উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭০
প্রতারণা
মমতা রায় চৌধুরী
শিশির ভেজা সিক্ত সকাল, সোনালী রোদ্দুর, ঘাসের আলতো নরম ছোঁয়া -এ ভাবনা শহরে হবে না ,শুধু ফ্লাটের ব্যালকনিতে বসে বসেই ভাবা ছাড়া কিছু নয় । রয়েছে শুধু ক্লান্তি, দূষণ ,ব্যস্ততায় মোড়া শহর। সেখানে কোথায় চেনা মানুষের সেই আবেগ জড়ানো কন্ঠ, কোথায় রয়েছে সেই নদীর কুলুকুলু শব্দ ,কোথায় পাওয়া যাবে বিজনে বসে অরন্যের একরাশ সবুজ স্নিগ্ধ ভালোবাসা। তবু এরমধ্যেই থাকা। এই ভাবনার ভেতরেই আলোড়ন তোলে ফোনের রিংটোন'যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা, তোমায় জানাতাম।'
হঠাৎ মনোজ 'রেখা রেখা' বলে ডাকার পরেও সাড়া না দেওয়াতে বারান্দায় এসে রেখার কে ধাক্কা দিয়ে বলল' কি ব্যাপার তুমি শুনতে পাচ্ছ না? তোমাকে ডাকছি।'
রেখা বলল-কেন কি হয়েছে?
মনোজ বলল' তোমার ফোন বাজছে।'
রেখার কানেও আওয়াজটা একবার এসেছে কিন্তু রিংটোনটাতে এতটা নিমগ্ন হয়েছিল যে ,ফোনের কাছে যাবার প্রয়োজন বোধ করে নি।
মনোজ বলল"এ রিংটোন আবার তুমি কবে লাগালে?'
রেখা বলল 'কেন তোমার ভালো লাগছে না?'
মনোজ হেসে বলল' রবি ঠাকুরের গান তো ভালো লাগবেই'।তবে ভাবতে অবাক লাগছে যদি জানতাম তোমার কিসের ব্যথা ,তাহলে তোমায় ব্যথা উপশমের মলম দিতাম।"
রেখা মনোজকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল 'যাও তো সবসময় ইয়ার্কি মেরো না তো।'
মনোজ বলল 'বাহ রে আমি কি খারাপ কথা বললাম ?আ মি তোমার স্বামী । আমার দায়িত্ব নেই।'
রেখা বলল' তা বেশ মহাশয়, সে দায়িত্ব পালন ক'রো,আগে তো নিজে পুরোপুরি সুস্থ হও ।তবে তো?'
এর মধ্যে আবার ফোন বেজে উঠল'জানতেম আমার কিসের ব্যথা....?'
রেখা বলল 'না ,দেখি কে ফোনটা করছে?'
রেখা ফোনটা রিসিভ করল বলল 'হ্যালো'।
অপরপ্রান্ত থেকে এক ভদ্রমহিলা এক ভদ্রমহিলা বললেন ' কিরে ননী কোথায় ছিলিস মা?এতবার ফোন করলাম?'
রেখা বল ল 'একটু ব্যস্ত ছিলাম কাকিমা।
তোমরা সবাই ভালো আছো তো?'
রেখার কাকিমা বললেন' হ্যাঁ ভালো আছি। শুধু তোর কাকার একটু ঠান্ডা লেগেছে।'
রেখা উদ্বেগ কন্ঠে বলল 'সে কি! কাশি হচ্ছে নাকি কাকুর?'
ফাতিমা বললেন অত চিন্তা করতে হবে না ওষুধ খাওয়াচ্ছি।
রেখা বলল 'তা হলেও।'
কাকিমা বললেন তোকে একটা খবর দেবের আছে।
খবর জায়গার নাম শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠল কার কি হলো?
ঠাকুরমা বললেন'আমাদের গ্রামে বিপাশার কথা মনে আছে?'
রেখা বললো 'মনে থাকবে না।
ওই তো আমাকে ফোন করে বলেছিল তোমাদের কথা যে একবার গিয়ে দেখা করে আসা উচিত।'
কাকিমা বললেন 'মেয়েটা কত ভাল ,মেয়েটার কত কোয়ালিটি ছিল। বিয়ের পর থেকে ওর বাড়িতে ওকে নিয়ে ঝামেলা লেগেই রয়েছে। শুনেছি ওর স্বামী দীপক সুচারু নয়।'
রেখা বলল-কেন কি হয়েছে কাকিমা?'
কাকিমা বললেন' কি বলবো আর বল মেয়েটি যেমনি শান্তস্বভাব, তেমনি চরিত্রে আবার কোয়ালিটিও ছিল প্রচুর।'
রেখা বলল 'সে তো আমি জানি? কিন্তু তুমি আজ হঠাৎ ওর কথা বলছ ?ওর কিছু খবর দিতে চাইছো আমার কাছে?'
কাকিমা বললেন' ' একদমই ঠিক।'
রেখা বলল " কি হয়েছে?'
কাকিমা বললেন 'আরে' ওর স্বামী চাকরি পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা কেসে ফেসেছে।'
রেখা বলল ''সে কিগো?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ রে পেপারে নাম বেরিয়েছে।'
রেখা বললো 'কোথায় চাকরি দিতে চেয়েছে?'
