০১ অক্টোবর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৭

কান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক।  তার নিত্যদিনের  আসা  যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "। 






                                                টানাপোড়েন (পর্ব-১৭)

                                                                                    স্বপ্নচারিনী



 
                                সৌরভের কথাটা তৃপ্তির মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। সত্যি একটাই তো জীবন। এই জীবনে যা যা কিছু পাওয়ার আছে, কেন পাবে না সে? যদি স্কোপ থেকে থাকে ,কেন পড়ে থাকবে শেখরের সঙ্গে? না কিছুতেই না। মনে মনে এসব ই  ভাবছে গোধূলি লগ্নে সূর্যের আলোটা যেন কামরাঙ্গা রং এর মতো নতুন রূপ ধারণ করেছে। সূর্যের কামরাঙা রং  যেন চোখে মুখে মেখে নিতে চাইছে তৃপ্তি।।জানলার কাছে দাঁড়িয়ে পিংক কালারের সার্টিন এর পর্দাটাকে ধরে ,ফিরে গেল সেই কলেজ লাইফে ।সৌরভের সেই হলুদ খামের চিঠি পেয়ে তৃপ্তি খুব অবাক হয়ে গেছিল । চিঠিতে লেখা ছিল  'একটু ভাবো ,শুধু তোমার জন্য।' আজকে সেই কথাটাই বারবার মনে পড়ছে ।তারপর কি হল ?সৌরভের কিছু ডেপোমি ভালো ‌লাগে নি তৃপ্তির।তখন তার সামনে যেন শেখরের সেই ভাব-গাম্ভীর্য পূর্ণ ব্যক্তিত্ব ই বেশি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু আজ আর সেই আকর্ষণ আকৃষ্ট করতে পারে না ।একই ছাদের তলায়, একই বিছানায় দুজনে পাশাপাশি তবুও নিরুত্তাপ । কেউ কারোর স্পর্শে যেন আর সেই কাঁপন অনুভব করে না, কান গরম হয়ে ওঠা কিছুই অনুভূত হয়  না। এ যেন স্রোতহীন নদীতে শৈবালদামে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। কেন এরকম হচ্ছে ?আজকাল সৌরভের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে নিত্যনৈমত্তিক দিনে সেরকম কোনো অভাব এত দ্রুত অনুভব করে নি। আজ কেন? আজ যেন সৌরভের কথা বেশি করে তাকে মনে করায়। মনে হচ্ছে যেন গ্রীষ্মের দাবদাহে চারিদিক যেমন রুক্ষ, শুষ্ক  হয়ে পড়ে, দরকার হয় তখন শুধু স্নিগ্ধ হতে বর্ষার বৃষ্টি। সৌরভ যেন তার জীবনে সেই বর্ষার এক পশলা বৃষ্টি। 
পাশের বাড়িতে শাখের   আওয়াজে সম্বিত ফেরে তৃপ্তির। না যাই সন্ধ্যেটা দিই। শেখরের ফেরার টাইম হয়ে যাবে ।কিন্তু একদমই ভালো লাগে না। আজকাল তৃপ্তির একা থাকতে বেশী ভালো লাগে। একান্ত মনে ,নির্জনতায় । আর মনটা ছটফট করতে থাকে শুধুমাত্র একটা ফোনের জন্য।
এর মধ্যে সৌরভ ফোন করলো 'হ্যালো"। কি ব্যাপার সাড়া নেই ।ফোনের অপেক্ষায় আছি ।একটা ফোন কেন করলে না?
তৃপ্তি বলল ' হ্যাঁ ,কেউ তার মনের এতটা জায়গা জুড়ে থাকবে, সারাক্ষণ তাকে ভাবাবে, তাহলে সে ফোনটা কি করে করবে?'
সৌরভ বলল. ' ওহ লাভলি, সোনা। মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। কিছু ভাবলে?'
তৃপ্তি  বললো  'ডিসিশন নিতে পারছি না।'
সৌরভ বলল  'এখনো? তুই কি সমাজ-সংসার নিয়ে ভাবছিস?'
তৃপ্তি চুপ করে থাকে।
সৌরভ বলে  'সমাজ সংসার তোকে খুশি করতে পারবে? তুই যেটা চাস ,সেটা করতে দেবে। নাকি তুই মনের কথা শুনবি? আমি তোকে বিদেশ নিয়ে যাব। তবে কিসের সমাজ সংসার? চলে যাব বিদেশে? কিসের লোকলজ্জা?'
তৃপ্তি তখনও চুপ করে থাকে। 
আসলে মধ্যবিত্ত রক্ষনশীলতার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বাড়িতে দাদা বৌদি আছে কি ভাববে? কে জানে?
সৌরভের গতদিনের ক্ষণিক স্পর্শে যে মাদকতা এসেছিল ।তার দেহ মনে ছড়িয়ে দিয়েছিল নেশা।সে যেন পাগল হয়ে যাবে ।তখন তার মনে হয়েছিল সৌরভের স্রোতে সত্যি এবার সে পাল তুলে চলে যাবে দূর বহুদূরে। কোন নোঙ্গর দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না ।মনের ভেতরে হাজারো রং মশাল যেন জ্বলে উঠলো রামধনুর ছটায় যেন সে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চাইছে। সে তো আর টিনেজ গার্ল নয় ।তাহলে তার কেন আজকে মনে হচ্ছে জীবনে নতুন করে তার বসন্ত এসেছে ।বসন্তের রং মেখে নিতে চাইছে। মনের ভিতরে একটা দ্বন্দ্ব চলছে ।কিন্তু সেই ভালোবাসার
