একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন ৩৫
চোখের বালি
সারারাত জ্বরে কাতরিয়েছে রেখা। কাশিটাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মনোজ সেই যে ফোন নিয়ে অশান্তি করলো ,তারপর ওষুধগুলো কাছে রেখে দিয়ে কোথায় যে আছে কে জানে?
রেখার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে ।কোনরকমে উঠে দেখছে টেবিলের ওপর জলটা আছে ।গ্লাস টেনে নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিল। শরীরটা প্রচন্ড উইক লাগছে। বাথরুমে যেতে হবে। কোনরকমে উঠল রেখা ।উঠে বাথরুমে গেল। এসে আবার খাটের উপর বসে পড়লো ।বসে বসে ভাবতে লাগল 'মনোজ কোথায় গেল,?রাতে কি তবে এই ঘরে শুতে আসে নি। '
রেখা ভাবতে ভাবতে আবার শুয়ে পড়লো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা বাজে। ভোর হয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে মর্নিংওয়াক করা পথচারীরা কথা বলতে বলতে যাচ্ছে।
তাহলে মনোজ কোথায় গেল?
না ,সত্যি কালকে রেখার ফোন ধরাটা উচিত হয় নি।
মনোজ সাধারণত রাগ করে না কিন্তু এবার যে কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
৫ .৩০তে কলিংবেল বেজে উঠল"জয় গনেশ ,জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা...।"
সাত সকালে কে আসলো,? আমার তো ক্ষমতা নেই উঠে গিয়ে দরজা খোলার। মনোজ কি শুনতে পাচ্ছে না আওয়াজটা। বেজেই চলেছে। কি আশ্চর্য। দরজা নক করে ডাকছে " বৌদি ,বৌদি"।
রেখা কান খাড়া করে শোনে'।আরে ,এতো, সুমিতার গলা মনে হচ্ছে। নির্ঘাত সুমিতা।
বাবা ,সাতসকালে এসে হাজির। কি ব্যাপার, কে জানে? পরে রেখার মনে পড়ল আজকে তো সুমিতা মাইনে চেয়েছিল অ্যাডভান্স, এবার বুঝতে পারল ।কেন এত তাড়াতাড়ি সে কাজে এসেছে?
কোনরকমে উঠে গিয়ে দরজাটার কাছে গেল। দরজাটা খুলল 'কি ব্যাপার সুমিতা ,এত তাড়াতাড়ি আসলে?''
সুমিতা বলল 'ও বৌদি, আমি বাড়ী থাকবো না ।এক জায়গায় যাব। সে জন্যই তাড়াতাড়ি আসলাম।"
রেখা মনে মনে ভাবল টাকা নেওয়ার না থাকলে আজকে কাজে ই আসতো না।
সুমিতা বলল ' বৌদি তোমার শরীর খারাপ?'
রেখা বলল ' হ্যাঁ গো। তুমি আজকে ফিরবে তো?'
সুমিতা বলল 'দেখি।'
রেখা বলল 'তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো যে আমার শরীরটা খুব খারাপ। কাজে না আসলে কতটা অসুবিধায় পরবো বলো তো?'
সুমিতা বলল 'যদি ফিরি, তাহলে কাজে আসব।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,একটু চেষ্টা ক'রো।'
সুমিতা কোন কথার উত্তর না দিয়ে ঝাঁটা দিয়ে
ঝাঁটাতে শুরু করল।
রেখা ও কোন কথা বাড়ালো না । আস্তে আস্তে ড্রইংরুমের দিকে গেল, দেখল মনোজ শুয়ে আছে।
টেবিলে Black label পাশে কাঁচের গ্লাস। ফোনটা সমানে বেজে যাচ্ছে।
এ সমস্ত দেখে রেখা আকাশ থেকে পড়ল। এ কোন মনোজকে দেখছে। এই কি তার স্বপ্নের পুরুষ যাকে এত ভালবেসেছে? মনে হচ্ছে যেন রেখা ওখানেই পড়ে যাবে ।নিজেকে সামলাতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে মনোজের পাশে খাটে গিয়ে বসে পড়ল। চোখ থেকে জল পরছে। আর কি কি যে আছে কপালে, কে জানে? কেন হচ্ছে এসব? কি করেছে রেখা?'
