শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৫৯)
শামীমা আহমেদ
সুনায়রা আর আরুশের সাথে শায়লার ক্যারাম খেলা বেশ জমে উঠেছে! শায়লার আদর কাড়া কথায় মাঝে মাঝেই সুনায়রা আর আরুশ আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠছে।ওরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে!
মা ঘুমিয়ে পড়ায় শিহাব মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে ওদের এই আনন্দঘন সময় দূর থেকে দেখছিল। অনেকদিন পর এই বাড়িতে শিহাব একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে আর এর জন্য শায়লার কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খেলার ফাঁকে হঠাৎ শায়লা চোখ তুলতেই শিহাবকে দেখতে পায়।শায়লার মুখটি খুশিতে ঝলমল করে উঠলো! শিহাব চোখের ভাষায় শায়লার প্রতি একরাশ ভালবাসার প্রকাশ দেখালো। শায়লা এক লাজুক হাসিতে তা গ্রহন করে নিয়ে আবার খেলায় মেতে উঠলো। শিহাব ড্রইং রুমের সোফায় বসে মোবাইল চেকিং এ ব্যস্ত হলো।
একটু পরেই আরাফ তার দাদার কোল দখল করে চারতলায় চলে এলো। শিহাব বাবার সাথে দেখা হওয়ায় সালাম জানিয়ে বাবার শরীরের খোঁজখবর নিয়ে পরিবেশটা শায়লার জন্য সহজ করে দিলো। শায়লা উঠে দাঁড়ালো। শিহাব তার বাবার সাথে শায়লার পরিচয় করিয়ে দিলো। শায়লার সালামের উত্তর দিয়ে তিনি ঘরের দিকে যেতে চাইতেই, আরাফ শায়লার সাথে আরুশ ও সুনায়রার এত আনন্দিত ভাব দেখে সেও খেলার লোভ
সামলাতে পারল না। খুব দ্রুতই সে দাদার কোল থেকে নেমে এলো। আরুশের পাশে বসে খেলার সঙ্গী হতে চাইল। শায়লা আরাফকে তার কাছে ডাকলেও আরাফ আরুশের সাথে বসে রইল। মাঝে মাঝে চোরাচাহনীতে শায়লাকে দেখছে। শিহাব কাছে এসে আরাফের মাথায় হাত বুলিয়ে, খুবই আদুরী গলায় বললো,যাও বাবা, ঐটা তোমার আম্মু। আরাফ এবার যেন শায়লার দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। শায়লা হাত বাড়িয়ে আরাফ বলে একটা মায়াভরা ডাক দিতেই আরাফ গুটিগুটি পায়ে শায়লার দিকে এগিয়ে গেলো। সুনায়রা বললো, যাও ভাইয়া এইটাতো তোমার আম্মু হয়। এবার আরাফ পুরোপুরিই কনভিন্সড হলো। শায়লার কাছে যেতেই শায়লা তাকে আদরে জড়িয়ে ধরে কোলে বসিয়ে নিলো।আরাফের মুখে এক স্বর্গীয় হাসি! শায়লাও যেন দুঃসাধ্য কিছু জয় করার আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠলো! শিহাবের চোখ আনন্দাশ্রু তে ভরে গেলো। এখন শায়লা যেন তার জীবনের পূর্ণতা এনে দিলো। ধীরে ধীরে শায়লা আর আরাফ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো। শায়লা আরাফকে বুকে জড়িয়ে নিলো। শায়লার বুকের ভিতরেও যেন কত কত যুগের সন্তান তৃষায় শুকিয়ে,শুস্ক মরু সাহারা হয়ে ছিল। এমন নরম নরম শিশুর হাত পায়ের ছোঁয়াতে শায়লার ভেতরে মাতৃত্বের নহর বয়ে গেলো। মা আর সন্তানের এমন মিলন দৃশ্য শিহাবকে একবারে নির্বাক করে দিলো।