কাকিমা বললেন 'আরে আইআরসিটিসি তে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা করেছে।'
রেখা বলল 'কাকে চাকরি দিতে চেয়েছিল?'
কাকিমা বললেন হাবরার বাসিন্দা এ ,আলী মন্ডল এর অভিযোগ।
রেখা বলল' কি সাংঘাতিক গো কাকিমা?
কত টাকা নিয়েছিল?'
কাকিমা বললেন'ওই তো এ আলীর কাছ থেকে 58 হাজার টাকা নিয়েছে।
রেখা বলল 'তা কি করে বুঝলে যে ,ওই লোকটাই হচ্ছে প্রতারক?'
কাকিমা বললেন 'দাবিমতো টাকা দেয়ার পরও চাকরি না হয় এ আলী বুঝতে পারেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
রেখা বলল' কি বলছ এ সব কথা?'
কাকিমা বললেন ' চলতি মাসে টাকা দেয়ার পরও চাকরি না হ ওয়ায় এ. আলী বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন?'
রেখা বলল 'ভাবতেই পারছি না গো?'
কাকিমা বললেন 'জানিস ননী।এমনকি অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ,একসময় মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে দেয়।'
রেখা বলল' কি সাংঘাতিক ব্যাপার গো?'
কাকিমা বললেন 'তা ছাড়া আর কি বলি বল তো মেয়েটা এসেছিল ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না'
রেখা বলল ' সে তো স্বাভাবিক যে মানুষটার সঙ্গে এতদিন ঘর করল।তার মনের খবর বোঝা গেল না।'
কাকিমা বললেন' চলতি মাসের 22 তারিখ নাগাদ এ .আলি মুচিপাড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ।যার ভিত্তিতে 22 অক্টোবর মুচিপাড়া থানার পুলিশ প্রতারণার মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করে।
রেখা বলল ' তারপর কি হয়েছে গো কাকিমা? কিছু জানলে?'
কাকিমা বললেন'শুধু' আইআরসিটিসি তে নয়'?
রেখা বলল তাহলে?
কাকিমা বললেন 'সম্প্রতি কলকাতায় মেট্রো রেলে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।'
রেখা বলল' কি অবাক কান্ড বল?
রেখা বলল 'এখন ও কি করবে?ওর স্বামী যখন জেল হেফাজতে।'
কাকিমা বললেন'সেটাই তো।'
রেখা বলল 'ওর কয় ছেলে মেয়ে?'
কাকিমা বললেন 'ওর মেয়ে নেই, ওর দুই ছেলে। ছেলে দুটো কি সুন্দর দেখতে জানিস তো?'
রেখা বলল 'তাই?
কাকিম বললেন হ্যাঁ রে ,গ্রামে যখন আসে একবারের হলেও,আমার সঙ্গে হলেও দেখা করে যায় ।আর তোর কথা খুব জিজ্ঞেস করে?'
রেখা বলল 'ভাবো কি ভালো মনের মেয়ে' তার কপালে এই? '
কাকিমা বললেন ' সেটাই তো দেখছি?'
রেখা বলল ' প্রতারকদের শাস্তি হওয়া উচিত ।'
কাকিমা বললেন 'সে তো ১00 বার। শুধু ভাবছি মেয়েটার কথা কি অথৈ জলে পড়ে গেল।'
রেখা বলল' আমি যতটুকু বিপাশাকে চিনি কাকিমা , তাতে দেখেছি ওর যা মনের জোর ,আর ওর মা
কোয়ালিটি আছে ও দেখবে ঠিক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।'
কাকিমা মা বললেন' ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি, ও যেন সব সামলে উঠতে পারে।'
রেখা বললো "ভালো দে সং কিছু হতে পারে না। বরং আঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে আরও মনের জোর তাকে বাড়িয়ে দেয় ,তাকে শক্ত করে।'
কাকিমা বললেন 'ননী, তুই আবার কবে আসবি মা?'
রেখা বলল "ও একটু সুস্থ হোক। তারপর যাব কাকিমা ।তোমরা বরংএকদিন এসে ঘুরে যাও ।ভালো লাগবে টানা এক জায়গায় থাকো তো?''
কাকিমা বললেন" হ্যাঁ ,আমাদের আর যাওয়া রে।"
রেখা বলল" কেন তোমরা কি মেয়ের বাড়িতে আসতে পারো না?"
কাকিমা বললেন 'ঠিক আছে রে ননী ,রাখছি ।ওই দেখ ,তোর কাকা ও ঘর থেকে ডাকছে ,কিছু লাগবে বোধহয় ।ঠিক আছে ।ভালো থাকিস মা।'
কাকিমার ফোনটা কাটার পর রেখা ভাবতে লাগল সত্যি আজব শহর। শহরে চলে প্রতারণা- পেশা নিয়ে ,মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে, প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ,মাতৃত্ব নিয়ে ,পিতা মাতাকে নিয়ে, আরো কত কিছু আছে এই শহরে। আজকাল বোধহয় এই শহরের ঢেউ গ্রামেতেও আছড়ে পড়ছে।'
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল যা মিলিদের খাবারটা তো দেয়া হয় নি। যাই একবার বাচ্চাগুলোকে আদর করে আসি ,খাবারটাও খাইয়ে আসি । আর সোনালী দিনের আশায় এইভাবেই দিনগুনে চলি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much