রেখা কি ফোনটা রিসিভ করবে?'
ফোন নিয়ে যা অশান্তি হয়েছে গত রাত্রে ।তাতে রেখা সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু এখন তো মনোজ অঘোরে ঘুমোচ্ছে ।ফোনটা রিসিভ করলে ,ও টের পাবে না।
কিন্তু ছলনার আশ্রয় নেওয়া কি ঠিক হবে? নাকি একবার সুরঞ্জনদাকে ফোন করবে? মাথায় কিছুই খেলছে না। এমন সময় 'বৌদি বৌদি বৌদি ইইইই'।'
রেখা ভাবলো 'সূমিতা এত চেঁচাচ্ছে কেন?'
কোন রকমে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রেখা সাড়া দিল - 'কি হলো সুমিতা। সাতসকালে এত চিৎকার করছো কেন?'
সুমিতা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল 'কলতলায় যেতে পারছি না ।মিলি চিৎকার করছে।'
রেখা অবাক হয়ে বলল 'কেন? ও তো তোমাকে দেখে কিছু তো বলে না ।হঠাৎ আজকে কেন তোমাকে দেখে চিৎকার করবে? তুমি কিছু করেছ নাকি?'
সুমিতা বলল 'না গো বৌদি, ওর বাচ্চাগুলো যেখানে আছে, ওখানে ছাইয়ের কৌটো আছে। তাই ছাই আনতে গেছিলাম।
রেখা বলল 'তাই বলো ।তুমি ছাই আনতে গেছ তো ,তুমি আমাকে বলবে তো?এ সময় ও কাউকে এলাও করবে না ।বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আগলে বসে থাকে।
রেখা বলল 'ঠিক আছে ,আমি যাচ্ছি ।আমার শরীরটা খারাপ জানো , তবুও আমাকে এত তোমরা হয়রানি করাচ্ছ না? '
আস্তে আস্তে মিলির কাছে গেল রেখা । কাছে গিয়ে ডাকল 'মিলি ,মিলি ,মিলি ।' মিলি তখন লেজ নাড়ছে। রেখা গিয়ে ছাইয়ের কৌটোটা আনলো। মিলি কিন্তু কিচ্ছু বলল না।
সুমিতা অবাক হয়ে দেখল আর বলল 'ও বৌদি ,ও কিচ্ছু বলল না তোমাকে?'
রেখা বললো 'আমাকে কেন বলবে? তোমরা নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কিছু বদমাইশি করেছ।।
সুমিতা বলল 'না গো বৌদি?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে ।আর কথা বাড়িও না ।কাজ করো।
সুমিতা আপন মনে গজগজ করতে করতে বাসন মাজতে লাগলো।
রেখার মনে এখন সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে লাগলো । এমন কি নিজের শরীর খারাপের কথাও এখন ভুলে গেল। মনের ভেতর যেন একটা আলাদা জোর এসেছে ।এই রহস্য তাকে উদ্ধার করতেই হবে।
রেখা আবার মনোজের ঘরে ঢুকলো ফোনটা তেমনি বেজে চলেছে ।
এবার রেখা ফোনটা রিসিভ করল কিন্তু 'রেখা কোন কথা না বলে চুপচাপ থাকলো।
অপরদিকের কন্ঠ ভেসে এলো 'তুমি ফোনটা রিসিভ করছো না কেন? আজকাল আমার ফোন ধরতে তোমার খুব কষ্ট হয় ,তাই না?
