ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯৮)
শামীমা আহমেদ
শিহাব খুবই ঠান্ডা মাথায় একমনে রোমেলের কথাগুলো শুনে নিলো। সে বুঝতে পারছে না এর মাঝে কতটা সত্যতা আছে বা আদৌ তা সত্য কিনা। বেশ কিছুদিন যাবৎ রোমেল শিহাবকে ভীষণভাবে অনুসরণ করছে আর রিশতিনারকে নানান বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। সে খুবই চেষ্টায় ছিল তার আর রিশতিনার দুরত্বটা মিটিয়ে দিতে কিন্তু শিহাব আর রিশতিনার মাঝে যে বোঝাপড়া হয়েছে
তাতো রোমেলের অজানা । রিশতিনা বিনা আপত্তিতেই চলে গেছে। হ্যাঁ,সে স্বেচ্ছায় এসেছিল কিন্তু নানান পারিপার্শ্বিক কারণে শিহাবের তাকে গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। আজ যদি সে কোন সিদ্ধান্ত নেয় তবে সেটা সে তার নিজ দ্বায়িত্বেই নিবে। এব্যাপারে শিহাব মোটেই উদ্বিগ্ন হলো না। আর হয়েও কোন লাভ হবে না। শায়লার কথা রিশতিনা জেনেছেও। খুব দ্রুতই শিহাব রিশতিনাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়ে শায়লার সাথে বিয়েটা সেরে নিবে। শায়লাকে নিয়ে আজ সে যতদূর এসেছে সেখান থেকে সে আর ফিরে যাবে না। আর এজন্য যা ফেইস করতে হয় নির্বিঘ্নে তা করবে। আর শায়লার প্রতি তার ভরসাও আছে। সে তাকে কোনদিনই ভুল বুঝবে না।রাহাত আর বুবলী শিহাবের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হলো বা ফোনে কি খবর এলো,এই নিয়ে দুজনেই ভীত দৃষ্টিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে। শিহাব নিজের মাঝে ফিরে এলো। সে হঠাৎ অনুভব করলো শায়লা তার হাত ধরে আছে। শিহাব শায়লার দিকে তাকাতেই শায়লা তার চোখের ভাষায় শিহাবের মনে সাহস সঞ্চার করলো। শিহাব দেখলো, হলুদ শাড়ি আর কাঁচা ফুলের গহনায় শায়লাকে অপূর্ব লাগছে। কাঁচা ফুলের সৌরভের মাদকতায় শিহাব একেবারে বুঁদ হয়ে গেলো। সে শায়লার আরো কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। শায়লা টের পেলেও নিশ্চুপ রইল।
শিহাব উপরে যাওয়ার জন্য এগুতেই রাহাত আর বুবলীর যেন সকল শংকা কেটে গেলো।
ওরা ফোনের কথা কিছু আর জানতে চাইলো না। শায়লা আর শিহাবকে দুইপাশে দুজন সংগী করে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলো। শায়লার চলায় বারবার শিহাবের স্পর্শ শায়লার ভেতরে রক্তের এক উন্মাদনা খেলে গেলো। দুজনে ধীর পায়ে সিঁড়ি পেরুতে লাগলো। শিহাব বেশ শক্ত করে শায়লার হাত ধরে আছে।এমন অচেনা যায়গায় অচেনা পরিবেশে শুধু শায়লাই ভরসা।
দুজনকে ছাদে নিয়ে স্টেজে বসানো হতেই
