০৬ ডিসেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ /২৪




শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ২৪)
শামীমা আহমেদ 

সকালে চায়ের মগ হাতে নিয়ে শায়লা বারান্দায় চলে এলো।অনেকদিন শায়লার বারান্দায় আসা হয় না। বারান্দায়  একটা দোলনা বাঁধা আছে। সেখানে বসে দোল খেতে খেতে চা পান করতে শায়লার খুবই ভালই লাগে।শীত আসি আসি করছে। সকালের ঠান্ডা বাতাসটা শায়লার ভালো লাগলেও,শীতের শুরুতে শায়লার অসুস্থ হওয়ার জন্য অনেকটাই দায়ী। একেবারে জ্বর বাঁধিয়ে শয্যাশায়ী হবার উপক্রম হয়। শায়লা হালকা চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। 
শায়লার বাবা শহীদুল হক সাহেব খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। বারান্দায় দোলনা লাগিয়ে বলেছিলেন আমার তিন প্রজন্মের জন্য আনন্দের খোরাক করে দিলাম।কিন্ত সে তার দুই  প্রজন্মই দেখতে পেলো না। তিন প্রজন্মতো দূরের কথা। শায়লার মায়ের নামে বাড়িটির নাম রাখা হলো "লায়লা ভিলা"।বাবা বলতেন, খুব বেশি নয় আমার তিনসন্তানের জন্য তিনতলার বাড়ি বানাবো আর ছাদে থাকবে ফল ফুল আর ওষুধী গাছের চাষ।অবসর জীবনে মাকে নিয়ে সময় কাটাবেন। শহীদুল সাহেব প্রায়ই বলতেন তিনতলা বাড়ি বানালেও আমি আমার বড় মেয়ের সাথে নীচ তলাতেই থাকবো। কতইনা স্বপ্ন আশা সাধ নিয়ে মানুষ বাঁচতে চায়! কিন্তু নিয়তি যে তার গন্তব্য আগে থেকেই ঠিক করে রাখে। মোবাইলটা দোলনায় রেখে শায়লা উঠে দাঁড়ালো। শায়লাদের বাসার সাথে মাঝারি মাপের একটি রাস্তা চলে গেছে। শায়লাদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি একসময় একটা দোতলা বাড়ি ছিল।একজন সচিব বাড়িটি বানিয়েছিলেন। আজ দোতলা বাড়িটি ভেঙে দশটলা এপার্টমেন্ট হয়েছে। ছেলেমেয়েরা দেশে বিদেশে থাকলেও যার যার পাওনা ফ্ল্যাট বুঝে নিতে একবার করে দেশে এসে ঘুরে যায় আর বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখে যায়।কিন্তু  স্থায়ীভাবে আর দেশে থাকা হয় না। এখনতো আর বাবামায়ের প্রয়োজন  নেই এখন প্রয়োজন ফ্ল্যাট সংখ্যা। 
কাজের বুয়া রেনুর মা হচ্ছে এই সকল তথ্যের সোর্স!দারোয়ান, ছুটা বুয়া আর ড্রাইভাররা সারা এলাকার হাড়ির খবর রাখে।কী জানি শায়লার কথা আবার কোন বাড়িতে বলে বেড়াচ্ছে।শায়লা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে  বাড়িটি দেখে।বাড়িটির নামটিও চমৎকার!  স্বপ্নবাড়ি! সেইতো নিজের একটা বাড়ির মালিক হবার স্বপ্ন কার না থাকে! বাড়িটির নিয়মকানুন বেশ কড়া। দারোয়ানকে অবহিত করে আর ইন্টারকমে পূর্ণ পরিচয় রেখে তবেই বাড়িটিতে ঢোকা যায়।
মেসেজের শব্দ হলো। শায়লা ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে নিলো। শিহাবের মেসেজ।  শায়লা ফোনটা হাতে তুলে নিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লেখার দিকে তাকালো।
আজ একটু দূরে  যাচ্ছি।  ফিরতে দেরী হবে।
ইচ্ছে হলে মেসেজ রাখবেন। 
আর এর সাথে সাথেই শিহাব অফলাইন হয়ে গেলেন।
শায়লা ভেবে পায়না কী মেসেজ রাখবে! আর মেসেজ রেখে কীইবা হবে? শিহাবতো নিজের অবস্থান থেকে একটুও টলবে না। তবে কেন শায়লার মেসেজের প্রত্যাশা?যাক না তার যেখানে ইচ্ছে সেখানে, যত দূর ইচ্ছে ততদূর। মিছিমিছি কেন শায়লার মনে আশার বীজ বোনা। রাগে অভিমানে শায়লার চোখ দুটো জলে ভরে গেলো। শিহাবের প্রোফাইল পিকটা লার্জ করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।হঠাৎ শায়লার মনে হলো ছবিটি কথা বলে উঠল!  আমি আছি তো!
কিন্তু শায়লা বিড়বিড় করে বললো, মিথ্যা,  সব মিথ্যা। আমার জীবনে তোমার আসার কোন প্রয়োজন ছিল না। 

