৩০ নভেম্বর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী। ৫৭

কান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক।  তার নিত্যদিনের  আসা  যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা  নিয়ে  কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন  চলবে...
 মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"




টানাপোড়েন (৫৭) 
'জিহুড়'

বাপরে বাপ আজকের বিকেলটা যা কাটলো। রেখা কিছুতেই ভুলতে পারবে না। মনের ক্যানভাসে সারাজীবনে আঁচড় কেটে যাবে। বাড়িতে ফিরে এসে কাকুর কাছে বসে বসে রেখা এসবই ভাবছিল। 
হঠাৎই কাকু বললেন  'কি রে ননী ? আজকে তো তোর গ্রাম ঘোরা হল না।'
রেখা বলল  'দূর কাকু, তুমি ছাড়ো তো ।আজকে কাকিমা যে কাজটা করেছে ,সত্যিই প্রশংসনীয়। স্যালুট জানাই কাকিমাকে?'
কাকু বললেন  'কেন রে ,তোর কাকিমা কি করেছে এমন?'
রেখা বললো ' কি করে নি সেটা বলো?'
কাকু বললেন  'তাহলে বল শুনি?'
রেখা বলল ' ডিটেলসে বলব না ।শুধু এইটুকু জানো কাকিমার মতো নারী যদি এইরকম গ্রামে আরো দুজন চারজন থাকে বা প্রতি বাড়িতে থাকে তাহলে কিন্তু সেখানে অন্যায় কাজ কিছুতেই হতে পারবে না ।মানবিকতার চরম বিকাশ ঘটবে, মনুষ্যত্ব অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবে?'
কাকু বললেন  'বাপরে বাপ ।কিন্তু খুব ভারী ভারী কথা শোনাচ্ছিস?'
রেখা বললো 'সেটাই জানো।'
কাকু বললেন  'মীনাক্ষী সহজ-সরল। প্রতিবাদী হয়ে উঠলো কবে?'
রেখা বলল 'আজকে যদি কাকু তুমি যেতে পারতে, বুলু জেঠিমাকে মনে হচ্ছে তার ছেলে, ছেলের বউ তাকে মানসিক রোগী করে রেখেছে। আজকে তা হাতেনাতে প্রমাণ হয়েছে ।সেই  দুঃসাধ্য কাজটা কে করেছে জানো? ঝাঁসির রানী কাকিমা?'
কাকিমা রান্নাঘর থেকে বললেন' নে অনেক হয়েছে ।আর তার বর্ণনা করতে হবে না।'
রেখা বলল 'এটা বর্ণনা করার মতোই বিষয় কাকিমা।'
রান্নাঘর থেকে কাকিমা গরম কফি আর ফুলকপির পাকোড়া নিয়ে এসে হাজির । বললেন'সন্ধ্যেবেলায় কফি খেয়েএকটু গরম করে নাও।'
কাকু মজা করে বললেন 'আজকে তুমি কি খেয়ে গেছিলে?'
কাকিমা বললেন ' হ্যাঁ রে  ,ননী।তোর কাকু আবার কি কথা বলে? কি খেয়েছি ?তোমরা যা খেয়েছ আমিও তাই খেয়েছি।'
কাকু বললেন  'না ,তাই বলছি।'
কাকিমা বললেন' কেন বললে?'
রেখা বলল 'থামো ,থামো ।তোমরা নিজেদের মধ্যে আর কথা বাড়িয়ো না।'
কাকিমা বললেন' যাই বলিস ননী। আমার কিন্তু মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল রে।'
রেখা বলল'কেন কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'আজকে তোকে ঘোরানোর কথা ছিল গ্রামটা। পারলাম না ।কে জানত কপালে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটবে?'
রেখা বলল' এটা কে দুর্ঘটনা ব'লো না কাকিমা। যে কাজটা তুমি করেছ ,যদি সেটা না করতে পারতে সেটাই দুর্ঘটনা হতো।'
কাকিমা বললেন,'সত্যিই বুলুদিকে দেখে আমি না নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না ।কোথা থেকে যে আমার মনে এত বল এসে গেল ,এত আমি শক্তি কোথায় পেলাম ,ঈশ্বর জানেন? (দুই হাত কপালে ঠেকালেন)
কাকু বললেন 'তোমার ভেতরে ঐ শক্তিটা ছিলো সুপ্ত অবস্থায় ।অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।'
রেখা বলল, আচ্ছা কাকিমা বুলু জেঠিমার বাবার বাড়ি কোথায় ছিল যেন?'
