৩০ নভেম্বর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী ৫৯

কান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক।  তার নিত্যদিনের  আসা  যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা  নিয়ে  কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন  চলবে...
 মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"




টানাপোড়েন (৫৯)
স্মৃতিমেদুর দিন


গোধূলি বেলায় নদীর ধারে চারিদিকে সবুজের সমাহার ম্লান সূর্যের আলো জলের উপর পড়ে নানা রকম চিত্র অংকিত হচ্ছে ।আপন মনে রেখা চলে গেল সেই নদীর ধারে ।যেখানে শৈশব, বাল্য ,কৈশোর কেটেছে সেই স্মৃতিমেদুর জায়গায় গিয়ে বসেছে আজ রেখা। কত না বলা কথা রয়ে গেছে মনের অজান্তে। আজ বলতে ইচ্ছে করছে আকাশ বাতাস নদীকে সাক্ষী রেখে । নদীর ধারে বসে আপন মনে পাদুটোকে জলে ডুবিয়ে দিয়ে জলকেলি করতে করতে ভাবছিল ভুল করেছে বর্তমানের কথা বর্তমানে বলতে হয় ।কালকে বললে তার কোন মূল্য থাকে না ।শোনার লোকও থাকে না। মনের গভীরে শুধু থেকে যাবে প্রিয় মানুষকে বলার না বলা কথা।
পরক্ষণে রেখা ভাবছেন কেন এসব ভাবছে রেখা।
স্বামীর সংসার জীবনে ভালোই আছে। তবে তার মনে কি কোন ক্রাইসিস রয়েছে ,যার জন্য আজ বারবার তার শৈশব বিজড়িত গ্রামে এসে পুরনো দিনের কথা বেশি করে মনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।
হঠাৎই মনে পড়ে গেল নীলদার কথা। নীলদা বলেছিল
'কি রে ননী নদীর ধারে একা বসে পা দুটোকে জলে ডুবিয়ে কার কথা ভাবছিস?
অমনি রেখা সেদিন বলেছিল' কার কথা আবার ভাববো ?'
নীল দা বলেছিল 'ও তাই বুঝি? তাই  তুই একা একা এখানে এসে বসেছিস?'
রেখা বলেছিল' কেন জায়গাটা কি শুধু তুমি একাই এসে বসতে পারো?'
নীলদা বলেছিল' তুই এখন তো বড় হচ্ছিস। যেখানে সেখানে একা একা যাবি কেন? ওয়েট কর কাকিমাকে গিয়ে সব বলছি।'
কতবার এভাবে নীলদা রেখাকে রাগিয়ে দিত। কখনো কখনো রেখা ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যেত। কারণ রেখার মা এ ব্যাপারে ভীষণ কড়া ছিলেন। শুধুমাত্র কাকিমা 'জেঠিমা, জেঠুদের আদর,আহ্লাদ দেবার জন্য মা বেশি কিছু বলতে পারতেন না।
যখন রেখা ফুঁপিয়েকেঁদে উঠত।
ঠিক তখনই নীলদা গিয়ে বলতো 'পাগলি কোথাকার। 'আমি কাকিমাকে গিয়ে বলব তোর কথা? কি সুন্দর আমরা দুজন এখানে  এসে গল্প করব। নদীতে ঢিল ছুড়ে  কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে দেখতেই থাকব। কত ভালো লাগে বল।'
রেখা তখন বলতো 'তুমি আমার সাথে দুষ্টুমি করছিলে?' বলেই নীলদার পিঠের উপর দু চার ঘা মারতো।
নীলদাও তারিয়ে তারিয়ে মার খাওয়াটা উপভোগ করত।
রেখা গাল ফুলিয়ে বলতো 'তোমার সাথে আর কথা বলবো না?'
নীলদা অমনি পকেট থেকে নারকেলের নাড়ু বা তিলের নাড়ু বের করে বলতো ' কাল এগুলো পাবি না।'
রেখা এই নাড়ু খেতে খুব ভীষণ ভালোবাসতো।
তখনই বলতো 'নীলদা, না না না তুমি আমাকে ওই গুলো দাও।'
নীলদা বলতো 'তাহলে বল কথা বন্ধ করবি না তো?'
রেখা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাত।

