১৬ ডিসেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ/পর্ব ৩৩





শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত 
( পর্ব ৩৩)
শামীমা আহমেদ 

---বেশ বেলা করেই শিহাব আজ ঘুম থেকে জাগলো।বাইরে রোদ ঝলমল করছে।ছুটির দিন হওয়াতে চারিদিকে গাড়ি চলাচলের শব্দ খুবই কম।ফেরিওয়ালার হাঁকডাক নেই। ওরাও কি তবে ছুটির দিন কাটায়? যদিও রাতে শিহাবের খুব ভালো ঘুম হয়েছে।তবুও আলসেমিতে বিছানা ছাড়া হয়নি।এপাশ ওপাশ করে ঘুমটা কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিয়েছে।
ছুটির দিনের আমেজে তার মাঝে আলসেমি ভর করেছে।নিজেকে কেমন যেন  হালকা পালকের মত লাগছিল।মনের অবস্থাটা বেশ ফুরফুরে। অনেকদিন পর শিহাব  নিজেকে ভারমুক্ত ভাবছে। সে মোবাইলে সময় দেখে নিলো। সকাল সাড়ে দশটা। আজ ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার কথা আছে। যদিও লেবাররা কেউ আজ থাকবে না। ম্যানেজার ফারুখ সাহেবকে আসতে বলা হয়েছে। শিহাব যখন উত্তরা থেকে রওনা হবে তখন ম্যানেজারকে ফ্যাক্টরিতে আসতে বলবে। সে গাজীপুরেই একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে।তার বাড়ি কাপাশিয়ায়।লোকটা বেশ ভালো। খুবই পরিশ্রমী।দুটি বাচ্চা আছে। সে শিহাবকে বেশ সম্মান করে।অবশ্য মালিক বলে কথা! যদিও লোকটি শিহাবের চেয়ে বয়সে বড়ই হবে। হয়তো  শিহাবের জন্য আজ দুপুরে নিজের বাসায় খাওয়ার আয়োজনও করে রাখবে। শিহাবের অনুপস্থিতিতেও ফ্যাক্টরীটা সে বেশ চালিয়ে নিচ্ছে। শিহাব বেশ নিশ্চিন্ত মনেই উত্তরার অফিস দেখে। 
শিহাব কেয়ারটেকার বেলালকে কল দিলো। উপরে আসতে বলে শিহাব বিছানা ছাড়লো।বেলাল এলে একটি পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিলো। এক প্যাকেট বেনসন ও সামনের একটি ভালো হোটেল থেকে নাস্তা আর এক বোতল পানি নিয়ে আসতে বললো। সাথে একবক্স টিসু।
বেলাল নেমে গেলে শিহাব ওয়াশরুম থেকে
ফ্রেশ হয়ে এলো। শিহাব নিজের হাতে চা বানাতে বেশ পছন্দ করে। সে সোজা কিচেনে চলে গেলো।একেবারে ঝকঝকে তকতকে রান্নাঘর।কাজের বুয়া মহিলাটা ভালোই কাজ করে। কেয়ারটেকার বেলালের কাছে ঘরের চাবি দেয়া থাকে।বুয়া এলে খুলে দেয়।কাজ শেষে আবার তালা দিয়ে রাখা হয়। বুয়া শিহাব সম্পর্কে কিছুই জানেনা। বেলালকে তার শুধু একটাই প্রশ্ন সাহেবের বউ কবে আইবো?হে কি বিয়া শাদী করছে?

শিহাব চুলায় চায়ের কেতলি বসিয়ে দ্রুতই একমগ লাল চা বানিয়ে নিলো।শিহাবের নাস্তার আগে গরম চা না হলে সে নাশতা খেতেই পারে না। একট ট্রান্সপারেন্ট মগে চা নিয়ে বেশ আয়েশ করে বিছানার কোনায় বসলো। হাতে টিভি রিমোটটা নিলো।বহুদিন হলো টিভি দেখা হয় না।শিহাব চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে সকাল এগারোটার খবরে এসে থামলো। নিত্য নৈমিত্তিক খবরের পাশাপাশি একটা ছোট্ট খবর শিহাবকে বেশ চিন্তিত করে তুললো। 
"প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তরুণীর আত্মহত্যা।" সাথে বাবা মায়ের গগনবিহারী কান্নায় চারপাশ ভারী হয়ে উঠলো। শিহাবও সেই বাবা মায়ের কান্নাটা ফিল করতে লাগল।সন্তান হারানোর সেকি বেদনা! আর গতানুগতিক খবরের 
সেই একই সারমর্ম।  প্রেমিক ছেলেটি পলাতক।অবশ্যই সে গ্রামের প্রভাবশালী কারো পুত্র।আর এরাতো থানা পুলিশকে কিনে নেয়। 
শিহাব আত্মহত্যার তরুণীটি,যার নাম, রুনা আক্তার, সেই মেয়েটির নিষ্পাপ ভালোবাসাটা অনুভব করলো। কতটাই না সরল বিশ্বাসে সে ছেলেটিকে ভালোবেসেছিল।আর গ্রামে এসব ব্যাপার  একটুও চাপা থাকে না। 