 স্পর্শ পেতে চাইছে ।সারা সন্ধ্যা কেটে গেল ।একটা যেন ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তৃপ্তি ।কখন যে শেখর পাশের ঘরে এসেছে বুঝতেই পারে নি। টিভিতে নিউজ যখন বলছে 'পরকীয়া প্রেমের বলি স্বামী ।'তখনই তৃপ্তি ফিরে তাকিয়ে শেখরেরএর জন্য চা নাস্তা 'নিয়ে আসে।
 তৃপ্তি বলল ' তোমার চা নাস্তা রইল।'
শেখর কোন উত্তর দিল না। 
তপ্তিও আর কোন কথা বলল না, বেরিয়ে গেল।
আজকাল এভাবেই চলছে যেন শুধু অভিনয় ভালোবাসার ছিটেফোঁটাটুকু যেন নেই। তৃপ্তি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যায় তিনতলার ছাদে। আজকাল তাকে যেন অবলম্বনহীন শূন্যতা দুই হাত বাড়িয়ে হাতছানি দেয়। দু'চোখ জলে ভরে ওঠে। আজকাল কারণে-অকারণেই চোখে জল আসে। পরক্ষনেই ভাবে কেন অবলম্বনহীনা হবে, সৌরভ আছে তো ?এরই মধ্যে আবার ফোন বেজে ওঠে। ঠিক সৌরভের ফোন।
'হ্যালো 'কি করছো?
তৃপ্তি বলল  'ভাবছি'।
এবার সৌরভ আবেগভরে বলল 'আর কত সময় ধরে ভাববি?'আমার হাতে সময় নেই।'আর আমি চলে গেলে আর আসবো না এখানে।'কিন্তু আমি শূন্য হাতে ফিরে যেতে আসি নি।
তৃপ্তি বলল 'কি যে করব? জানি ,না।
সৌরভ বলল 'তুই আমাকে ভালবাসিস কিনা বল?'
তৃপ্তি চুপ করে থাকে।
সৌরভ বলে চুপ করে থাকলে তো চলবে না। তাহলে কি আমি মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরবো।
তুই কি এখনো শেখর এর কথা ভাবছিস? এতদিনের সম্পর্ক তাই ,একটু বিবেকে ধাক্কা লাগছে না রে?
যখন সৌরভ মুডে থাকে তখন তুই তুকারি করে।
কিন্তু তৃপ্তি এটাও মেনে নিতে পারছে না যে সৌরভ চিরকালের মতো চলে যাবে ।কোথায় যেন তার বুকের ভেতরে একটা ধড়ফড়ানি শুরু হয় ।তাহলে তো তার ইচ্ছে‌গুলো অপূর্ণ থেকে যাবে।
এরই মধ্যে তৃপ্তি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে লাল রংয়ের স্করপিও গাড়ি টা ।ঠিক ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ওপারে দাঁড়িয়ে। গাড়িটা বড্ড চেনা লাগছে। পেট্রোল পাম্পের কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্যাক্সি। তৃপ্তি খুব ভালো করে লক্ষ্য করলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো একজন ভদ্রলোক । গান ধরেছে 'যে ছিল আমার স্বপনচারিণী, তারে বুঝিতে পারি নি।...। চেনা গান চেনা কন্ঠ।তৃপ্তি খুব ভালো করে দেখার চেষ্টা করল হ্যাঁ সৌরভ ই তো? কি করছে ওখানে?
তারপর ফোনেতে সৌরভ বলছে ' দেখো আমি তোমার কত কাছে স্বপ্নচারিনী।:শুধু যদি তুমি আমার কাছে একবার হাতটা বাড়িয়ে দাও ।আমি তোমাকে ছুঁতে পারি ।আমি তোমাকে অনুরাগে ভরিয়ে দিতে পারি । একটি আকাশ উপহার দিতে পারি।একবার শুধু বলো কবে এক চাদরে  হবো প্লিজ প্লিজ।"
তৃপ্তি আর নিতে পারছে না সত্যিই ওর হাত পা যেন অবশ হতে শুরু করলো ।এটাই চেয়েছিল একটুখানি দেখা আর..??
তৃপ্তি বলল  'তুমি এখানে কি করছ?'
সৌরভ বলল  'এক পলক দেখা।'
তৃপ্তি বলল  জানি,।
সৌরভ বলল  'জানো যদি তাহলে সাড়া দিচ্ছ না কেন?'
তৃপ্তি একটু শ্বাস ফেলে চোখ বুজে বলল একটা বিশ্রী কান্ড হয়ে গেছে।
সৌরভ বলল  কি?
তৃপ্তি বলল ' শেখর আজকাল বোধহয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে?'
সৌরভ বলল 'ভালোই তো।'
তৃপ্তি বলল জানো তো আজকাল শেখর বেশি কথা বলে না। সারা দুপুর নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে। সেই সময় মাঝে মাঝে কাকাতুয়াটা শেখানো বুলিতে ডাকে ' তৃপ্তি তৃপ্তি তৃপ্তি।' তাই সে মনে মনে ভাবে যদি এই বাড়িতে কথা বলার কেউ থাকে। তাহলে একমাত্র কাকাতুয়া ই । এছাড়া আর কে আছে? তৃপ্তিকে ভালোবাসার ,কাছে টানার ,কথা বলার মত। পরক্ষণেই ভাবে সৌরভ আছে। কিন্তু সৌরভ যদি তৃপ্তির থেকে কোন পজিটিভ কথা না শোনে, তাহলে তো চলে যাবে। তৃপ্তির বেঁচে থাকাই নিরর্থক। সে ভাবল সে কথাটা শেখরকে জানাবে।
কথাটা শুনে সৌরভ বলল  ' যাক ,তাহলে মাথাটা ঠিক আছে। সেই আশাতেই বুক বেঁধে রইল ।


ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৭ ক্রমশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much