শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৪)
শামীমা আহমেদ
---মা আর রাহাতের সাথে রাতের খাবার খেয়ে ডাইনিং রান্নাঘর গুছিয়ে শায়লা নিজের শোবার ঘরে চলে এলো।শায়লা আগে মায়ের ঘরেই ঘুমাতো। মায়ের শরীরটা কখন কেমন হয়! তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটে অন্য ঘর দুটো রাহাত আর নায়লার দখলে। ওরা রাত জেগে পড়াশুনা করতো। আর ক্লান্ত হয়ে অফিস ফেরা শায়লার একটা পরিপূর্ণ ঘুম দেয়া খুবই অত্যাবশ্যক ছিল। যখন থেকে নীচতলার রুহি খালাম্মা বিয়ের প্রস্তাবটি নিয়ে এলেন তখন থেকে শায়লা আলাদা ঘরে চলে এলো।কানাডা থেকে কল আসতো, কথা বলতে হতো। শায়লা কখনো ভাবেনি সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ের এমন অচেনা কাউকে জীবনসঙ্গী করতে হবে।তবুও টুকটাক কথা চলতো। কেমন আছো, ভালো আছি,পছন্দ, অপছন্দ, এইতো!
নীচতলার খালাম্মা নিশ্চয়ই সবিস্তারে শায়লাদের সব কথাই জানিয়েছে আর শায়লার ছবিও দেখিয়েছে। কোন রকম ওজর আপত্তি না দেখিয়ে চট করেই নোমান সাহেব, পুরো নাম নোমান চিশতী,রাজী হয়ে যায়।শায়লা বেশ বুঝতে পারে দুজনার বয়সের ব্যবধান।আর এত বয়সে আজো বিয়ে করেনি! বিষয়টি শায়লার মনে উঁকি দিলেও ঘুণাক্ষরেও তার প্রকাশ আনেনি চোখে মুখে। প্রায় প্রতি রাতেই কথা হতো।
এগার ঘন্টার সময়ের ব্যবধানেও দুজনার কথা হতো। রাত একটায় ফোন এলে জানাতো এখন দুপুর তিনটে বাজছে, এইতো আমি লাঞ্চে যাচ্ছি।
তখন শায়লার মনে পাভেলের সাথের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠতো। একসাথে লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া, বাসস্টপেজ,,কতইনা ভালো লাগা আর চোখে স্বপ্ন নিয়ে এগুচ্ছিল দিনগুলি! এখনো অনেকটা তাই, তবে এখন ইচ্ছের বাইরে স্বপ্ন সাজাতে হচ্ছে। শুধু আগের সেই উচ্ছ্বাসটাই নেই।
একদিন নীচতলার রুহি খালাম্মা জানালেন নোমান বলতে চাইছে বিয়ের সব যখন ঠিক হয়েছে তবে আর শায়লার চাকরিটা করার কী প্রয়োজন? তো সেটাতেও ইস্তফা দিতে হলো। এখন শায়লার অপেক্ষা নোমান সাহেব দেশে আসবেন এবং বিয়ে পর্ব সমাপ্ত করে
স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন।শায়লার সাথে কথা হয়, ভিডিও কলে দেখা হয়, দীর্ঘদিন ঠান্ডার দেশে থেকে গায়ের রঙ আর চোখে মুখে সতেজতা থাকলেও বয়সটাকে লুকানো যায়নি। শায়লার চেয়ে কমপক্ষে পনের বছরের বড় এমন কেউ কি সংসার জীবনে বন্ধুর মত হবে নাকি অভিভাবক হয়ে কেবল দায়িত্ব পালন করবে। আসলে শায়লার মাঝে কোন অনুভুতিই কাজ করে না। তার একটাই ভাবনা নায়লার জন্য হলেও এই বিয়ে তার মেনে নিতে হবে।
আর মায়েরা, মেয়েদের যতই আপন ভাবুক তবুও সব মায়েরাই চায় ছেলে ছেলের বউ নাতি নাত্নী নিয়ে শেষ জীবনটা সুখেশান্তিতে কাটাতে।এই বাবামাকেই তখন খুব অচেনা লাগে। শায়লা তাই সকল মনযোগ নোমান সাহেবের দিকেই নিয়ে গেলো। এভাবে শায়লাকে নানান সময়ে নানান চরিত্রে নিজেকে সাজাতে হয়েছে। বাবামায়ের প্রথম সন্তান আর বাবাদের কাছে কন্যা সন্তানতো আরো বাড়তি আদরের জায়গা।সুখের দিনগুলি খুব দ্রুতই ফুরিয়ে গেছে!