শিহাব তার বাইক নিয়ে ছুটছে। দুপুরের মধ্যে তাকে গ্রামে পৌঁছাতে হবে।মায়ের নির্দেশে গ্রামে খালাকে দেখতে যাওয়া।আজ রাতে খালার অপারেশন। গ্রামের হাসপাতালেও আজকাল সার্জারির ব্যবস্থা বেশ ভালোই। ঢাকা থেকে বড় সার্জনরা যায়। যদিও শিহাবের মা অনেক চেয়েছিল তার বোনকে ঢাকায় এনে অপারেশনটি করিয়ে দিতে। খালার কোন ছেলে নেই কিন্তু খালার মেয়েরা মাকে শহরে পাঠাতে রাজী নয়। তারা বাড়িতে থেকেই মায়ের সেবাযত্ন করবে।  তবুও ছেলে নেই, ছেলে নেই বলে  মানুষের কেন  যে এত দুঃখ! 
শিহাবদের পরিবার সবসময় আত্মীয় স্বজনের পাশে থাকে। আর্থিকভাবে শিহাবের পরিবার বেশ স্বচ্ছল।তাইতো স্বজনদের যে কোন সহযোগিতায় তারা এগিয়ে যায় বললে ভুল হবে একেবারে রীতিমতো ছুটে যায়,ঝাপিয়ে পড়ে।শুধু  টাকা পাঠিয়ে দেয়াটাকে তারা মনে করে আত্মীয়কে অপমান করা। তাইতো নিজেরা উপস্থিত থেকে  অপারেশন শেষে নিজের হাতে বিলের টাকা দিয়ে আসবে। আনুসঙ্গিক যাবতীয়  খরচ বহন করবে। শিহাবের মায়ের এটা বহুদিনের অভ্যাস।  আল্লাহর রহমতে তাদের টাকার অভাব নেই।বড় ছেলে শাহেদ না হলেও শিহাব মায়ের নির্দেশ পালনে শুধু হুকুমের অপেক্ষায়। 
শহুরে ভাইয়ের আগমনে গ্রামে তাকে যত্নের সর্বোচ্চ  আয়োজন চলছে। শিহাব এগুলো বেশ এনজয় করে। আতিথেয়তা আর সাথে মনের আবেগ উচ্ছাস মেশানো আন্তরিকতা আজ শুধু গ্রামেই সীমাবদ্ধ। শহরে আজ অন্য কালচার ঢুকে গেছে। রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে  মিট করে চলে আত্মীয়স্বজনের গেট টুগেদার।সবাই কাজিন্স। মামাতো চাচাতো খালাতো ফুপাতো ভাইবোন আর আলাদা নেই।মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে ভিডিও কলে চ্যাটিং করে রক্তের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। আর পিতা মাতার স্ট্যাটাসের  বৈষম্যের সাথে তাদের সম্পর্কেও থাকে টানাপোড়েন। 
শিহাব একটানা অনেকদূর বাইক চালিয়ে গ্রামে একটা চায়ের দোকানে থামল। এইপথ দিয়ে ছোটবেলায় বাবামায়ের সাথে কত গিয়েছে! তারপর একসময় শহরে স্থায়ী  হওয়া।তবুও গ্রামের সাথে নাড়ীর বন্ধন।তাইতো সুযোগ পেলেই চলে আসা। শিহাব এককাপ চা অর্ডার করে একটা বেনসন ধরালো। বেশ অনেকটা পথ এসেছে। একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। শিহাব পরম মমতায় তার বাইকটিকে হাত বুলিয়ে নিলো। শিহাবের একটি পরম বন্ধু। যে শত অবদানেও কোন প্রতিদান চায়না।
শিহাব অনলাইন হলো।মেসেঞ্জারে ইন করলো। নাহ! শায়লার কোন মেসেজ নেই।
শিহাবের  মনে কোথায় যেন একটা ছন্দপতন হলো।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much