২৫ এপ্রিল ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৯৯





ধারাবাহিক উপন্যাস 

শায়লা শিহাব কথন 

অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯৯)

শামীমা আহমেদ 




এক ম্যারাথন সময় পেরিয়ে শায়লা ও শিহাবের মধুময় রাত কাটলো। সূর্যের আলোর টানে শায়লার আগে ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে জেগেই সে চারপাশে তাকিয়ে এখন বেলা ঠিক কয়টা বাজছে তা  বুঝতে চেষ্টা করলো। মনে হচ্ছে অজানা কোন দ্বীপে রাত্রিযাপন শেষে তার ঘুম ভাঙলো। শায়লার চোখ পড়লো,দেখলো, এখনো বেডসাইড টেবিলে ল্যাম্পটি জ্বলছে। শায়লা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে চাইলো।কিন্তু কিছু একটায় সে আটকে গেলো। শায়লা দেখলো ঘুমন্ত শিহাব তার দু'বাহুতে শায়লাকে বেঁধে রেখেছে। সেদিকে তাকাতেই তার শিহাবের কথা মনে হলো! 
তাইতো ! শিহাবতো গতকাল রাতে এই বাসাতেই ছিল।শায়লার একে একে গতরাতের সবকিছু মনে পড়তে লাগলো। শিহাব তখনো অতল ঘুমে একেবারে কাদা হয়ে আছে । শায়লা খুব আলতো করে একে একে  শিহাবের দুবাহুর বন্ধন ছাড়িয়ে  বিছানা থেকে নেমে এলো।নিজের পরনের পোশাক গুছিয়ে নিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিনের সময়টা বুঝতে চেষ্টা করলো।বাইরে বেশ উজ্জ্বল সূর্যালোকে সবদিক একেবারে ঝকঝকে স্বচ্ছতায় ফুটে আছে। মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে শায়লা বুঝে নিলো বেশ অনেক আগেই সকাল হয়েছে। সে ল্যাম্পটি নিভিয়ে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দেয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি দিতেই একেবারে চমকে উঠলো!  দুপুর বারোটার ঘন্টার কাঁটা একটার দিকে চলমান। শায়লা দ্রুত ওয়াশরুমের প্রস্তুতি নিলো।ফিরে এসেই সে শিহাবকে জাগাবে। বেচারা আরেকটু ঘুমিয়ে নিক।শিহাবের কথা মনে হতেই শায়লা বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। ঘি রঙা পাঞ্জাবিতে ঘুমন্ত শিহাবের মায়াভরা মুখটার দিকে শায়লা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মনে হলো অনেক প্রচন্ড এক যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে রাজ্যবীর জয়ের আনন্দে গভীর ঘুমে ডুবে আছে। শায়লার মনে পড়ে গেলো শিহাবের সাথে পরিচয়ের   প্রথমদিনের ক্ষণটি।নেভি ব্লু জিন্স শার্টে একখন্ড সাদা মেঘের মত চাঁদ মুখের উঁকি! বাইক থেকে নেমে আসতে প্রতি পদধাপে সেদিন শায়লা ভীষণ ভালোলাগায়
আছন্ন হয়ে গিয়েছিলো।দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে শায়লাকে তা পূর্ণ গ্রাস করে নেয়। তার অমায়িক ব্যবহার আর শায়লার প্রতি অমন সুন্দর ভদ্রতা বজায় রেখে চলা শায়লাকে তার প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়েছিল। একটু একটু করে তাতে  ভালোবাসার জন্ম নেয়। আজ সেই শিহাব তার এতটা কাছে এতটা আপন হয়ে  ধর দিয়েছে।শায়লা নিজেকে একজন সুখী মানুষ ভেবে নিলো। আস্তে আস্তে খুব সন্তর্পণে  সে শিহাবের মুখের দিকে এগিয়ে গিয়ে কপালে আলতো করে তার ঠোঁট ছুয়ে দিল। এক অপার্থিব ভালো লাগা তার অন্তরের গভীরে গিয়ে জায়গা করে নিলো। শায়লা শিহাবকে না জাগিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যেতে হঠাৎ করে শিহাব চোখ মেলে তাকালো। শায়লা ভীষণ লজ্জা পেয়ে  গেলো। শিহাবের দুষ্ট চোখ শায়লাকে আরো কাছে চাইলে তাতে শায়লার সম্মতি না মেলায় শিহাব চট করে এক গাঢ় চুম্বনে শায়লাকে দখল করে নেয়।শায়লা শিকারীরজালে আটকে যাওয়া নিরীহ এক শশ শাবকের ন্যায় আত্মসমর্পণ করে নিলো। সময়ের বয়ে চলায় শিহাব স্বেচ্ছায় তার বাঁধন ছুটিয়ে শায়লাকে মুক্ত করলে তবেই শায়লা নিজের অবস্থানে ফিরে এলো। শায়লা  আর পিছনে না তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। সে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ারের জলধারার নিচে দাঁড়িয়ে রইল।