আজ কত বছর হয়ে গেছে নীলদার সাথে কোন যোগাযোগ নেই ।কিন্তু মন থেকে  তাকে কিছুতেই সরিয়ে দিতে পারে নি রেখা। মনের কোনে যেন কোথায় আলাদা একটা সফট কর্নার তৈরি করে রেখেছে।তাই আজ ঘুরে ফিরে শুধু নীলদার কথাই মনে হচ্ছে ।
এমন সময় ভোলা কাকা এসে ছুটতে ছুটতে এসে চেঁচিয়ে বলল 'মামনি তুমি এখানে বসে আছো , ওদিকে তোমার বাড়িতে ডাক পড়েছে।
রেখার হঠাৎই চমক ভেঙ্গে বলল ' আমায় কেন গো ?ভোলা কাকা।'
ভোলা কাকা বলল ' জানি না তো মামনি।'
রেখা বলল 'একটুখানি যে এসে বসব নিরিবিলিতে সে উপায়ও নেই ।'
 কাকা বলল 'তুমি আজকে ফোন নিয়ে আসো নি?'
রেখা বলল'ফোন আনলে ফোনের আওয়াজে বিরক্ত লাগে।আজ শুধু নিজেকেই জানার জন্য এখানে এসে বসেছি।'
ভোলা কাকা বলল' তোমায় অনেক বার ফোন বেজেছে ।এই জন্যই ছোট বৌদি তোমার কাছে পাঠালো।'
রেখা বলল 'কে ফোন করেছে?'
ভোলা কাকা বলল ' সে তো বলতে পারব না মামনি।'
রেখা বলল  'ঠিক আছে ।যাচ্ছি।'
ভোলা কাকা বললেন  'না তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছে ।চলো।'
রেখা বলল  'আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি আমি কি যেতে পারবো না ভোলা কাকা?'
ভোলা কাকা বলল 'ছোট বৌদির নির্দেশ আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না। আমার সাথে চলো।'
রেখা আবার চলে গেল সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়।
একদিন চারিদিকে অন্ধকার আর মাতাল বৃষ্টি ।নীল বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিল বেড়াতে । বেড়াতে বলাটা ঠিক হবে না। একটা কাজে গেছিল। ৪-৫ দিন দেখা হয় নি রেখার সাথে। তাই বৃষ্টিতে ভিজে  যখন রেখার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল ।গ্রামের রাস্তায় অসম্ভব  পিচ্ছিল রাস্তা ছিল ।তার ওপর কাদা ।অনবরত  পা ,মাথা দিয়ে টপটপ করে জল পরছিল । গায়ের পোষাক ভিজে একাকার। ভিজে জামা কাপড়ে একটু শীত শীত করছিল। বাজারের কতগুলো ঘর বৃষ্টির ছাঁট ঢুকবে বলে একটু করে নামানো ছিল ।বাজারের লোক নেই। দু একজন লোক ছিল। তাদের মধ্যে কেউ বিড়ি বাঁধছিল ,কেউ রাখি করছিল।কেউ হিসেব  করছিল। এসব পার করে হঠাৎ করে এসে হাজির হয়েছিল রেখাদের বাড়িতে।
দরজার কাছে এগিয়ে ডাকছিল 'কাকিমা ,কাকিমা?'
রেখার মা সাড়া দিয়ে বলেছিল 'কি হয়েছে নীল?'
নীল নিরুত্তর দেখে গেটের দরজা টা খুলে ভেতরে আসতে বলে রেখার মা। 
 নীল ভিজে একশা হয়ে গেছে ।এক্ষুনি ওর চেঞ্জ করার দরকার জামাকাপড় ।
সেদিন অবশ্য রেখার মা কিছু বলেন নি কারণ নীলের মা বাড়িতে ছিলেন না।
রেখা পাশের ঘরে ছিল হঠাৎ এই নীলের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ভেতরে ভেতরে একটা ধুকপুকানি শুরু হয়েছিল।
কতদিন যেন নীলকে দেখেনি প্রায় একযুগ সমান হবে। আসলে নীল এসেছিল রেখাকে দেখার জন্য।
এই কদিনের অনুপস্থিতিতে রেখা কতটা চেঞ্জ হয়েছে রেখা কেমন দেখতে হয়েছে সেইসব ভাবনায় মশগুল ছিল।
তাই রেখা যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে, নীল এক ফাঁকে এসে রেখাকে দেখে নিয়েছিল ।ইশারায় কথা বলেছিল। বৃষ্টির সন্ধ্যায় আর মায়াবী আলোয় রেখার টুকটুকে ফর্সা গাল দুটো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল।
আসলে এই কদিনে একদিন ও  নীলকে দেখতে পায় নি ।তাই তার মনের ভেতরে  ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল খুব। কিন্তু নীলকে দেখার পর রেখার মন প্রাণ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর একরাশ অভিমান এসে গ্রাস করে।
খুব রাগ হয়েছিল নীল এর উপর কিন্তু রেখা প্রকাশ করতে পারে নি।
উল্টে নীল যখন রেখাকে বলেছিল তাকে কখনো মিস করে কিনা ? রেখা নিরুত্তর ছিল। এরইমধ্যে রেখার মা নীলকে হাঁকডাক করতে থাকে বলেন '  নীল
নীল খাবে এসো?'
নীল বলেছিল  :না ,কাকিমা খাব না?'
রেখার মা বলেছিল 'কেন?'
নীল বলেছিল ' বাড়িতে গিয়ে খাব।'
রেখার মা একটু অবাক হয়ে বলেছিলেন'দিদি বাড়িতে নেই। তাই বলে  আমরা কি বানের জলে ভেসে গিয়েছি।'
মিলার কোন কথা বাড়াতে পারে নি।
হঠাৎই নীল রেখাকে একটা শাখের আঙটি উপহার দিয়ে বলেছিল   'এই ননী আংটিটা পড়বি।'
সেই আংটি আজও সে রেখে দিয়েছে। 
এইসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ ভোলা কাকা এসে  বলল 'মামনি হল তোমার? কি এত ভাবছো বলতো ?'
রেখা বলল 'কিছু নয় তো কাকা,,।
ভোলা কাকা বলল 'তাহলে বাড়ি চলো ।ওদিকে ছোট বৌদি ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেল।'
রেখা বলল ' আসলে কাকা শৈশব ,বাল্যে কাটানো  স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছি না ।তাই বারবার সেই চেনা জায়গা গুলোতে এসে বসছি।'
স্মৃতিমেদুর দিনগুলি আজও যেন কাছে ডাকে। আজ যেন রেখার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে। এ যেন ক্লান্ত মন খুঁজেছে যখন ঘরের কোণ ,তখন যেন সে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে।রেখার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে যেন তার কাছে এসে ই  ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much