একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা নিয়ে কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন " চলবে...
মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"
টানাপোড়েন ৬০
চিন্তামুক্ত
আজ সকাল থেকেই শরীরটা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে মনোজের। মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। আজ রেখা যদি পাশে থাকতো? আজ খুব রেখার কথা মনে হচ্ছে। বাপের বাড়ী গেছে বলে আমাকে ভুলেই গেল। হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে। মনোজের ইচ্ছে করছে না ফোনটা তুলতে। আবার ফোন বেজে উঠল।
এবার মনোজ বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
অপরপ্রান্ত থেকে কণ্ঠ ভেসে আসলো ' কি করছো?'
মনোজ বুঝতে পারল রেখার গলা নয়, কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। শরীরটা ভালো নেই বকবক করতে আর ইচ্ছে করছে না। শণি যেন মনোজের পেছন ছাড়ছে না।
অপরপ্রান্ত থেকে আবার বলল'কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছ না যে?'
মনোজ বললো ' কি উত্তর দেব?'
তিথি বলল 'যা জিজ্ঞেস করলাম।'
মনোজ বললো 'শুয়ে আছি।'
তিথি বলল' কি ব্যাপার অফিস যাও নি।'
মনোজ বলল 'না'।
তিথি বলল 'যাক ,তাহলে একটু মন খুলে কথা বলতে পারবো। নইলে তো শুধু কাজের দোহাই।'
মনোজ বললো 'আমার কথা বলার মানসিকতা নেই।'
তিথি বলল' কেন তোমার পাশে বউ আছে বুঝি?'
মনোজ বলল' তা আমার যখন বউ আছে। সে তো থাকবে , এটাই স্বাভাবিক নয় কি? এক প্রশ্ন কেন রোজ করো?'
তিথি বিরক্তির সঙ্গে বলল' বৌ এর কথা বললে তোমার গায়ের এত ফোসকা পড়ে কেন বল তো?'
মনোজ বলল' তোমাকে হাজার বার বলেছি যে রেখা সম্পর্কে তুমি কোন কথা বলবে না। তোমার মুখে মানায় না।'
তিথি বলল 'তাহলে এবার আমার কথা বলি?'
মনোজ বলল 'আমি তো তোমাকে বললাম, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।'
তিথি বলল 'তা বললে তো হবে না।তুমি রোজ আমাকে এভোয়েড করবে ?এটা তো আমি মেনে নিতে পারব না।'
মনোজ বলল 'এই তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না। তোমার সাথে আমার কোন লেনাদেনা নেই।'
তিথি বলল' তাই নাকি?'
মনোজ বললো' হ্যাঁ,তাই।'
তিথি বলল'কেন তুমি রেগে যাচ্ছ বল তো?
রাগার মতো তো আমি কিছু বলি নি।'
মনোজ বলল' তুমি যখন কথা বলো ,তখন রাগার মতই কথা বলো।'
তিথি বলল'তাহলে তোমার কাছে কিছু পার্সেল যাবে তখনই বুঝতে পারবে?'
মনোজ বললো 'পারসেল??'
তিথি বলতো 'আমাদের কিছু ঘনিষ্ঠ মু'হূর্তের?'
মনোজ বলল 'ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে কবে..?
তিথি বলল 'তুমি যদি আমার কথা মত চলো ।তাহলে আমি এসব কিছুই করবো না।'
মনোজ এবার একটু ভয় পেয়ে গেল তবে কি কলেজ লাইফে এক্সকার্শন এর সেই ফটোগুলো..
মনোজ একটু নরম হয়ে বলল 'দেখ তিথি নতুন করে তুমি আমার জীবনে আর কোন ঝামেলা বাধিয়ো না ।আমি যখন সংসারী হয়েছি ।তুমি তোমার মত সেটেল হবে না কেন ?তুমি আমার পেছনে কেন পড়ে আছ বলো?'
তিথি বললো 'এখন তো বেশ মিষ্টি মিষ্টি করে বলছো?