কাকিমা বললেন 'পুরুলিয়ায় ।কেন রে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করছিস?'
রেখা বলল,ছোটবেলায বুলু জেঠিমার কাছে গল্প শুনতাম ।পুরুলিয়ায় সে একটা কি উৎসব আছে না?ওখানকার লৌকিক উৎসব, আরে ছাই নামটা ভুলে গেছি।'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁরে ওখানকার শস্যকেন্দ্রিক মা লক্ষ্মীর পুজো।
রেখা বলল একদম ঠিক বলেছ। কিন্তু নামটা যেন কি?
কাকু বললেন 'জিহুড়'উৎসব।
রেখা ও কাকিমা দুজনেই বলে উঠলো হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ঠিক।
কাকু বললেন' কি রে ননী ।আমার স্মৃতিশক্তিটা কতটা প্রখর বল?'
রেখা  বলল 'তা আর বলতে?
এবারে বায়না ধরল'কাকিমা ও কাকিমা উৎসব সম্পর্কে বলো না একটু ।ছোটবেলায় অনেক শুনেছিলাম বুলু জেঠিমার কাছে। আবার জানতে ইচ্ছে করছে।
কাকিমা বললেন '  আরে বাবা বললাম না, ওটা 'শস্যকেন্দ্রিক মা লক্ষ্মীর পুজো।'
রেখা বলল 'সে তো বুঝলাম ।এই প্রসঙ্গে ওদের একটা লৌকিক কাহিনী আছে ,সেটা বল।'
কাকিমা কফিতে চুমুক দিলেন তারপর বললেন কথিত আছে গর্ভবতী মহিলাকে যেমন প্রসবের আগে সন্তান মায়ের মঙ্গল কামনায় ৭মাস কি ৯মাস সময়ে সাধ খাওয়ানো হয়,...,।
কথা শেষ না হতেই কাকু বললেন' তেমনি জিহুড় হলো  লক্ষ্মী দেবীর সাধ ভাত। তাই তো মীনাক্ষী?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ একদম তাই।'
রেখা বললো-তারপর?
কাকিমা বললেন 'এই সময় আমন ধান পাকতে শুরু করে ।তাই ফসল যাতে ভালো হয় সেই উদ্দেশ্যেই পূজার সূচনা।'
কাকু বললেন 'এই সময় পুজোয় গ্রামের মহিলা ও পুরুষরা প্রত্যেকে অংশগ্রহণ করে। তবে..?
রেখা বলল 'তবে আবার কি?'
এমন সময় রেখার ফোন বেজে ওঠে।'দুর্গে ,দুর্গে ,দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী'।
রেখা বলল 'তারপর!'
কাকিমা বললেন  'সমস্ত পুজোটি কিন্তু পুরুষদের দ্বারা সম্পন্ন হয়। '
রেখা বলল  'কি অবাক কান্ড! মেয়েরা কি করে আর পুরোহিতের ই  বা কি কাজ?'
কাকিমা বললেন 'এদের পুরোহিত লাগে না। মহিলারা মায়ের প্রসাদ তৈরীর কাজ করেন।'
কাকু বললেন  'সাধারণত পরিবারের কোনো পুরুষ স্নান করে নুতন বা শুদ্ধ বস্ত্র পরে চাষের জমিতে যান ।তার সঙ্গে অবশ্য পূজোর জিনিসপত্র নিয়ে যান আরেকজন।'
রেখা বলল 'সেখানে গিয়ে কি করে?'
কাকিমা বললেন,'আমাদের ননী তো একদম ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গেল গো?'
কাকু বললেন  'ও তো আমাদের বাচ্চাই ।যত বড়ই হোক না কেন? ওরা আমাদের সন্তান।ওরা তো ছোটই থাকবে না?'
কাকিমা বলেন 'তা অবশ্য ঠিকই বলেছ।'
রেখা বল  'তারপরে বল?'
