ইউএন মিশন হাইতিতে গমন
( ৮ম পর্ব )
মোঃ হাবিবুর রহমান
সার্জেন্ট এসেই শুভেচ্ছা জানিয়ে তার ব্যক্তিগত ফিরিস্তি তুলে ধরলো এবং সে যে দায়িত্বপ্রাপ্ত হ'য়ে গন্তব্যস্হল পোর্টোরিকো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পর্যন্ত আমাদেরকে দেখভাল ক'রবে সে কথাটা এক নিঃশ্বাসে জানিয়েই আমাদেরকে সাথে সাথে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে জানতে চাইলো যে, আমাদের তরফ থেকে তার নিকট এমূহুর্তে কোন জিজ্ঞাস্য আছে কিনা? আমরা কোন রকম অযথা বাক্য ব্যয় না ক'রে শুধুমাত্র তার দরাজ গলার ছোটো-খাটো একটা বক্তৃতা কানে শ্রবণ ক'রলাম মাত্র।
বলাবাহুল্য, ভূ-পৃষ্ঠ হ'তে এই ৪০ হাজার ফুট উপরে এমআরই (MRE)এর কিন্তু অভাব নেই। ভাল না লাগলেও খেতে হ'চ্ছিল কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে জল্লাদ ও চামার ব্যক্তিটিকে মানানো গেলেও দেহের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ পেট নামক চামড়ার যন্ত্রটিকে অদ্যাবধি কেউ তার ক্ষুধা নামক একমাত্র চাহিদাটি পূরণ না ক'রে এই সুন্দর দুনিয়ায় দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি।
পানি আর কতক্ষণ খেয়ে থাকা যায়? তাই আবার এমআরই এর দিকে নজর গেলো। কিন্তু এমআরই এর প্যাকেট খুলে গলাধকরণের বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে নিজের নিতান্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যেন খাওয়া শুরু ক'রলাম। তবে এটা ঠিক যতদূর এমূহুর্তে মনে প'ড়ছে, প্রতি প্যাকেটে মোট ১৪/১৫ টি আইটেমের মধ্যে ৪/৫ আইটেম খুবই সুস্বাদু ছিলো। এসবগুলোর কথা এখনও মনে হ'লে চিহ্বায় পানি এসে যায়।
বিশেষ ক'রে ক্যাশিও নাট' চকলেট, বিন, কোকো চকলেট, সুগার বার, মিল্কশেক এবং বিভিন্ন উপাদান মিশ্রিত বিস্কুট বড্ডই উপাদেয় ছিল যা এখন না খেয়েও এ মূহুর্তে ভাবতেও যেনো বেশ ভালই লাগছে। যেন এভাবে বলা যায় যে, খেলামই না কিন্তু লাগলো ভালো।
শুধু এক জায়গাতেই ভয়, সেটা হলো পর্ক প্যাকেট না বিফ প্যাকেট? এটা প্যাকেটের গায়ে যদিও ভালভাবে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা থাকে তবুও ভালমত পর্যবেক্ষণ তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক'রে একদম শতভাগ নিশ্চিৎ হ'য়েই সাহস ক'রে প্যাকেটের গায়ে হাত স্পর্শ করা লাগে। মনে মনে অনেক ভাবনা-চিন্তা করার পর বার বারই মনে হ'য়েছে যে, আর যাই হোক বাঙ্গালীদের মত নিঃশ্চয় মার্কিনীরা কোন ভেজাল খাওয়াবেনা, তারপরেও মানুষের মনতো? কি জানি বাপু, যদি ভুলক্রমে বিফের প্যাকেটে পর্ক ঢুকেই যায়? তবে বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আর তাই কথায় বলে না "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর"।
তাই বিশ্বাস করেই মার্কিনীদের তৈরী প্রোডাক্ট একমাত্র এমআরই খেয়েই ব'লতে পারেন, নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ ও নৌশভোজের চাহিদা পূরণ ক'রেছিলাম। ইতিমধ্যেই সবার মাঝে রাষ্ট্র হ'য়ে গেছে যে, আগামী এক মাস নাকি আমরা ভাতের মুখ দেখতে পারবো না। ভাবলাম, কি বলে? পাগলের কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমরা বঙ্গ দেশের মানুষ, ভাত ছাড়া কি বাঙালী বাঁচে?