এমনি তে আজকে আমার শরীরটা খুব খারাপ আমি অফিস যেতে পারি নি। আমার বকবক করতে ভালো লাগছে না।
তিথি বলল'' বেশ আমি আজকে ফোনটা রাখছি?'
মনোজ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কি মাছের কাঁটা যে ফুটল কিছুতেই বেরোচ্ছে না ।এ যে কি যন্ত্রণা ?কাকে বোঝাবো? (মনে মনে ভাবতে লাগল।)
ফোনটা কেটে কেটে দেওয়ার পর আবার রেখার কথাই ভাবতে লাগলো। গতকাল কতবার রেখাকে ফোন করা হয়েছে ফোনই ধরল না। ওকি এখানকার কথা সব ভুলে গেল। মিলিদের নিয়ে এত ভাবে অথচ ওদের খোঁজ টা পর্যন্ত নেওয়ার সময় নেই।
এর মধ্যেই মিলিদের আওয়াজ পাওয়া গেল চিৎকার করছে খাবার জন্য।
যাক তবুও আজ সুমিতা কাজে এসেছিল ওকে দিয়ে ওদের খাবারটা করিয়ে নেওয় হয়েছে ।তাই নিশ্চিন্ত ।ভোরবেলা টুংটাং করে ফোনটির আওয়াজে মাথাটা ধরেছিল। মাথা তোলা যাচ্ছিল না ।
এখন যে ভাবেই হোক উঠে ওদেরকে খাবার দিতে হবে অবলা জীব ওরা তো বুঝবে না?
মনোজ আস্তে আস্তে উঠলো। তারপর বাচ্চাদের জন্য দুধ রুটি ভালো করে মেখে খেতে দিল।
অন্যদিকে রেখা বাড়িতে ফিরে কাকিমাকে জিজ্ঞেস করলঃ' কার ফোন এসেছিল গো কাকিমা?'
কাকিমা তখন রান্নাঘরে মাংস কষাচ্ছিল। পেঁয়াজ রসুন আদা ও মসলার ভালো গন্ধ বেরিয়েছে। কড়াইতে খুন্তির টুং টা্্ আওয়াজ হতে লাগল।
রেখা রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে বলল 'ও কাকিমা, এত জরুরি তলব করেছিলে কেন ভোলা কাকাকে দিয়ে?'
কাকিমা বললেন 'আরে তোর কতবার ফোন এসেছে জানিস?'
রেখা বলল' কে করেছিলো ফোন?'
কাকিমা বললেন 'তা তো দেখি নি?'
কাকিমা বললেন 'সকাল থেকে ফোন দেখার কি আমার সুযোগ আছে বল?'
এর মধ্যে বেসিনের জলের কোলটা ছেড়ে দিয়েছে তো হোস হোস শব্দে জল বেরোচ্ছে। রেখা রান্নাঘরে ঢুকে কাকিমাকে বললো' কি ভালো গন্ধ বেরোচ্ছে কাকিমা ।একটু ঘ্রাণ যেন ভেতরে নিয়ে নিল। গন্ধেই অর্ধভোজন।
কাকিমা বললেন 'তোর জন্য একটু কষা মাংস তুলে রাখলাম খাবি?'
রেখা খুব খুশি হয়ে বলল 'তাই বুঝি? দাও দাও দাও আমার জিভ থেকে জল পড়ছে টস টস করে।'
কাকিমা বললেন 'আমি জানি তো?'
রেখা বলল 'তুমি এতজনের কথা মাথায় রাখ কাকিমা ?আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।'
রেখা কষা মাংসের বাটিটা তুলে নিয়ে খুব মিস করেছি বলতে লাগলো। আর বলল' কাকিমা সত্যিই যেমনি সুন্দর তুমি রান্নাও করো, তেমনি তোমার সুন্দর ব্যবহার।'
কাকিমা গ্যাসটা সিম করে দিয়ে বলল' ,আমি ওদিকে যাচ্ছি। ননী তুই রান্না ঘরে আছিস তো?'
