শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৪৬)
শামীমা আহমেদ
সন্ধ্যা লগন পেরিয়ে রাতের আঁধারে ডুবেছে প্রিয় শহর।যদিও পথের দু'ধারের নিয়ন বাতি আর যানবাহনের আলো রাতের আঁধারকে গ্রাস করে নেয়। মুহুর্মুহু হর্ণের শব্দে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে কোলাহলপূর্ণ পথঘাট সরব হয়ে উঠে।ওদের পূর্বাচল থেকে বেরুতে একটু দেরি হয়ে গেলো।শিহাব দ্রুতই ছুটছে।তবুও যেন পথ ফুরাচ্ছে না। শায়লাকে নামাতে হবে।বাসার লোকজন ফিরে এলে শায়লা সমস্যায় পড়বে।তার দেরির জন্যই এই অবস্থাটা হলো।এর মধ্যে আবার
বাইকে তেলও ফুরিয়ে এসেছে।তেলের কাটা নেমে এসেছে। তাই নিকুঞ্জ পেট্রোল পাম্পে একটু থামতে হলো।ছুটির দিন। মানুষ যে যেভাবে পেরেছে ঘর থেকে বেরিয়েছে।পেট্রোল পাম্প আর সিএনজি গ্যাস পাম্পগুলোতে বেশ ভীড়। দীর্ঘ লাইন। যদিও বাইকের তেল ভরতে খুব একটা সময় লাগে না। শায়লা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো।শিহাবের সংস্পর্শে সময়টা ভালো কাটলেও বাড়ি ফেরার উৎকন্ঠায় শায়লা বারবার চুপসে যাচ্ছে।এতক্ষনে মা ফিরে এলে তাকে কী বলবে? শিহাব এক নজর শায়লাকে দেখে নিলো।গ্যাস স্টেশনের ফ্লাড লাইটে শায়লা যেন উজ্জ্বলতায় ফুটে আছে! শায়লার চোখে চোখ পড়তেই শিহাব হেসে ফেললো। শায়লা লাজুকতায় চোখ নামালো। তেলের বিল মিটিয়ে আবার দুজনের ছুটে চলা। খুব দ্রুতই শায়লায় বাসার কাছাকাছি চলে এলো।শায়লা চাইছিল শিহাব তাকে বাসার ধারে কাছে কোথাও নামিয়ে দিক।কিন্তু রাত হয়ে গেছে শায়লাকে পথে নামানো ঠিক হবে না।শিহাব শায়লাদের বাসার গেটে এসে বাইক থামালো।শায়লা নামতেই শিহাব পিছন ঘুরে বিদায় জানালো।হেলমেটে ঢাকা মুখখানি আর দেখা হলো না। আজ শিহাবকে খুবই সুন্দর লেগেছে।শায়লা এক ঝলক আজকের শিহাবকে ভেবে নিলো। পিছন ঘুরে বাড়ির গেটে ঢুকতেই একটা রিকশা এসে থামল।
রিকশায় নিচতলার রুহী খালা।বেশ অনেককিছু কেনাকাটা করে রিকশা ভরপুর।শায়লাকে বাইক থেকে নামতে দেখে সে যেন বিস্ময়ে ফেটে পড়লো!শায়লার সাজগোজ দেখেও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। শায়লা না দেখার ভঙ্গীতে গেটের ভিতর ঢুকল।রুহী খালা যেন রিকশা থেকে নামতেই ভুলে গেছে।শায়লা খুব দ্রুত দোতালায় উঠে এলো।বাসায় ঢুকেতো আবার মাকে ফেস করতে হবে। রুহী খালাতো যা দেখার দেখেই নিলো।মাকে তো অস্থির করে তুলবে। আর এ খবর কানাডায় পৌছুতেও সময় লাগবে না।এখন রাহাতই ভরসা এই বিপদ থেকে বাঁচানোর। শায়লা সিড়ি ভেঙে দোতালায় উঠে এলো। কলিং বেল দিয়ে শায়লা অপেক্ষায় রইল।নাহ,কেউ খুলছে না,ভিতরে আলোও দেখা যাচ্ছে না।তাহলে রাহাত মা এখনো ফিরেনি! যাক বাঁচা গেলো।শায়লা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। ঘরের সব বাতি জ্বালিয়ে রাহাতকে কল দিলো।রাহাত কল ধরতেই শায়লা জানালো, তোমরা কোথায়? আমি এই এলাম।
রাহাত ঘড়ি দেখলো রাত আটটা বাজছে।
তোমরা কখন ফিরবে?