বেলাল নাস্তা নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলে টিসু বক্স, নাস্তা ও গ্লাসে পানি ঢেলে  টেবিল সাজিয়ে দিলো। বিছানার সাইড টেবিলে সিগারেটের প্যাকেট আর বাকী টাকাটা রাখতেই বেলালকে বাকী টাকাটা নিয়ে যেতে বললো বখশিশ হিসেবে আর জানালো বুয়াকে ফোন করে জানিয়ে দিতে যেন আজ না আসে। আমি একটু নিজের মত করে থাকবো। বেলাল জ্বি আচ্ছা বলে নীচে নেমে গেলো।
শিহাব দরজা লাগিয়ে ঘরের দিকে ফিরতেই কেন যেন শায়লার মুখটা ভেসে উঠলো! সে বেশ অবাক হলো।।এতক্ষন  একটুও শায়লার কথা তার মনে পড়েনি! সেকি তবে শায়লাকে ভুলে গেছে। কিন্তু সেতো সম্পর্ক শেষ করেনি। অন্য চাওয়া পাওয়ার অধিকার না রেখে শুধু বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে চেয়েছে। শিহাব কাল থেকে শায়লার আর কোন খোঁজ নেয়নি। এতগুলো কথা হওয়ার পর শায়লার মনে অবস্থাটা কেমন গ্যাছে কে জানে? শিহাবের উচিত ছিল অন্তত ওর একটা  খোঁজ নেয়া মেসেজ বা কল করে বিষয়টা সহজ করা।নাহ! কাজটি ভালো হয়নি।শায়লাতো এতদিন ওর উপর অনেকটা আস্থা আর  নির্ভরতায় মিশেছে। গতকাল কথাগুলোর পর শায়লা কেমনভাবে কথাগুলো নিয়েছে সে প্রতিক্রিয়াটা বুঝে নেয়া উচিত ছিল। শিহাব কেন যেন নিজেকে অপরাধী ভাবছে। সেকি তবে কোন ভুল করলো?কিন্তু না, বাস্তবতার নিরিখে সে সঠিক কাজটিই করেছে।শিহাবের ভেতরে কেমন যেন কাঁটা বিঁধতে লাগল। টিভির খবরে তরুণীটির আত্মহত্যা হয়তো এমন কোন প্রেমের সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করাতেই হয়েছে। শিহাব নিজের ভেতরে নিজেই কথা বলছে,আমিওতো তবে তেমনি একই দোষে দোষী।শিহাব সেই বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকটির সাথে নিজেকে মেলাতে লাগলো।ক্রমন যেন অনুশোচনা বোধ করছে। আচ্ছা গতকালের কথার পর শায়লা যদি এমনি কিছু করে বসে? শি্হাবের প্রতি শায়লার ভালোলাগা ভালবাসাতো শিহাবই জন্মিয়েছে। শায়লাতো তার মত করেই ছিল। শিহাবইতো তাকে স্বপ্ন দেখা শিখিয়েছে। না, ধিহাব নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। খুব ইচ্ছা করছে শায়লার কন্ঠস্বরটা শুনতে।কিন্তু কোন মুখে সে তাকে কল দিবে? নিশ্চয়ই শায়লা একরাশ ঘৃনা নিয়ে শিহাবকে মন থেকে মুছে ফেলেছে।
শিহাবের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো!  ভেতর থেকে এক অদম্য মনের প্রাবল্যে শিহাব নিনেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না,,সে মোবাইল হাতে নিয়ে শায়লাকে মেসেঞ্জারে কল দিলো।কিন্তু শায়লা অফলাইন।নিশ্চয়ই শিহাবের প্রতি অভিমানে 
অফলাইন হয়ে আছে। শিহাব এবার শায়লার নাম্বারে কল দিলো।পরপর তিনবার তিনটি ফুল রিং হলো। সে রিসিভ করলো না।শিহাবের ভেতরে কেমন এক অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল।
এক অজানা আশংকায়  উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলো সে!  সবশেষে চতুর্থ কলে ফোন রিসিভ হলো। শিহাব হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।কে বলছেন?
আমি শিহাব,শায়লার বন্ধু।
ও আচ্ছা, আমি রাহাত শায়লা আপুর ছোটভাই।
শায়লা কোথায়? শিহাবের আর তর সইছে না।
রাহাত জানালো, দুঃখিত আপনার আগের তিনটি কলে ফোনটা ধরতে পারিনি। আমরা হাসপাতালে আপুকে নিয়ে খুব ব্যস্ততা আর উৎকন্ঠিত সময় পার করছি। 
শিহাব যেন ফোনের ভেতর ভেঙে পড়লো! কেন শায়লা কি হয়েছে? আপনারা ওকে হাসপাতালে এনেছেন কেনো?
আপু গতরাতে সেনস্লেস হয়ে যায়।দরজা না  খোলাতে আমরা সকালে বুঝতে পারি অনেক দেরিতে।ছুটির দিন হওয়ায় সবাই বেশ দেরি করে উঠি।আপু ঘুম থেকে না জাগাতে দরজা ভেঙে আপুকে বের করে আনি।
এরপর দ্রুত এম্বুলেন্স ডেকে আপুকে হস্পিটালে নিয়ে আসি।আপুর এখনো জ্ঞান ফিরেনি।স্যালাইন চলছে,,
শিহাবের ভেতরে উথালপাথাল করতে লাগল।গতকাল দুপুরে রেস্টুরেন্টে শায়লার সেই থমথমে মুখ আর চোখ ভরা জল সেই মুখচ্ছবিটি ভেসে উঠলো!বিদায়বেলায় শায়লার অমন আনমনা দৃষ্টিটা মনে হতেই শিহাব যেন কুঁকড়ে গেলো!
উফ! কত বড় ভুল হয়ে গেলো! শিহাব নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগল। 



চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much