রেখা বলল 'তুমি না থাকলে আমি রান্না ঘরে একা একা থাকবো ?আমার ভালো লাগবে না।'
রেখা বেশ আয়েশ করে কষা মাংসটা খেতে লাগলো।
কাকিমা বললেন' ননী কার ফোন এসেছিল একটু দেখে নেে।'
রেখা খেতে খেতে বলল' হ্যাঁ দেখে নিচ্ছি। একটু হুঁশ হাস শব্দ করে বলল ও কাকিমা তোমার হাতে জাদু আছে।'
কাকিমা বললেন "কিরে ঝাল হয়েছে?'
রেখা বলল 'না ,না ,না । বোধহয় একটু ওই চেরা কাঁচালঙ্কা মুখে লেগেছে।'
কাকিমা একটু চিন্তিত ভাবে বললেন 'তাই বল ঝাল হলে তো তোর কাকু খেতে পারবে না।'
রেখা মুখটা ধুয়ে এসে দোপাট্টায় হাত মুছতে মুছতে বলল ' দেখি কে ফোন করল?'
রেখা ঘরে গিয়ে ফোন খুঁজতে লাগল। যেখানে ফোনটা ছিলো ,সেখানে না পেয়ে ঘর থেকে বলল 'কাকিমা ,কাকিমা। ও কাকিমা?'
কাকিমা গেটের ধারে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন ,ওখান থেকে উত্তর দিলেন' কি হলো রে ননী?"
রেখা বলল বাইরে বেরিয়ে এসে' ও কাকিমা ফোনটা কোথায়?'
কাকিমা বললেন' না ওই দেখ ভোলাকে বলেছিলাম ফোনটা ধরতে। না ধরে ফোনটা কোথায় রেখে গেছে ,দাঁড়া দেখছি।'
কাকিমা ঘরে এসে এদিক ওদিক ঘুরে ফোন পেলেন ফ্রিজের উপর।
কাকিমা বললেন 'এই দেখ ভোলার কাজ, ব্যাটাকে যা বলব তার উল্টো কাজ করবে জানিস?'
রেখা ফোনটা বের করে দেখছে স্কুল থেকে বড়দির ফোন, রিম্পাদির ফোন, মনোজের ফোন।
রেখা ভাবল বড়দিকে ফোন করা যাবে না ।ফোন করলেই কিছু-না-কিছু কাজের কথা বলবেন।
তার চেয়ে মনোজ ও রিম্পা দি কে ফোন করা যাক।
রেখা প্রথমে ফোন করল মনোজকে। মনোজের ফোনে রিং হয়ে যাচ্ছে। ফোন তুলছে না কেন? আবার ফোন করল। এবারও রিং হয়ে কেটে গেল। এবার খুব চিন্তা হচ্ছে রেখার। মনোজ কোন অসুবিধায় নেই তো? ঠিক আছে তো? ছি ছি ছি ছি কাল থেকে মনোজের কোন খবর নি। এটা একদম ঠিক কাজ হয় নি। এখানে এসেছে কি হলো বুঝে উঠতে পারছে না রেখা।'
আবার ফোন করল রেখা। এবার মনোজ ফোন তুলে কাতর কন্ঠে বলল 'হ্যালো'
রেখা বলল'কি হয়েছে তোমার? এভাবে কথা বলছ কেন?
মনোজ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো ।একটু অভিমান মনের ভেতরে দানা বেঁধেছে।
রেখা আবার বলল 'কি গো ,কি হয়েছে তোমার?
ঠিক আছ তুমি? শরীর খারাপ?'
মনোজের মনে মনে খুব রাগ হল। কালকে এতবার ফোন করা হল ফোন ধরল না ।আর এখন জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে তোমার? কিন্তু কথাটা চেপে রেখে বলল' হ্যাঁ, জ্বর এসেছে। প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা।'
রেখা বলল 'ডাক্তার কাকুকে ফোন করেছিলে? ওষুধ খেয়েছো?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ, খেলাম।'
রেখা বলল'কিন্তু তোমার পাশে তো এখন একজনকে থাকার দরকার। চৈতির মা কে বলবো?'
মনোজ বলল 'না, না।'
রেখা বললো 'তাহলে কি করে হবে বলো ?রাত্রে জ্বর বাড়লে তখন কি করবে?'