শিশু কিশোরদের আনন্দ যেন আর ধরে না। মুরুব্বিরা এমন নায়কের মত জামাইকে দেখে যারপর নাই অত্যাশ্চর্য হয়ে যায়! নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য মনে মনে এমন একটা পাত্র পেতেই হবে মনে মনে তা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। শায়লার মা অসুস্থ বোধ করায় তিনি নিজের ঘরেই রইলেন। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী রুহি খালা যত্নের কোন ত্রুটি করছেন না। নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত করছেন। একে একে মুরব্বীরা তাদের হলুদ ছুইয়ে দোয়া করে দিলেন। বুবলী আর রাহাত সবাইকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হলেন। রাহাত বাবুর্চিদের আজ আর যেতে দেয়নি।এত রাতেও তাদের রান্না প্রস্তুত। এমন মধ্যরাতে এমন একটি আনন্দক্ষণ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা কেউই জানতো না। সবাই তাই এই আচমকা আনন্দটা একেবারে লুফে নিতে চাইছে। শায়লা আর শিহাবের হলুদ ছুঁইয়ে বুবলী দুজনের মুখে কিছু খাবার তুলে দিলো। শিহাবের মনেই পড়ছে না শেষ কখন সে খাবার খেয়েছে। শায়লারও সারাদিন নানান ঘাত প্রতিঘাতে একেবারেই খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছিল। বুবলী দেখলো রাহাত স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার অশ্রুসিক্ত চোখ।অবশেষে সে, আপু আর শিহাব ভাইয়াকে এক করতে পারলো।এতদিন সে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছিল।আজ সব উৎকন্ঠার অবসান হলো।
বেশ অনেক রাত হয়েছে।আনন্দপর্ব আর খানাপিনার পর কেউ আর জেগে থাকতে চাইছে না। শিশুরাও হুড়োহুড়ি করে বেশ ক্লান্ত। একে একে সবাই নিচে নেমে গেলো। রাহাত এই সুন্দর মূহুর্তের কিছু ছবি তুলে রাখলো।রাহাত দেখলো, ঘি রঙা পাঞ্জাবীতে শিহাবের আরো যেন আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। শায়লা আর শিহাবকে স্টেজ থেকে নামিয়ে বুবলী তাদের নিচে নিয়ে যেতে চাইলো।
কিন্তু শিহাব এই খোলা ছাদে শায়লাকে নিয়ে আরো কিছুক্ষন থাকতে চাইলো। তাদের সম্মতি জানাতেই বোনের জন্য রাহাতের কান্না যেন বুক ফেটে বেরিয়ে এলো। শায়লাও আবেগ আপ্লুত হয়ে ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। রাহাত শুধু একটা কথাই বলছে,আপু,তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ শায়লা রাহাতের সবকিছু ভুলে স্নেহের পরশে জড়িয়ে নিলো। ভাই বোনের এমন মিলন মূহুর্তে রাহাতকে নিয়ে শিহাবের মনের সব কষ্ট অভিমান মুছে গেলো। শিহাব শায়লাকে আর রাহাতকে সান্ত্বনা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে খুব শক্ত করে শায়লার হাত ধরে নিলো। রাহাত ভেবে নিলো, কাল সকালেই কাজী ডেকে আপু আর শিহাব ভাইয়ার বিয়েটা সেরে নিবে।
রাহাত আর বুবলী নিচে নেমে গেলো। সিঁড়িতে বুবলী পিছন থেকে রাহাতের হাত ধরতেই রাহাত বিস্মিত হয়ে চমকে উঠলো! বুবলীর চোখ জলে ভরা,সে তার হাতের আংটিটা দেখিয়ে রাহাতকে বললো, রাহাত ভাইয়া আমার আঙুলের এই আংটিটা তোমার আমার মাঝে যোজন যোজন ফারাক করে দিলো। রাহাত একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে, কেউ দেখে ফেলবার ভয়ে এক ঝটকায় বুবলীর হাত ছাড়িয়ে দ্রুত তার নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। বুবলী সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একা একা নীরবে চোখের জল ফেললো। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে নিচে নেমে এলো।