এমনিতেই আপনজনদের ছেড়ে চ'লেছি হাজার হাজার মাইল দূরে যেন এক অচীনপুরে, পাকা এক বছর যেন বনবাসে থাকার মন মানসিকতা নিয়ে, আর এর ভিতরে এক মাস যাবৎ ভাত না পাবার খবরটা যোগ হ'য়ে এখন যেন সমগ্র মন খারাপের যোগফলের সমষ্টি প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছে গেলো। এ যেন "মরার উপর খাড়ার ঘা"। পরবর্তী থাপে পোর্টোরিকোয় ১৫ দিনের বসবাসকালীন সময় আমার মত অনেক ভেতো বাঙালীর কি হাল হয়েছিলো সেই চিত্র আমি কিছুটা চিত্রায়িত করার চেষ্টা ক'রবো ইনশাল্লাহ্। বোধ করি এক মাস ভাতবিহীন বাঙালীর কষ্টটা আপনারা কিছুটা হ'লেও তখন উপলব্দ্ধি ক'রতে পারবেন।
"সময় তো বহতা নদীর মত", আবার সিংহভাগ লোকের কাছে "সময় ও নদীর স্রোত এ দু'টিই নাকি কানো জন্যেই অপেক্ষা করে না"। তাই এত কিছু শুনে বা জেনে আমার এখন সময়ের কাছেই জানতে ই'চ্ছে করে, হে ভাই সময় নামের অমূল্য রত্ন, আপনি নিজে কারও জন্য অপেক্ষা করেন না ঠিক আছে কিন্তু আপনি আপনার নিজ প্রয়োজনের জন্যও কি একটু অপেক্ষা ক'রতে পারেন না? আসলে দেখতে দেখতে প্রায় এরই মধ্যে দশ ঘণ্টা পার হ'য়ে গেছে। স্হানীয় সময় যতটা মনে পড়ে তখন দুপুর বুঝি সাড়ে বারো থেকে একটার মত বেজেছিল।
সি-৫ তখনও সমগতিতে চ'লছে ও একই উচ্চতায় বাতাসে ভেসে ভেসে পোর্টোরিকোর দেশে শো-শো ক'রে এগিয়ে চ'লেছে। মাঝে মাঝে শুন্যে পথ চলার সময় বহুবারই প্রিয় ধরণীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছি আর আমরা কখন ঠিক কোন মুল্লুকে পৌঁছালাম কিংবা কোন সাগর বা মহাসাগর অথবা বীর দর্পে কোন পর্বতমালায় মাথার উপর দিয়ে উড়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছি সেটা জরীপ ক'রে ফেলেছি।
মাঝে মাঝে প্লেইনের মনিটরে সেগুলো কড়ায়-গন্ডায় হিসেব মিলিয়েছি। বহুবারই ভেবেছি, হে সুন্দর ধরণী তোমাকে বহুঘণ্টা ধরেই একটানা মিস ক'রছি, জানতে চেয়েছি তোমার সন্তানেরা আদম সন্তান খ্যাত ওরফে মনুষ্যজাতি এখন ধরায় ঠিক কেমন আছে, কি করছে? এভাবে আবার বহুবার অক্ষিদ্বয়ের দৃষ্টি নিবন্ধিত হ'য়েছে আকাশের গায়ে জমে থাকা প্যাঁচানো তুলাসম মেঘের ভেলায় যদিও অধিকাংশ দৃষ্টিবানই ছিলো আমার সোজাসোজি ধরায়, যার কৃতিত্ব ছিল যেন পুরাটাই সেদিনকার পরিস্কার আবহাওয়ার।
এরই মধ্যে সিটবেল্ট বাধার কড়া নির্দেশ আসলো পাইলটের পক্ষ থেকে। মনিটরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিতেই দেখি আকাশতরীর গতি ঘন্টায় ১,০০০ কিঃমিঃ এর নীচে নেমে এসেছে, অল্টিচ্যুডও ঘন্টায় ২৫,০০০ এর নীচে নেমেছে, বুঝতে আর বাকী থাকলো না যে, আমাদের সেই কাঙ্খিত অচীনপুরের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হা, যেটা বলবো বলবো করে বলাই হয়নি-ঐ সেই পাসপোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের বাঙালী সার্জেন্ট কখন যেন ভু ক'রে এসে ছো-মেরে আমাদের সব পাসপোর্টগুলো নিমিষের মধ্যেই জব্দ ক'রে নিয়ে গেছে।
যাহোক, সি-৫ এর এমন ধীর গতি দেখে বিস্মিত হ'য়ে আবার দৃষ্টি দিলাম ভূ-পৃষ্ঠের দিকে। বসতবাড়ি, ভবন, অট্টালিকা কিংবা সৃষ্টির সেরা মানুষগুলো একেবারে লিলিপুটের মত দৃশ্যমান হ'তে থাকলো। সি-৫, এরই মধ্যে তার সামনের ঠ্যাং নামিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ মনিটর দেখি আবার বাস্তবের মিল খুঁজি-ঠিক এমনিভাবেই অবশেষে আমরা পোর্টোরিকোর মাটি স্পর্শ ক'রলাম।
১৯৯৪ সনের ০৬ সেপ্টেম্বর বেলা ঠিক দশটা বাজে বাংলার রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে রওয়ানা দিয়ে আমরা একই তারিখ স্হানীয় সময় দুপুর আড়াইটা কিংবা বিকাল তিনটার দিকে আমাদের একান্ত কাঙ্খিত গন্তব্যস্হলে আল্লার ওয়াস্তে সেফ ল্যান্ড ক'রলাম, আলহামদুলিল্লাহ্। এরই মধ্যে বিরতিসহ আমরা ৩৮ ঘণ্টাকালের ২৯ ঘন্টাই অন্তরীক্ষে আর বাকী ০৯ ঘন্টাকাল যাত্রাবিরতিতে কাটিয়েছি হাওয়াই দ্বীপে কিন্তু বাস্তবে আমরা সময় হারিয়েছিলাম মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা কিংবা ৫ ঘণ্টার মত। দক্ষ পাইলট এত বড় সি-৫ এর মত শক্তিশালী আকাশযানকে পুরোদস্তুর থামিয়ে দিয়েছেন কিন্তু আমাদের নামার আদেশ তখন অবধি মেলেনি।
চলবে......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much