দুপুরের রান্না শেষ করে সুমাইয়া উপরে চলে এলো। ভাবী আজ ভীষণ ব্যস্ত।শায়লা ভাবীকে আজ কোন সাহায্যই করতে না পারায় তার দুঃখ প্রকাশ করতেই সুমাইয়া বলে উঠলো,না না আজ তুমি বাচ্চাদের সাথে থাকবে
দেখোনা তোমাকে পেয়ে ওরা কত খুশি হয়েছে।কতদিন পর ওরা চাচী পেলো! আরাফও তো দেখছি তোমার কাছে যাচ্ছে।
শায়লা অর্জনের হাসিতে বুঝিয়ে দিলো,হ্যাঁ ভাবী আমি আরুশের মন জয় করতে পেরেছি।সে আমার কাছে এসেছে। আমি এরপর একটু রকটু করে ওর সাথে বন্ধুত্বটা গড়ে তুললেই ও একেবারে আমার কাছে চলে আসতে চাইবে। যদিও কথাটায় সুমাইয়া আরাফকে হারানোর বেদনায় কষ্ট পেল, তবুও সে চায়, আরাফ বাবা মায়ের সাথে থাকুক।তার নিজের পরিবার সে চিনুক।
সুমাইয়া রান্না করা সব খাবার চারতলা শ্বাশুড়ির ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। সবাই একসাথে মিলে ডাইনিং টেবিলে খাবার খেতে বসলো।শায়লার কোলে আরাফ আর দুই পাশে সুনায়রা আর আরুশ বসেছে।চাচী তাদের খাবার তুলে দিচ্ছে। যদিও খুবই চেনা খাবার কিন্তু আজ চাচীর যত্নের বেড়ে খাওয়ানোতে তারা আনন্দে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে। শায়লা নিজের প্লেটের খাবার থেকে কোলে বসা আরাফের মুখে একটু একটু করেচতুলে দিচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে সুমাইয়া বলে উঠলো, শায়লা তুমি বাচ্চাগুলোর মায়া বাড়াচ্ছো।তুমি আজ চলে গেলে ওরাতো খুব কষ্ট পাবে।
এ কথার জবাবে মা বলে উঠলেন,শায়লা তুমি মাঝে মাঝেই আসবে।এই বুড়ো বাবা মাকেও দেখে যাবে।
শায়লা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো।শিহাব বুঝে নিলো শায়লাকে ঘরে তুলতে বেশি দেরি করা যাবে না। ইতিমধ্যেই সে এই পরিবারের সবাইকে আপন করে নিয়েছে।শায়লা তার নিজের প্লেটের খাবার তিনজনের মুখে তুলে দিচ্ছে। টেবিলের বিপরীত দিক থেকে শিহাব শায়লার এই মায়াভরা মনটাকে অনেক ভালবাসায় ভরিয়ে দিলো। শিহাব মনে মনে বলে উঠলো, শায়লা তোমাকে আমি ঠিকই চিনেছি।শায়লা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। শায়লার হৃদয়ে যেন শিহাবের কথার ঢেউ এসে লাগলো। সেও নীরব ভাষায় চপকে চোখ ফেলে উত্তর পাঠিয়ে দিলো,আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি শিহাব। দুজনেই মনের অজান্তে এক গভীর অনুভবে শিহরিত হলো।
বিকেলের আগেই শিহাব মা বাবা ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলো।ভাবী তাদের বিকেলের চা খেয়ে যেতে বললো।শিহাব জানালো,আজ না ভাবী। না হলে আমাদের ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।শায়লাকে সন্ধ্যার আগে ওদের বাসায় পৌছে দিতে হবে।
ভাবী এবার আর শিহাবকে বলতে ছাড়লো না, কি ব্যাপার শিহাব? সন্ধ্যা হতে তো এখনো ঢের দেরী? দুজনে আবার মুভি দেখতে যাবে নাকি?