রেখা তো অবাক হয়ে যাচ্ছে ।এ যে এক মহিলা কন্ঠ।এসব কি বলছে ?ফোনটা কি ক্রস কানেকশন হয়ে গেছে ।তবু কান পেতে শোনে আর কি বলে।
'আমার এখন কি উপায় হবে তার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।'
রেখা ভাবছে ' ব্যবস্থা কি ব্যবস্থা?'
আবার বলছে মেয়েটি 'কি হলো মনোজ ?কথার সাড়া দাও ।শুধু আমি বকে যাচ্ছি। তুমি চুপ করে থাকলে তো চলবে না।'
রেখার তো এবার শরীর কাঁপতে লাগল ।পায়ের তলার মাটি যেন সরে যেতে লাগলো ।আকাশ যেন তার মাথায় ভেঙে পড়ছে ।কি শুনছে? কে এই নারী ?যে মনোজকে তুমি তুমি করে কথা বলছে। কে ?কী রহস্য ?কিছুই বুঝতে পারছে না।
রেখা ফোনটা ধরে রাখতে সাহস পেলো না ।আর কি কথা বলে ফেলবে কে জানে ?ফোনটা রেখে দিল।
রেখা সেখানেই কিছুক্ষণ বসে চিন্তা করতে লাগল।কী পরিণতি এর, কিছুই জানে না? কেন তার স্বামী এরকম করছে আর মেয়েটির সঙ্গে তার স্বামীর ই বা কি সম্পর্ক ?কাকে জিজ্ঞেস করবে ?এই মেয়েটি কি তার চোখের বালি হয়ে যাবে শেষপর্যন্ত ?তার সুখ-শান্তির সংসারে কি আগুন লাগতে চলেছে ।যার জন্য আজ মনোজ রেখার সঙ্গে এত দুর্ব্যবহার করছে ।অথচ রেখা জীবনে মনোজকে এতটা প্রাধান্য দিয়েছে ।রেখার জীবনেও তো কম পুরুষের আগমন হয় নি । কিন্তু সেভাবে তো কিছুই ভাবে নি। তার সমগ্র হৃদয়াকাশে হয়তো কেউ কেউ জায়গা করতে চেয়েছে কিন্তু বিরাজ করেছে মনোজ ই ।ভাবতে পারছে না কি করবে?
এরমধ্যে সুমিতা এসে বলল ' বৌদি আমার মাইনের টাকাটা দাও।'
সুমিতা তাড়াতাড়ি উঠে এলো তার মধ্যেও দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল সুমিতা।
সুমিতা বলল 'ও বৌদি, দাদা আজকে ওই ভাবে শুয়ে আছে কেন গো ?তোমাদের মধ্যে কি কিছু অশান্তি হয়েছে নাকি ?বাবা ,আমরা ভাবি শুধু আমাদেরই ভিতর অশান্তি আছে ।তোমাদের ও ভিতর অশান্তি?'
রেখা বলল 'কি বলছ? কিসের অশান্তি হবে আমাদের মধ্যে ?আমার শরীর খারাপ ছিল, তাই একটু নিশ্চিন্তে এই ঘরে এসে শুয়েছে । এতে অশান্তির কি আছে সুমিতা ?আগ বাড়িয়ে বেশি কথা বলো না তো ?এই নাও তোমার মাইনে । (রেখা ২000 টাকা হাতের মধ্যে ধরিয়ে দিল)।
রেখা জানে তো কাজের মেয়েগুলো এরকম ই ।এরা যা দেখবে সারা পাড়া গিয়ে রটাবে।
কিন্তু শেষরক্ষা কি হবে? রেখার' চোখের বালি'যে কখন অজান্তে বোপিত হয়েছে এবং তা বৃক্ষে পরিণত হতে চলেছে। তা বুঝতেই পারে নি। রেখার হৃদয়াকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা। হয়তো রেখাকে অতি বর্ষণে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ?রেখা কি তরী তীরে নোঙ্গর বাঁধতে পারবে? নাকি ভেসে যাবে কোন অজানায়।নিজেকে কি বাঁচাতে পারবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much