কাকু বললেন  'ধানের জমিতে মায়ের উদ্দেশ্যে পুজো দেয়া হয়।'
কাকিমা বললেন 'এই সময় ধানের জমিতে মায়ের উদ্দেশে ধূপ জ্বেলে মন্ত্র পাঠ হয় তারপর আতপ চাল ,ঘি ,সিঁদুর ৭বি ৯ রকমের সবজি মিষ্টি পুজোর উপকরণ হিসেবে নিবেদন করা হয়।'
আবার রেখার ফোন বেজে উঠলো। কাকিমা বল,,ফোনটা ধর।'
রেখা বলল 'এই সময় আর ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না'। ফোনের ভাবনা থেকে দূরে থাকতে চাইছি'ভুলিবো ভাবনা পেছনে চাবো না...?'
কাকু বললেন ' গা না গানটা ঠিক করে।'
রেখা বলল' না ,না, না ।এখন পুরুলিয়ার উৎসব।
কাকিমা বললেন 'জরুরী ফোন ও তো হতে পারে?'
রেখা বলল " তারপর বলো তো তুমি?'
কাকু বললেন' তারপর সেই জমিতে পুজোর পর প্রসাদ একটা পিতলের পাত্রে মেশানো হয়।'
রেখা বলল" দারুন ব্যাপার তো?'
কাকিমা বললেন "এই পুজোকে কেন্দ্র করে ওখানকার গ্রাম বাংলার মানুষ আহ্লাদে মেতে ওঠে।'
রেখা বললো এটা যেন কোন সময় হয়?
কাকু বলে ওই তো আমন ধান যখন পাকতে শুরু করে। অক্টোবর মাসের দিকে হয়।'
রেখা বলল 'ছোটবেলায় বুলু জেঠিমাকে দেখতাম নীলু দা ,লাল দা ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতেন বাবার বাড়িতে। একবার  ওই জিহুড় উৎসবে যাই।
কাকিমা বললেন' কখনো তো বলিস নি একথা?'
রেখা বলল 'মায়ের ভয়েতে বলি নি।'
রেখা বলল 'ও বুলু জেঠিমা কি আর আগের মত না?'
কাকিমা বললেন দেখ এখন দিনকাল পাল্টেছে বাবা-মা মারা গেছে বাবা-মা না থাকলে ছেলেমেয়েদের কদর কোথায় বল তাছাড়া বুলাদির সংসারের দায়-দায়িত্ব বেড়েছিল যাওয়াটা খুব কমই হত।
কাকু মজা করে বললেন ' কেন আমাদের ননী কি আবার যেতে চায় নাকি?'
রেখা বলল'বুলু জেঠিমা যদি সুস্থ হয়ে ওঠেন, কখনও যদি সময় হয়, তখন উৎসবের সময় যাবার ইচ্ছে থাকল।'


কাকিমার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন আমরা সবাই মিলে এই প্রার্থনাই করতে পারি বুলুদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
কাকু বললেন 'বুলু বৌদি সত্যি এত সৌখিন আর এত আন্তরিক কেউ একবার বাড়িতে গেলে তাকে কিছু না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়তে নারাজ,। বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
কাকিমা বললেন' এর শেষ দেখে ছাড়বো ।জানিস  ননী?চোখের সামনে এই মানুষটাকে তিলে তিলে এইভাবে মরে যেতে দেখতে পাচ্ছি না।'
রেখা বলল একদম ঠিক বলেছ।
কাকিমা বলল ,দেখেছিস লাল আর ওর বউ কত্ত বড় শয়তান ।নীলকে জানিয়েছে কি না ব্যাপারটা বলাতেই কেমন পাশ কাটিয়ে গেল।'
রেখা মাথা নেড়ে বলল 'হ্যাঁ ঠিক বলেছিস?'
কাকিমা বললেন' না হলে নীল আমাদের ঐরকম ছেলেই নয় ।ও  মা অন্তপ্রাণ ছিল ?
আর সেই ছেলে আজ কতদিন হলো বাড়িতে আসে না ।বিদেশ বিভূঁইয়ে আছে কি করছে কে জানে?,'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much