এ কথায় শায়লার চোখ ভীত হয়ে উঠলো!সিনেমা হলের সেই অন্ধকার পরিবেশ শায়লা
বেশ ভয় পায়।একবার ছোট বেলায় একটি বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। মুভি দেখার ইচ্ছে তার একেবারেই নেই।
শিহাব সাথে সাথেই সুমাইয়ার কথা খন্ডন করে বললো,না না, ভাবী তেমন কোন ইচ্ছে নাই।আর মুভি দেখতে গেলে তোমাকেও নিয়ে যাবো।কোন আনন্দই তোমাকে ছাড়া পূর্ণতা পাবে না ভাবী।তোমার কাছেতো আমার ঋণের শেষ নেই।
--থাক খুব হয়েছে,আর ঋণ শোধ করতে হবে না।শায়লা পাশে দাঁড়িয়ে ভাবী দেবরের মধুর সম্পর্কের কথোপকথন শুনছে।
---তুমি তাড়াতাড়ি শায়লাকে ঘরে তুলে নাও, তবেই আমরা একসাথে মুভি দেখতে যাবো।
সুমাইয়ার এমন কথায় শায়লা বেশ লজ্জিত হয়ে গেলো।
সেই সকাল থেকে নানান নাটকীয় ঘটনার পর সবশেষে শায়লার আদর পেয়ে আরাফ শায়লার কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো। বেশ ধকল গেছে শিশুটির ওপর দিয়ে।আরাফকে রেখে যেতে শায়লার খুব মায়া হচ্ছিল।কিন্তু ঘুমিয়েছে বলেই এখন রেখে যাওয়া সম্ভব।চাচীর বিদায়ক্ষণে সুনায়রা, আরুশ কেঁদে কেটে একাকার।শায়লাকে পেয়ে তারা আজ একটা খেলার সঙ্গী পেয়েছিলো!
শায়লা সুনায়রা আর আরুশকে অনেক আদর করে, আবার বেড়াতে আসবে, এমনটি কথা দিয়ে সেদিনের মত জিগাতলা থেকে ওরা বিদায় নিলো। শিহাব উবার কল দিলো।সুমাইয়া ওদের গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।
শায়লা সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরে নীরবে যেন শিহাবকে নিয়ে তার আশা আকাঙ্ক্ষার কথাই বুঝাতে চাইল।সুমাইয়া জানালো, শায়লা তুমি খুবই ভাগ্যবতী, শিহাবকে তোমার জীবন সঙ্গী করে পেতে যাচ্ছো।ওর মত ভালো ছেলে আর হয় না। শিহাব চোখের ইশারায় এ কথার সমর্থন জানাতেই তিনজনেই একসাথে হেসে ফেললো। শায়লা শিহাব উবারে বসলো। সুমাইয়া ঘরে ফিরে গেলো।গলির মোড় পেরিয়ে গাড়িটি মেইন রোডে আসতেই শিহাব শায়লাকে একেবারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শায়লার গালে চট করে একটা গভীর চুমু বসিয়ে দিলো। আর শায়লাকেও শিহাবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হলো।কেননা শায়লার শক্তিতে শিহাবকে ছাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা ধোপে টিকল না।
গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো।সিগনালে থামতেই শিহাব নিজেকে শায়লা থেকে ছাড়িয়ে নিলো।বাকী পথটুকু দুজনে নীরবেই
সময় পার করলো।শায়লার মনের ভেতর নানান ভাবনার উঁকি। শিহাব ভেবে নিলো ব দুজনে একটা জায়গায় বসলে ভালো লাগলে। শিহাব ভেবে নিলো উত্তরায় টেবিল টপ রেস্তোরাঁয় বসে বিকেলের চা খেয়ে নিবে।জায়গাটা শিহাবের খুবই পছন্দের। উবার হাউজ বিল্ডিংয়ে মাস্কাট প্লাজার রোডে ঢুকতেই শিহাব ড্রাইভারকে টেবিল টপ রেস্তোরাঁয় থামতে বললো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much