শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৩১)
শামীমা আহমেদ
একটি বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত ও বিষন্ন মন নিয়ে শিহাব আজ ঘরে ফিরলো। জরুরী কাজটি সেরে গুলশান থেকে আবার অফিসে ফিরে, জমে থাকা হাতের কাজগুলো গুছিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা হয়ে গেলো।ঘরে ঢুকে শিহাব বেশ ক্লান্ত বোধ করছিল। আসলে মনের সাথে শরীরের একটা যোগ থাকে। মন ভালো না থাকলে নিজের শরীরটাকেও ভীষণ ভারী মনে হয়। শিহাব ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজাটা সচেতন ভাবেই লাগিয়ে নিলো যেন আবার ভুল না হয়। ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এসি রিমোটটা হাতে নিয়ে আঠারোতে সেট করে নিলো। শীতল পরশে যদি মনের অস্থিরতাটা একটু কমে।আজ দুপুরে শায়লাকে বলা কথাগুলো, শায়লার থমথমে বিষন্ন মুখখানি আর সবশেষে তার চলে যাওয়া শিহাবের বুকের ভেতর জমাট এক ব্যথা হয়ে বারবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। যদিও বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারবে না তার ভেতরে কী লু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। বারবার ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছে শায়লার চোখের জলের সেই কান্নার ঢেউ। বারবার শায়লার মেরুন শাড়ির রংটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। শায়লা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছিল। হয়তো শিহাবকে ভেবেই আজ শায়লাকে এত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। তার কল্পনার স্বপ্ন রাজ্য সে শিহাবকে নিয়েই সাজিয়েছে।হয়তো সে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি এত চেনা শিহাব আজ এতটা দুরত্ব নেয়ার কথা বলবে।মনে হয় মূহুর্তেই তার ভেতরের সবকিছু উলোট পালোট হয়ে গেছে। আজ ফোন কল মিস হওয়াতে কতটাইনা আফসোসে সে ভেঙে পড়লো। সেদিন শিহাবের জ্বরের কথা শুনে কেমন অস্থিরতায় ভুগেছে।শায়লার মনের প্রতিটি ভাবনার আকাশে শুধুই শিহাবের বসবাস। শিহাব এটা ভালো করেই জানে শায়লার মত করে কেউ তাকে এতটা বুঝেনি।তার সুখ দুখটাকে এমন করে অনুভবে নেয়নি। ভালবাসাতো শুধু একজন মানুষকে ভালবাসা নয়।ভালবাসাতাতো শুধু তার রূপ সৌন্দর্যকে নয় বরং তার সুখ দুখ, তার পারিবারিক অব্লিগেশন প্রায়োরিটি ইম্পর্টেন্স এমারজেন্সি সেগুলোকেও ভালবাসতে হয়। শায়লা নিজেদের পিতৃহীন সংসারে এটা ভীষণভাবে বুঝে গেছে যে, দুঃখটাকে ভালবাসলে দুঃখ দৌড়ে পালায়। আর সুখকে যত ভালবাসবে সে শুধু পালাতেই চাইবে।তাইতো শিহাবের সব রকম কষ্টকে সে অনুভব করেছে। শিহাবকে নিয়ে চোখে মুখে তার একরাশ তৃপ্তি খেলে যায়!!
শিহাবের ফোন কলের অপেক্ষায় সে থাকে।শিহাবের কন্ঠস্বর শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে।শিহাবকে একনজর দেখার জন্য তার প্রোফাইল পিক এ বারবার যেন তাকেই খুঁজে ফিরে। শিহাব সব বুঝেও নিজেকে, নিজের আবেগকে চেপে রাখে শুধুই তার পিছুটানের কারণে।শায়লা সেটাও ভীষণ করে বুঝে। তবে এ কথাও শিহাবকে স্বীকার করে নিতে হবে ,কত মানুষ সারা জীবন সাধনা করেও এমন হৃদয়ের কাছাকাছি একটা মানুষের সন্ধান পায়না। আর সে শায়লাকে এত কাছে পেয়েও দূরে ঠেলে দিল।তবে শিহাব এভাবে শায়লার মন ভেঙে দিতে চায়নি কিন্তু শায়লা যা ভাবছে তাতো একটা অসম্ভব ভাবনা। অবশ্য শায়লা একা না, সেও কি এমনি করে ভাবেনি? সেও কি কল্পনায় তার ঘরে শায়লার চলাচল দেখেনি! আজ যা অসম্ভব সাহসিকতায় জয় করে নিলে একসময় তা সম্ভব করা যায়। কিন্তু সেখানে বিধাতার সায় থাকতে হবে।সবকিছুতো তিনিই ঘটান। নয়তো রিশতিনার সাথে কেন তার এত অল্প সময়ের জীবন আর কেনইবা রিশতিনা তাদের স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়ে শিহাবকে বন্ধনে বেঁধে গেছে।শিহাব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না উপরওয়ালার এই খেলার মানে।আর সেটা সম্ভবও নয়।আর তাইতো এমন কঠোর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে নিজেকে ফিরিয়ে আনা।