আমরা রাতের খাবার খেয়ে ফিরবো। ওরা কিছুতেই ছাড়ছে না।মোর্শেদ খুব করে বলছে,তাই ডিনার সেরেই ফিরবো।ঠিক আছে বলে শায়লা কল কেটে দিলো।
প্রচন্ড ক্লান্তি আর সাথে কেমন যেন একটা ভালো লাগা! এখনো শিহাবের স্পর্শ এর অনুভব শরীরে লেগে আছে।শায়লা শিহরিত হলো।নিজের রুমে ঢুকে মোবাইলে বেশ কয়েকটা সেল্ফি তুলে নিলো।শাড়িটির রঙ আজ চমৎকার লেগেছে! শায়লা হাতের ব্রেসলেটটা কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলো।হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে শিহাবকে ভেবে ছোট্ট করে চুমু খেলো। আবেশে চোখ বুজে এলো! যেন শিহাব তাকে ছুঁয়ে আছে। শায়লা ব্রেসলেটটি খুলে আলমারীতে যত্ন করে তুলে রাখলো। নিজেকে ফ্রেশ করায় ব্যস্ত হলো।
শিহাব আর কোথাও বাইক না থামিয়ে সরাসরি বাসায় ফিরলো। ঘরে ঢুকে কাপড় না ছেড়ে একেবারে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। বাইক চালানো ভীষণ রক হেক্টিকের কাজ! উফ! আর পিছবে যদি মহিলা থাকে তবেতো সতর্কতা আরো বেশী!
শিহাব ভাবলো,শায়লাকে একটা কল দেয়া দরকার।বাসায় কী অবস্থা হলো। মা কিভাবে ব্যাপারটা নিলো।শিহাব কল দিলো।শায়লা খুব করে জানত শিহাব কল করবে। সে চট করে কলটি ধরলো।শিহাব জানতে চাইল, বাসার কী অবস্থা?
অবস্থা ভাল।মা আর রাহাত ফিরেনি। ওরা রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়বে না।
আমি নিজেই ঘরে ঢুকলাম।
শিহাবের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো! ভীষণ টেনশনে হচ্ছিল।যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো।
কী করছো শায়লা?
এইতো ফ্রেশ হবো।তুমি?
আমি বিছানায় ক্লান্তি দূর করছি।শায়লা আজ আমার নিজেকে অন্যরকম লাগছে।
হু, আমারও।বিশ্বাস হচ্ছে অচেনা একটা মানুষ কেমন করে এতটা আপন হয়ে গেলো! ঠিক আছে। রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিও।
শায়লা আমি কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করবো না।দ্রুতই তারিখ ঠিক করবো তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে আসার। আমার এখন আগের চেয়ে বেশী একা লাগে। তুমি মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েছো।
দুজনেই কেমন যেন স্বপ্নঘোরে বসবাস করছে। কাছে যাওয়ার অপেক্ষা দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
আচ্ছা আমি কবে ঝিগাতলায় যাবো?
এইতো শুক্রবারেই তোমাকে নিয়ে যাবো।এর মাঝে আমি মা আর ভাবীকে তোমার কথা জানাবো।ওরা যেন আরাফকে আগে থেকেই বুঝিয়ে রাখে তোমার মা আসবে।আরাফ এখনো তার নিজের মাকে দেখেনি।কোন ছবিও দেখাইনি আমরা।মনে কোন কষ্টের ছাপ পড়তে দেইনি।তোমাকেই প্রথম মা বলে জানবে।এতদিন ও দাদী আর চাচীর নাঝেই মায়ের স্পর্শ পেয়েছে। আমার সাত রাজার ধন আরাফকে কখনো পর করো না।
শায়লা নিজের সাথে নিযে বোঝাপড়া করে নিলো। সে ভেতরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো আরাফকে সে নিজের সন্তানের মতই দেখবে।
তুমি ভেবোনা।আরাফকে আমি মায়ের ভালবাসা শাসনে বড় করে তুলবো।
দরজায় কলিংবেল! শায়লা শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিলো।ডোর ভিউয়ার দিয়ে দেখল দরজায় রাহাত আর মা দাঁড়িয়ে।
শায়লা দরজা খুলতেই রাহাত বলে উঠলো, আর বলিস না, ওরা না খাইয়ে ছাড়বে না।
আবার গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে গেলো।সাথে দেখো আপু তোমার জন্য কত খাবার পাঠিয়েছে।
শায়লা দেখলো রীতিমত এক টেবিল বোঝাই খাবার! মা নিজের রুমে ঢুকে যেতেই রাহাত শায়লার খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, কী আপু কেমন বেড়ালে? মুভি দেখলে না শুধু ঘুরাঘুরি করলে?
শায়লা বেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,না না কোন মুভি দেখিনি।এমনিতেই গল্প করেছি।
ঠিক আছে না বললে।আমি কালই জেনে নিতে পারবো শিহাব ভাইয়াকে কল করে।ভাইবোন অনাবিল এক আনন্দে পুলকিত হলো।এক অজানা সুন্দর আগামীর হাতছানিতে ভাইবোনের চোখে স্বপ্নের জাল বোনা।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much