মনোজ বলল' কিচ্ছু হবে না।'
রেখা বললো 'তাহলে পার্থকে ফোন করি ,।ও থাকুক এসে।'
মনোজ আবার বলল 'ওসব কিছু লাগবে না রেখা?'
রেখা বললো 'তাহলে কি লাগবে তোমার?'
মনোজ বলল 'তুমি?''
রেখা বলল'এই ইয়ার্কি মেরো না তো?'
মনোজ বললো 'ও আমার কথা তোমার ইয়ার্কি মনে হচ্ছে ।ঠিক আছে। তাহলে চুপ করলাম।'
রেখা বলল' শোনো তোমার এখন মাথা কাজ করছে না ।আমি পার্থকে ফোন করে দিচ্ছি।'
মনোজ বলল 'তুমি কি আসবে না ?ওখানেই থাকবে?'
রেখা বলল 'বা রে ,তুমি গাড়ি পাঠাবে ।তারপর তো যাবো?'
মনোজ বলল''এখন গাড়ি পাঠাবো?'
রেখা বলল 'পাগল নাকি ?তুমি এখন গাড়ি পাঠাবে ।আমি কখন ফিরব?
শোনো কিছু খেয়েছো?'
মনোজ বলল'খেতে ভালো লাগছে না।'
রেখা বলল 'আমি পার্থকে ফোন করে দিচ্ছি। ও কিছু খাবার নিয়ে যাবে।'
রেখা ফোন কেটে দিয়ে পার্থর ফোন নম্বর*৫৬৭৮ ডায়াল করলো।
পার্থ ফোন ধরে বলল' হ্যালো'।
রেখা বলল 'আমি রেখা বৌদি বলছি।'
পার্থ সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিল ,হঠাৎ তড়িৎ করে উঠে পড়ে বলল'বৌদি বলুন?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ, বলছি ভাই ,আজকে একটু তোমার দাদার কাছে গিয়ে থাকতে পারবে ? যদি তোমার কোন অসুবিধা না থাকে?'
পার্থ বলল 'না সেরকম কোনো অসুবিধে নেই ।কেন কি হয়েছে বৌদি?'
রেখা বললো' আসলে ওর খুব জ্বর এসেছে ।একজন থাকা দরকার?'
পার্থ বলল 'না ,না ,না ।আপনি চিন্তা করবেন না ।আমি যাব।'
রেখা বলল 'অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।'
পার্থ বলল 'না 'না ,বৌদি ।এভাবে কেন বলছেন ?আমরা তো প্রতিবেশী পাশাপাশি থাকি ।এটুকু না করলে হয়?'
রেখা বলল'আর একটা কাজ দেবো?'
পার্থ বলল 'বলুন?'
রেখা বলল 'একটু দাদার জন্য তরকা রুটি নিয়ে যেও।জ্বরের মধ্যে এটা খেতে খুব ভালোবাসে?'
পার্থ বলল 'আপনি কোন চিন্তা করবেন না বৌদি ।আমি রাত্রিতে আপনাকে পরে ফোন করে জানাবো ,কেমন আছে দাদা ।কেমন?'
রেখা বললো 'তুমি আমাকে চিন্তামুক্ত করলে ভাই ।ভালো থেকো।'
পার্থ বলল 'আপনিও ভালো থাকবেন বৌদি।'
ফোন কাটার পর কাকিমা বললেন' কি হয়েছে রে? জামাইয়ের কিছু হয়েছে?'
রেখা বলল' ওর খুব জ্বর কাকিমা?'
কাকিমা বললেন''খুব চিন্তার ব্যাপার রে ।একা বাড়িতে থাকে?'
রেখা বলল ''না, পাশের পার্থকে বললাম থাকতে?'
কাকিমা বললেন 'বেশ করেছিস ,।তাহলে একটু চিন্তা মুক্ত হওয়া গেল।'
মণোজ ও রেখার কথা গুলো খুব বাস্তব লাগলো। পড়েও খুব সুন্দর লাগলো।
উত্তরমুছুন