শিহাব নিজের মাঝে ফিরে এলো।নাহ! উঠতে হবে।নয়তো এভাবেই ঘুমিয়ে পড়বে।
শিহাব উঠে বসে একটা স্টিক ধরিয়ে নিলো।
হাতে ফোনটা এগিয়ে নিলো। মায়ের মিসড কল। শিহাব সময়টা দেখে নিলো। দুপুর চারটার দিকে।আহ! তখন সে বাইক চালাচ্ছিল।মাকে কল ব্যাক করা হলোনা। এখন আর সময়ও নেই। রাত এগারোটা ক্রস করে গেছে।মা ঘুমিয়ে পড়েছে।মায়ের কথা মনে হতেই মনে পড়লো আরাফের কথা। অনেকদিন ছেলেটির সাথে কথা হয় না। শিহাব ইচ্ছে করেই কম কথা বলে।ছেলেটা যখন ও প্রান্ত থেকে কথা বলে শিহাবের ভেতরটা একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে যায়।একটা ছোট্ট শিশু বাবামায়ের আদর বঞ্চিত। তবুও ওখানে ও সবার আদর যত্নে ভালোবাসায় মায়ের অভাবটা ভুলে আছে। যদিও শিহাবের মা বারবার শিহাবকে বলেই যাচ্ছেন আবার বিয়ে করবার কথা। বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে। কিন্তু শিহাব রিশতিনার স্মৃতি আর শায়লার সাথে পরিচয়ের মাঝে এক দোদুল্যমানতায় দুলছে।একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।অতীত ভুলে সামনে এগুলেও শায়লাকে নিয়ে এককভাবে ভাবাও ঠিক নয়।শায়লা একজনের বিবাহিতা স্ত্রী। যদিও অভিমান অনুরাগের টানাপোড়েনে দুজন দুরত্বে আছে।আইনের বন্ধনকে শিহাব শ্রদ্ধা করে। আর তার স্ত্রী হয়েও রিশতিনা শত অনিচ্ছাতেও আজ অন্যের সংসার করছে।শিহাব তো শায়লার ব্যাপারে সেই একই কাজ করতে পারে না।অন্যের স্ত্রীকে নিজের স্বার্থে নিজের করে নিতে চাইবে না।
এই বিষয়টি শিহাব বেশ ঘৃণাই করে।যতই আবেগ আর ভালবাসার জন্ম নেয় না কেনো,শিহাব কখনোই মেয়েদের আবেগ নিয়ে খেলেনি।
তবুও তার জীবনটা আজ এলোমেলো হয়ে গেলো। তবে শিহাব ধৈর্য্য ধরবে।চলুক চলতে থাকুক এমনি করে যতদিন চলে,,,,
এমনি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শিহাব সিগারেটটা শেষ করলো।আলসেমি ভেঙে বিছানা ছাড়ল। রাতের ঘুমের প্রস্তুতি নিতে হবে।এখনো রাতের খাবার খাওয়া হয়নি।আর ইচ্ছেও করছে না। এমনিভাবে অনেকরাতই সে না খেয়ে কাটিয়ে দেয়। আর কেইবা আছে তাকে একটু জোর করে খাওয়াবে।খাবার নিয়ে রাত জেগে অপেক্ষায় থাকবে।নাহ! মনকে এভাবে ঘুরালে চলবে না। যদিও এই ক্ষেত্রে কল্পনায় শায়লাকে বহুবার ভেবে নিয়েছে সে কিন্তু আজ যেন সে অধিকারটিও স্বেচ্ছায় খুইয়ে এলো। শায়লাকে ভেবে আর কোন স্বপ্ন সাজানো নয়।শায়লাকে তার নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে হবে।শিহাব তাকে কোন পিছু টানে বাঁধবে না।
শিহাব কাপড় পালটে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় ঘুমাতে চলে এলো। সিদ্ধান্ত নিলো সারাদিনের কোন কিছুকেই আর সে ভাবনায় আনবে না।তাহলে আর রাতে ঘুমই হবে না। সকালে গাজীপুর ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। এ ক'দিনে ওদিকে কি হয়ে আছে কে জানে? শিহাব ঘরের পর্দা ভালভাবে মিলিয়ে দিল। বেড সুইচটা দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। রাস্তার লাইট থেকে শিহাবের ঘরে বেশ আলো ঢুকে।
ঘরের ভেতর আলো আঁধারিতে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শিহাব ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much