখা লিখল' আমি পারবো?'
ভদ্রলোক লিখলেন 'অবশ্যই পারবেন ।আপনি পারবেন?'
রেখা বলল 'কী করে বুঝলেন আমি পারবো ?আপনি কি জ্যোতিষী?'
ভদ্রলোক লিখলেন' আমি জ্যোতিষী কিনা জানিনা । তবে আমরা তো বিভিন্ন লেখা নিয়ে নাড়াচাড়া করি ।আপনার ভেতরে একটা শক্তি আছে। আপনি চেষ্টা করলেই সেই শক্তিটা কে আপনি বের করে কাজে লাগাতে পারেন?
রেখা বলল ও তাই বুঝি?
ভদ্রলোক লিখলেন ' আপনার চোখের ভেতরে সেই গভীরতা আমি দেখেছি।
রেখা বলল এত দূরদর্শী?
ভদ্রলোক লিখলেন 'আশা রাখবো আপনি আমার কথা রাখবেন?'
রেখা বলল 'নিশ্চয় চেষ্টা করব ।আপনি যখন এতটা উৎসাহ দিচ্ছেন। আমি চেষ্টা করব ।এটুকু আপনাকে বলতে পারি?'
ভদ্রলোক বললেন' ওটুকুই দিতেই হবে আপনি ওই চেষ্টাটুকুও করুন বাকিটুকু ছেড়ে দিন ।'
আজকের এই শূন্য বারান্দায় এক সময় কত খুনসুটি হয়েছে আর আজ পুরো
একা ।আশেপাশে প্রত্যেকে আছে কিন্তু কোথায় যেন মনের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে ।জানিনা
কেন ?উপন্যাসের চরিত্রগুলো তে কিছু কল্পনা আর বাস্তবের রং মিশিয়ে আমি চেষ্টা করব তাকে রূপ দেবার। কলম ধরে ফেলে প্রথম পর্ব টা আজকে স্টার্ট করব।'
রেখা স্টার্ট করলো উপন্যাসের প্রথম পর্ব।
এরমধ্যে কলিংবেল বাজতে শুরু করেছে।
একটু বিরক্ত হল। তারপর বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেল চৈতির মা দাঁড়িয়ে।
একগাল হাসি নিয়ে চৈতির মা বলল 'দিদি ,আমি একটু পিঠে বানিয়েছিলাম। বললাম, না, দুপুর বেলায় ।তাই একটু নিয়ে আসলাম । একটু টেস্ট করবেন।'
রেখা বলল "এসবের কি দরকার ছিল দিদি।'
চৈতির মা বলল'দাদা কোথায় (দেখতে পাচ্ছি না,,?
রেখা বলল 'আছে এদিক ওদিক কোথাও।'
চৈতির মা বলল 'আসি তাহলে দিদি বেলাও পরে এসেছে।'
রেখা মনে মনে ভাবল একবার শুরু করল
আর থামতেই চাইবে না। তবুও মনে মনে ভাবল এখন তাড়াতাড়ি গেলেই বাঁচি। উপন্যাসটা একটু স্টার্ট করেছি ঠিক তখনই..?
চৈতির মা বেরিয়ে যাবার পর রেখা একমনে লিখতে লাগলো।
রেখা ডুবে গেল তার লেখায়। এরমধ্যে মনোজ এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। হঠাৎ কেশে উঠলো মনোজ। ঠিক তখনই রেখা তাকিয়ে দেখল।
মনোজ বলল' আজকে কি কিছু খাবার হয়েছে?'
রেখার চমক ভাঙ্গে তারপর বলে ' হ্যাঁ'
রেখা বলল দুপুরের খাবার টাইম তো কখন পেরিয়ে গেছে। তোমাকে ডাকাডাকি করতেও ভয় লাগছিল, কখন কি বলে দেবে তার তো ঠিক ঠিকানা নেই। কাজে কাজে ই ...।
মনোজ বলল'আমাকে খেতে দাও।
পেটে রাক্ষস ঢুকেছে। এক পাহাড় সমান খিদে।'
রেখা বলল 'এইতো এক্ষুনি দিচ্ছি।'
লেখার বারোটা বাজলো রেখা মনে মনে বলল। সব সময় তো লেখায় মুড আসে না। যাও বা এখন একটু মুড আসলো ,তাও অথৈ জলে..।
মনোজ বলে উঠলো ''
কি লিখছো এতো?
রেখা বললো 'আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে উপন্যাস।'
মনোজ বলল' বাহ বেশ ভাল।'
রেখার ডায়েরিটা রেখে রান্নাঘরের দিকে গেল খাবারের আয়োজন করতে।
মনোজ বলল, অল্প ভাত দেবে?
রেখা বলল 'কেন অল্প কেন?'
মনোজ বলল খিদে নেই?
রেখা বলল ' এতটা বেলা হয়েছে তবু খিদে নেই। অথচ একটু আগে বললে পাহাড় সমান খিদে। আর এখন... তাহলে কি লোহা হজম করেছে নাকি!
মনোজ একগাল হাসল।
রেখা বলল' পিঠে খাবে?'
মনোজ বললো ' দাও ।তুমি আবার কখন পিঠে বানালে?
রেখা খুব উৎসাহিত হয়ে পাতে পিঠে দিয়ে বলল' চৈতির মা করেছে আমি করিনি ।'
মনোজ বলল "আগে তো বেশ ভালো ভালো পিঠে করে খাওয়াতে আর এখন কি হলো?'
রেখা বললো 'তাহলে মন ক্যানভাসের পাতা উল্টে দেখতে হবে বুঝলে মশাই।'
তাহলেই দেখবে শুধু পিঠে নয় আরো কত ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much