১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায় চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১০৫





উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১০৫

তুমি রবে নীরবে

মমতা রায় চৌধুরী



স্টেশনে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কিকারনে দাঁড়িয়েছিল ,কেন দাঁড়িয়ে ছিল, তা জানেনা। একটা এলোমেলো ভাবনা বেখেয়ালি মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। কজন ডেইলি প্যাসেঞ্জার এ ভাবে বসে থাকতে দেখে একটু অদ্ভুত ভাবে তাকালো বটে । রেখা খেয়াল করে নি তা নয় কিন্তু উঠলো না। সারাদিনে স্কুলে ঘটে যাওয়া ঘটনা আবার যেন ডানা মেলেছে । বাণীদি তার মাঝে যেন একরাশ টাটকা  অক্সিজেন হয়ে এসেছিল। বাড়িতে গিয়েই বা কি করবে সেই তো একাকীত্ব। তবুও মিলি, তুলি, পাইলট আছে বলে বাড়ি এখনও বাড়ি আছে। আজকাল দেরি হলেও মনোজ ফোন করে খবর নেয় না ।প্রয়োজন পড়ে না ।দৈনন্দিন জীবনের সামান্য চাওয়া-পাওয়াটুকু,  প্রত্যাশাটুকু যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও বাচ্চা গুলোর কথা মনে হওয়াতে রেখা উঠে পরল 
তাড়াতাড়ি ।এবার অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগোলো একজন অটোওয়ালা বলল ' ও দিদি, আপনি এত কি ভাবছিলেন ?আপনি যে অটোতে যান, সে কতবার আপনাকে ডাকল। আপনি শুনতেই পেলেন না ।'
রেখা বলল 'ও তাই বুঝি খেয়াল করিনি।'
 ওরা বলল' হ্যাঁ আমরাও  সেটাই ভাবছিলাম আপনি একমনে কী যেন একটা চিন্তা 
করছিলেন।'
 রেখা বলল' ঠিক আছে, তুমি যাবে
 তো ?'
অটোওয়ালা বলল' হ্যাঁ যাবো ,বসুন বসুন। বলেই এক যাত্রীকে বললেন 'দাদা ,আপনি একটু এদিকে সরে আসুন, দিদিকে বসতে দিন।
হঠাৎই ফোনের আওয়াজ''তুমি রবে নীরবে...। রিংটোন বেজে উঠলো।
পাশের ভদ্রলোক নিজের ব্যাগ হাতরাতে শুরু করলেন ।তারপর ফোন খুলে দেখছেন না নিজের না ।তখন তিনি বলেন 'দিদি বোধহয় আপনার ফোন বাজছে দেখুন।'
রেখা কতটা বেখেয়ালি হয়ে গেছে নিজের ব্যাগে ফোন বাজছে তবু হুশ নেই ।
তারপর বললো' ও থ্যাংকস। দাঁড়ান দেখছি। খুলে দেখছে মিসকল হয়ে পড়ে আছে রিম্পাদির।'
রেখা মনে মনে ভাবল অনেকদিন পর রিম্পাদি ফোন করলো। অবশ্য আমারও করা হয়ে ওঠেনি নানা কারণে।
রেখা ফোন লাগালো রিম্পাদিকে । রিং হচ্ছে এবার বলল হ্যালো'।
রেখা বলল 'ফোন করেছিলে রিম্পা দি?'
রিম্পা দি বলল 'হ্যাঁ। আর আমিও এইখানে এসে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তোকে ফোন করা হয়ে ওঠেনি রাগ করিস নি তো?'
রেখা বলল 'রাগ ,অভিমান, ভালোলাগা ,ভালোবাসা ,এগুলো আপেক্ষিক মনে হচ্ছে আজকাল জানো তো?'
রিম্পা দি বলল'তোর কি হয়েছে রে?'
রেখা বলল'কই কিছু নাতো?'
রিম্পা দি বলল 'বললেই হলো, কিছু হয়নি ।আমি তোকে চিনি না, জানি 
না ?কিছু তো একটা হয়েছে তুই আমার কাছে আড়াল করছিস।'
রেখা চুপ করে রইলো।
রিম্পাদি বলল' আমি কিন্তু প্রত্যাশা করেছিলাম তুই একবার ফোন করবি।
আমার প্রত্যাশা ভালো লাগার বিষয়গুলো কিন্তু হারিয়ে যায়নি জানিস তো।'
রেখা বলল' সবাই তো তোমার মত নয়।'
রিম্পা দি বলল 'তুই যদি বলতে না চাস আমি জোর করব না আর এখন তো আমি তোর কাছেও নেই যে আমি তোকে জোর খাটিয়ে জিজ্ঞেস করবো। তবে কি জানিস তো মনটা একটু হালকা করতে পারতিস ।মনে হচ্ছে আমি ট্রানস্ফার নিয়ে এসে অনেকটাই তোর কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি।'
রেখা বললো 'রাগ করো না রিম্পা দি।'
রিম্পাদি বলল 'রাগ করব কেন
 বল ? আমি বুঝতে পারছি তো'র কিছু একটা হয়েছে তুই' বলতে চাইছিস না তা কি বলবো বল?'
রেখার চোখের জল পড়তে 
লাগল। গলার স্বর বেদনাক্রান্ত ।
রিম্পাদি বলল' কি হয়েছে বল না?'
রেখা বলল 'আমার সাথেই কেনো এরকম হয় বলতে পারো রিম্পা দি।'
রিম্পাদি বলল' স্কুলে কিছু হয়েছে না রে?'
অনিন্দিতার সঙ্গে কিছু ঝামেলা হয়নি তো তোর?'
রেখা ভাবছে কি করে বুঝতে পারে রিম্পা দি।
রিম্পাদি বলল 'কিরে কথা বলছিস না?'
রেখা বলল' তুমি যা ভেবেছ ঠিকই।_
রেখা স্কুলের ঘটনা সব রিম্পা দি কে বলল।
রিম্পা দি বলল সাংঘাতিক 