পানির ঝর্ণাধারায় তার সারা দেহে  শিহাবের স্পর্শের শিহরন বয়ে গেলো।  অনেকটাক্ষণ সে চোখ  বন্ধ করে তা অবগাহনের সুখ শুষে নিলো।এক অনন্য সুখানুভূতিতে ডুবে বুঝে নিলো ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষণগুলো জীবনের সময়ের তুলনায় খুবই ক্ষনিকের। কেন তা সারাটা জীবনের প্রতিটি ক্ষন জুড়ে থাকে না ? কেন জীবনের সব অপ্রাপ্তিকে সরিয়ে বারবার একই আনন্দে বিভোর হওয়া যায় না। শায়লার দীর্ঘ সময় ওয়াশরুমে থাকায় শিহাবের খুব একা একা বোধ হতে লাগলো। সে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করতেই শায়লার খেয়াল হলো অনেক সময় ধরেই সে নানান ভাবনায় ডুবে আছে।শিহাবকে একা রেখে এসে।সে সব গুছিয়ে দ্রুতই বেরিয়ে এলো।বাইরে শিহাব তার মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রিং হচ্ছে। শায়লা তাকিয়ে দেখলো,বুবলীর কল। সে কল রিসিভ করতেই শিহাব ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। বুবলীর  আক্রমণাত্মক  কথায় শায়লা একেবারে কুপোকাত হয়ে গেলো।শায়লা বুঝতে পারে না কখন বুবলী এতটা দক্ষ একজন বক্তা হয়ে উঠলো। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্রী এরা। যেমন স্পষ্টভাষী তেমনি প্রতিবাদী।
তোমাদের আজ কি ঘুম ভাঙবে ? নাকি একসাথে দুইদিন ঘুমাবে ? 
বুবলীর এমন প্রশ্নে শায়লা কি উত্তর দিবে কিছুই খুঁজে পেলো না।আসলে শায়লার তো খুব অল্প বয়সেই  জীবন সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। মন খুলে কথা বলা বা নিজের অধিকার আদায়ের কথা বলার মত সুযোগ তার হয়ে উঠেনি।তাইতো বুবলীকে পরাস্ত করা হয়ে উঠে না। এইতো,এখুনি বেরুচ্ছি,শায়লা শুধু এটুকুই বলতে পারলো।
শিহাব ভাইয়া কোথায় ? তার জন্য কি নাস্তা হবে জানিও। তোমরা দ্রুত এসে নাস্তা করো।একটু পরতো লাঞ্চের সময় হয়ে যাবে। আপু, তোমার জন্য ঐ কেনাকাটার মাঝে নতুন শাড়ি আছে সেটা পরে নিও। আপাতত শিহাব ভাইয়ার জন্য কিছু নতুন পোশাক আনা হয়েছে। রাহাত ভাইয়া কেনাকাটা করে এনেছে। দরজা খোল আমি নিয়ে আসছি। 
কথাগুলো বলেই  বুবলী কল রেখে দিলো।শায়লা তার শাড়িটি খুজতে লাগলো।শিহাব ওয়াশরুম থেকে টাওয়েল চাইতেই শায়লা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে এখন কি করবে ? শিহাব মুখ বাড়িয়ে বললো,শায়লা তোমার চুলে বাধা টাওয়েলই আমার চলবে ওতে যে তোমার চুলের ঘ্রাণ আছে সেটাই মেখে নিবো। শায়লা ভেবে পায়না শিহাব কবে এত রোমান্টিক কথা শিখল ? কই আগেতো এমনটি শুনিনি। শায়লা এগিয়ে গিয়ে টাওয়েল দিতেই সে ফিসফিস করে বললো, শায়লা তোমাকে পেয়ে আমার নিজেকে খুব সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে যেওনা। শায়লার চোখ জলে ভরে উঠলো। শায়লার প্রতি বারবার শিহাবের এই একই আকুতি। আমায় ছেড়ে যেওনা। আমায় ছেড়ে যেওনা।তার জীবন থেকে আচমকা  রিশতিনার চলে যাওয়া শিহাবের মনে হারানোর ভয় ঢুকে গেছে। বুবলী দরজায় নক করে  ভিতরে না ঢুকেই সে শিহাবের পোশাক, টাওয়েল দিয়ে গেলো। শায়লার  ভেজা চুল থেকে তখনো পানি ঝরছে। আর তাতে  বুবলীর মুচকি হাসি যেন শায়লার ভেতরে ভীষণ  এক টিপ্পনী কেটে গেলো! উফ! মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না।শীঘ্রই এটাকে জামাই বাড়ি পাঠাতে হবে। শিহাব বেরিয়ে এসে তার নতুন পোশাক  দেখে অবাক হলো! শায়লা জানালো,রাহাত সকালে কিনে এনেছে । গাঢ় সবুজ রংয়ের সিল্কের পাঞ্জাবী আর আদ্দি কাপড়ের চোস্ত পায়জামা আর নতুন চটি স্যান্ডেলে নতুন জামাই সাজে শিহাবকে দারুণ লাগছে। শায়লা মুগ্ধ হয়ে তা দেখছিলো। শিহাব আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো।বাহ! রাহাততো ঠিক মাপেই সব কিনেছে। শিহাব মনে মনে ভেবে নিলো, এখন তার উপরেও কিছু দ্বায়িত্ব বর্তে গেলো। শায়লা ইট রঙা কমলা শাড়ি খুব পরিপাটি করে পরে নিলো। সাথে হালকা জুয়েলারী। দরজায় বুবলীর ক্রমাগত কড়া নাড়ার শব্দে শায়লা  শিহাব বুঝে নিলো তাদের দ্রুত বেরুতে হবে। নিশ্চয়ই  সবাই অপেক্ষায়।  