ছাদে শিহাব এবার যেন বাধ ভাঙা ভালোবাসায় শায়লাকে জড়িয়ে ধরলো। শায়লাও যেন নিজেকে বিগলিত করে শিহাবের বিশাল বুকে মুখ গুজে দিলো। কাঁচা ফুলের ঘ্রাণ আর নারী দেহের তীব্র টানে বহুদিনের অপ্রাপ্তির চাওয়া যেন সবটা গ্রাস করতে চাইছে। কতটা ক্ষণ এভাবেই রইল। ক্রমশ শিহাবের ভেতর শায়লাকে একান্তে পাওয়ার বাসনা উঁকি দিচ্ছিল। দুজনে এভাবেই মনের যত কষ্ট হতাশা ছিল সব যেন ধুয়ে মুছে নিলো। শিহাব বিড়বিড় করে বলে চললো,আজ সারাটা দিন তোমাকে হারানোর আশংকায় প্রতিটা ক্ষণ কি যে এক অস্থিরতায় কেটেছে।যেন তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি এমন দূর্ভাবনা গ্রাস করছিলো। শায়লা এবার মুখ তুলে বললো,না শিহাব,আমি তোমায় রেখে থেকে কোথাও হারাবো না।আমি আজীবনের জন্য তোমার।
এভাবেই দুজনে কিছুটা সময় পার করতেই শিহাবের ফোন বেজে উঠলো ! শায়লা ভীত হয়ে গেলো। আবার কি সেই অনাকাংখিত কল ? শায়লা শিহাবকে এবার খাঁমচে ধরলো। শিহাব পকেট থেকে মোবাইল বের করে হাতে নিলো। সে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখতে পেল রাহাতের কল।শিহাব দ্রুত রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপ্রান্তে নারী কন্ঠ ভেসে এলো। বুবলীর উপদেশ ভেসে এলো। শিহাব ভাইয়া,এতরাতে আপনাদের দুজনের ছাদে থাকা ঠিক হচ্ছে না।আপনাদের গায়ে হলুদ লেগেছে।আপনারা এখন বিয়ের বর কনে। এখন নিজেদের ঘরে চলে আসাই ভালো। শিহাব ভাবলো, মাঝে মাঝে ছোটদের এমন শাসন ভালোই লাগে।
শায়লা জিজ্ঞাসু চোখের প্রশ্নে শিহাব জানালো, বুবলী আমাদের নিচে নিজেদের রুমে যেতে বলছে।এবার শায়লা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেলো। সিঁড়িতে বুবলীর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যেতেই শায়লা শিহাবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বুবলী বলে উঠলো, চলো,দুজন নিচে চলো। তোমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমি একটু ঘুমাবো।উফ! সারাদিন দুজনে যা দেখালে না! সিনেমাকেও হার মানায়।বাপরে! এমন কঠিন প্রেম! চলো চলো, আর কোন টেনশন না। চলো,নিচে চলো, আর কতদিন এইভাবে খোলা যায়গায় লুকাছাপা প্রেম করবে ? বলেই বুবলী শায়লাকে একরকম টেনে নিচে নিয়ে যেতে চাইছে।কিন্তু শায়লার আড়ষ্টতা যেন কাটছে না। তবে শিহাব একেবারেই যথা আজ্ঞা রুপে দণ্ডায়মান হয়ে রইল যেন, বুবলীর সবকিছু সে একবাক্যে মেনে নিতে রাজী আছে। এবার বুবলীর চোখ গেলো শিহাবের দিকে, সে ঝনঝন করে বলে উঠলো, শিহাব ভাইয়া,আপনাকে দেখে আমার ভীষণ হিংসা হচ্ছে।কেন আপনার সাথে আমার আগে দেখা হলো না।ইস! গ্রেট মিস! কি আর করা! এখন দুলাভাই ডেকে মনকে সান্ত্বনা দিতে হবে। শায়লা লাজুকতায় নুইয়ে যাচ্ছে যেন।