কান্ড ।সেকি রে সিনিয়র জুনিয়রের কোন মান মর্যাদা থাকবে না ।কি হচ্ছে এসব আর ওর এত বড় স্পর্ধা?. বড়দি কোথায় ছিল?
রেখা বললো 'বড়দি আজকে আসেন নি। তুমি চলে যাওয়াতে এমনিতেই আমার মনটা খুব খারাপ ছিল ।তারপর এইসব কান্ড ।আমার না স্কুলে যেতে একদমই ভালো লাগছেনা।
রিম্পা দি বলল 'সেই তো তুই এক কাজ কর তুইও কাছেপিঠে চলে আয় এবার। স্কুলকে ভালোবেসে থেকে গেলি এত বছর ।নিজের সংসারের প্রতি একটু ধ্যান দে।'
রিম্পা দি বলল তোকে  একটা খারাপ খবর দেবার আছে?
রেখা বলল'আবার খারাপ খবর?
রিম্পা দি বলল' এটা না দিলেই নয় ,.তোর একজন প্রিয় রাইটার তিনি তো চলে গেলেন না ফেরার দেশে।'
রেখা বলল 'জানো তো আজকে স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে অনেকক্ষণ একা একা বসে ছিলাম মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেছিল শুধু স্কুলের ঘটনাটা জন্যই নয়, এমনিতেও মনটা যেন কেমন আমার হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না অনেকক্ষণ ছিলাম বসে।
রিম্পা দি বলল ', হ্যাঁ, সেই জন্যই তো এখন তুই ফিরছিস ,আমি একটু অবাক হলাম।
রেখা বললো ,'কি বলবে বলো?
এরমধ্যে অটোওয়ালা বলল দিদি এসে গেছেন।
রেখা বলল' হ্যাঁ এই তো নাম  দিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে দিল।
রিম্পা দি বলল 'নারায়ন দেবনাথ অমর্ত্য লোকে যাত্রা করেছেন।
কথা বলতে বলতেই রেখা এসে গেটের কাছে পৌঁছালো।
রেখা বলল'কি খবর শোনালে  তুমি'।
রিম্পা দি বলল 'খবরটা শুনে আমারও খুব খারাপ লেগেছে রে।'
রেখা বলল 'আমাদের শৈশবের সুতো ছিঁড়ে গেল গো।'
রিম্পা দি বলল'একদম ঠিক কথা বলেছিস।'
রেখা বলল মাল্টিপ্লেক্সহীন, নেটফ্লেক্সহীন , ইউটিউবহীন শৈশবের একমাত্র দুনিয়া ছিল যার হাতে ,তিনি আজ না ফেরার দেশে। নন্টে ফন্টে হাঁদা ভোঁদা,বাটুল অসাধারণ সব চরিত্র যার হাতে উঠে এসেছিল তিনিই নারায়ন দেবনাথ।
রিম্পা দি বলল একদম ঠিক বলেছিস আমাদের সময়কার ছোটবেলায় নন্টে ফন্টে পড়েনি এমন কেউ ছিলনা ।হাঁদা ভোঁদা পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়তাম আমরা।
রেখা বললো' আমাদেরকে অনাথ করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন।'
রেখা কথা বলতে বলতে গেটের কাছে চলে আসলো কলিং বেল বাজালো। কিন্তু কোন সাড়া নেই।
রিম্পা দি বললো ভালো থাকিস এখন রাখছি পরে কথা হবে ।
রেখা আবার কলিং বেল বাজালো। মনোজ  বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।
রেখা ব্যাগটা নামিয়ে বাথরুমে গেল ফ্রেস হতে ।তখনো ভাবছে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে চোখে পড়তো যেমন আকাশে উড়ে যাচ্ছে পাখিদের 
ঝাঁক ।।ছোট্ট বেলায় শুধু মনে হতো কোন দেশের বাসিন্দা? ওদের জন্য তো কোনো কাঁটাতার নেই, ওদের পাসপোর্ট লাগে 
না ।এই যে  কল্পনার পাহাড় ছোটবেলাতেই যে অপার বিস্ময় কৌতুহল সেই দিনগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে । তবুও সাহিত্যিক নারায়ণ দেব বেঁচে থাকলে হয়তো আরো অনেক কিছু এরকম আমরা শৈশবের দিনগুলো নতুন করে ফিরে পেতাম।
এখন সে তো তাঁর অসাধারণ সৃষ্টির মধ্যে আমরা বেঁচে থাকব শৈশবের দিনগুলো কে নিয়ে।
চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
মনোজ  বললো কি ব্যাপার? তোমার চোখ-মুখ এরকম লাগছে কেন?
রেখা কোন উত্তর করছে না বলে আবারো একই কথা জিজ্ঞেস করল।
তখন রেখা বলল শৈশবের দিনগুলোকে মনের কোন গহীন গাঙে রেখেছি সেগুলোকেই ক্লান্ত চোখে মুখে খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি ।
মনোজ কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আর বলল তুমি লেখিকা বলে আজকাল অনেক কিছুই তুমি অন্য ভাবে ব্যক্ত করো।
কিন্তু আমরা সাধারন মানুষ আমাদেরকে সেই ভাষাতেই বোঝাতে হবে।
রেখা বলল 'চা খেয়েছ, না খাবে?
মনোজ বলল' না খাইনি।'
রেখা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গেল রান্নাঘরে দিকে গেল 'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম….।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much