যথাসময়ে নোমান চিশতি সাহেব দেশে এলেন। এসে পাঁচতারকা হোটেলে উঠলেন। হতেই পারে, এত ধনী ব্যক্তি!
খালাম্মার মহা উদ্যোগে এক বিকেল সন্ধ্যায় শায়লাদের কিছু আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হলো। আত্মীয়স্বজনেরা বহু আগেই সরে গিয়েছিল, তাদের দূর্দিনে পাশে কেউই ছিল না।
যে শায়লা এইটুকু বয়েসে সংসারের হাল ধরেছিল, পড়াশুনাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথচ আজ তারই বিয়েতে এত বছর পর তাদের ছাড়া বিয়ের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়না।যদিও আত্মীয়স্বজনদের জানার এতটুকু আগ্রহ নেই মেয়েটির কোথায় বিয়ে হচ্ছে, বিদেশ বিঁভুয়ের ছেলে একটু খোঁজ খবর করি।
আজ একবছর হতে চললো সেই কাগজের বিয়ে কাগজেই সাক্ষ্য হয়ে আছে।বিয়ের পর মাত্র পাঁচদিনের সময় কাটানো,পাঁচতারকা হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষে।এরপর থেকে শুধুই অপেক্ষা! ওপার থেকে নোমান চিশতী শুধু এটাই বলে চলেছে এইতো শীঘ্রই তোমাকে নিয়ে আসার কাগজপত্র পাঠাবো। এইতো এম্বেসীতে আজই দাঁড়াবো। এমন এড়িয়ে যাওয়ার কারণ অবশ্য শায়লার নীরবতা।নোমান সাহেবের ফেসবুকে এক বিদেশিনীর সাথে ছোট্ট দুটো ফুটফুটে ছেলে মেয়ের ছবি।বেশ হাস্যজ্জ্বোল ছবি। এদের পরিচয় জানতে চেয়ে নোমান সাহেবকে বারবার প্রশ্ন করলেও তিনি নিরুত্তর থেকেছেন। শায়লার বুঝে নিতে কষ্ট হলোনা এরা তার প্রথম ফ্যামিলি। অনেকদিন পর তিনি জানালেন,তার আগের স্ত্রী সুজানা এই দুটো সন্তানকে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করেছে। শায়লা কি এই সন্তানদুটোর মা হতে পারবে না? শায়লার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে!বারবার তার জীবনে শুধু দায়িত্ব এসে দাঁড়ায়।শায়লার নীরবতায় নোমান সাহেব কিছু একটা বুঝে নেয়।
শায়লা নিরুত্তর থাকে।
রাতের অন্ধকারে দুচোখের জল শুধু অনুভব করা যায়,কখনো তা দেখা যায় না। নোনা স্বাদের সে অশ্রুজলে থাকে ভেতরের তীব্র ঘৃণা আর কষ্টের প্রকাশ। আনমনা হয়ে শায়লা ভাবে সেতো একা একা ভালোই ছিল।কেন বারবার
তার জীবনে অন্য মানুষের এমন আচমকা আগমনে, শান্ত সাজানো মনটাকে, তছনছ করে দেয়া!
চলবে......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much