দুজন বেরিয়ে আসতেই বুবলী এগিয়ে এলো। রাহাত ও বুবলী দুজনকে ড্রইং রুমে নিয়ে বাসালো। সেখানে কাজী সাহেবকে বিয়ে পড়ানোর জন্য আগে থেকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে শায়লার মা, নিচ তলার রুহি খালার স্বামী আর বাড়ির অন্যান্য মুরুব্বিদের উপস্থিতিতে শায়লা ও শিহাবের বিয়ে পড়ানো হলো।  সবাই মিষ্টি মুখ করে নব দম্পতির জন্য দোয়া করতেই শায়লার মা লায়লা খানম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শিহাব শায়লার মায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তাকে বিনীতভাবে জানালো, মা আপনি কাঁদবেন না। শায়লা  আর আমার জীবনে সবকিছু একটু অন্যভাবে ঘটলো। কারো কারো জীবনের চলা এভাবেই লেখা থাকে। সবকিছু প্রথাগত নিয়মে হয় না। আপনি দুঃখ করবেন না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। শায়লাকে আপনারা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন,আমার জীবনের সঙ্গী করেছেন, আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।কেননা শায়লার মত একজন মেয়েকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।আর শায়লার কাছে থেকে আমার ছোট্ট আরাফ তার মায়ের  আদর পাবে এর চেয়ে স্বর্গীয় সুখ আর কিছু নেই।  শিহাব শায়লার মাকে সালাম করলো,মা শিহাবের মাথায় হাত দিয়ে তাকে আশীর্বাদ জানালো।
শিহাবের ছেলে আরাফের কথা শুনে আত্মীয় স্বজনের  মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো ! ও তাহলে এই ছেলে আগে থেকে বিবাহিত ছিল আবার ছেলেও আছে ! সবার কোথায় যেন আনন্দ আবেগের ছন্দ পতন হলো। রাহাত আর বুবলী বিষয়টি টের পেয়ে শায়লা আর শিহাবকে সেখান থেকে সরিয়ে ডাইনিং এ নিয়ে এলো। ওরা চারজন একসাথে বসে নাস্তা করে নিলো।  নাস্তা শেষে  শিহাব শায়লার মায়ের কাছে শায়লাকে তাদের ঝিগাতলার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলো। আর আজই সে আরাফকে সেখান থেকে নিয়ে আসবে আর ওরা তিনজন  আজ থেকেই শিহাবের বাসায় থাকবে।তাদের নতুন জীবনের জন্য শিহাব সবার কাছে দোয়া চাইল। শিহাব সবার কাছে কিছুই লুকাবে না। সে কখনোই আরাফকে বাদ দিয়ে তার জীবন ভাববে না। শিহাব চাইছে শায়লার  স্বজনেরা আজই আরাফের কথা জানবে এবং আরাফ এই বাড়িতে যাতায়াতের জন্য সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। আর সবকিছুই যে শায়লার সম্মতিতে হয়েছে শায়লাও সেটা স্বজনদের কাছে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলো। 
বাড়ির মুরুব্বিরা আরাফের ব্যাপারে  শায়লা আর শিহাবের এমন দৃঢ় মনোভাবে আর কিছু বলবার সাহস পেলো না।  সবার জীবন সহজ সরল গতিতে চলে না,কারো কারো জীবনের গতিপথ নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তবেই মোহনার ঠিকানা খুঁজে পায়,এমনি কথা বলে শিহাব সবাইকে এটাই বুঝিয়ে তাদের মনে জমা হওয়া প্রশ্নের সমাধান করে দিলো। শিহাবের অমায়িক ব্যবহার আর সশ্রদ্ধ আচরণে আত্মীয় স্বজনেরা বিমুগ্ধ হয়ে তাদের আশীর্বাদ জানাতে লাগলো। সবকিছু দেখে রুহি খালা লজ্জায় যেন নিজেকে লুকাতে চাইছে। বিষয়টি শায়লার দৃষ্টি এড়ায়নি। শায়লা নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে রুহি খালাকে সালাম করে তার দোয়া চাইতেই রুহি খালা তার ভুলের জন্য কান্না করে দিলেন।কিন্তু শায়লা ভেবে নিলো শত হলেও তিনি  তাদের পরিবারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much