শিহাব বললো, তাতে কি ? দুঃখ করোনা।তোমরা দুই বোন আমাকে ভাগাভাগি করে নিতে পারো। বুবলী রীতিমতো মাথা চাপড়ে বললো,মাত্থা খারাপ।শায়লা আপু আমাকে মেরেই ফেলবে।না বাবা, যার অধিকার,শুধু সেই থাকুক।আমি এমনিতেই ভালো আছি।
শিহাবের এখন মনটা খুবই ভালো লাগছে।
বুবলী তার হাতের আংটি দেখিয়ে বললো, এই যে একজন বুকিং দিয়ে রেখেছে।আপনি চাইলেও নো ভ্যাকেন্সি,বলেই বুবলী খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। বুবলীর দুষ্টুমিটা শিহাব বেশ উপভোগ করছে।
এবার শায়লা একপ্রকার হ্যাচকা টানে দুজনকে নিচে নিয়ে এলো। শায়লার ঘরের সামনে এসে বুবলী শায়লার উদ্দেশ্য বললো,কই শায়লা আপু,তোমার অতিথিকে তুমি নিজেই ঘরে নাও। আমি আর তোমাদের মাঝে থাকতে চাইছি না। বুবলী দরজা খুলে দিতেই শায়লা ঘরে ঢুকলো। এই ঘরে শায়লা শিহাবকে মনে মনে অনেকদিন কাছে চেয়েছে। আজ তা সত্য হলো।শায়লার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না স্বপ্ন এভাবে সত্যি হতে পারে! শায়লা দেখলো তার পুরো খাট কাঁচা ফুল দিয়ে ঢেকে রাখা।যেন একটা ফুলের ঘর বানিয়ে রাখা।এরই মাঝে তবে বুবলী আর রাহাত এই কাজ করিয়েছে।শায়লার অনেক পুরনো অভ্যাস ঘরে ঢুকেই দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখা।সে অবাক হলো,রাত চারটা বাজছে" ভোর হতে আর বেশ্য দেরি নেই। সে শিহাবকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে বিছানায় এনে বসালো। শায়লার আজ নিজের ঘর নিজেরই অচেনা লাগছে। ঘর ভরা বিয়ের কেনাকাটা, শায়লার বিয়ের শাড়ি, নতুন জামাইয়ের জন্য শেরওয়ানী,পাগড়ি,নাগরা, সব পরিপাটি করে গোছানো। শিহাব এক টানে শায়লাকে কাছে টেনে নিলো। শায়লা দেখলো,বুবলী টেবিলে অনেক খাবার রেখে গেছে। এত্তটুকু মেয়ে কিভাবে যে এত সব গুছিয়ে করছে ! আজ বুবলী না হলে,এত সুন্দর একটা স্বর্গীয় আয়োজন রাহাতের পক্ষে একা কোনদিনই সম্ভব হতো না। ভাবতেই হঠাৎ দরজায় নক করা শব্দে দুজনে বিছিন্ন হয়ে গেলো। বাইরে থেকে বুবলী বলে উঠলো, এই তোমরাতো ঘরের দরজা লাগাতেই ভুলে গেছো। বলেই তার সেকি খিলখিলিয়ে হাসি! এবার শায়লা বড় বোনের রূপে এগিয়ে এলো,দুষ্ট কোথাকার! বাইরে দাঁড়িয়ে সব দেখছে! বুবলীর দুষ্টুমি ভরা প্রতি উত্তরে বলে উঠলো, আমার বয়েই গেছে! তোমরা দরজা খোলা রাখছো,আমি তা দেখিয়ে দিলাম,আর আমি পারছি না।এবার গেলাম।এ কথা বলে চলে যেতেই শায়লা এগিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। এবার আর শিহাব নিজেকে শান্ত খোকা বাবু করে ধরে রাখলো না। চট করে উঠে এসে শায়লাকে একটানে বিছানায় নিয়ে এলো। শায়লা আর নিজেকে শাসনে না রেখে শিহাবের কাছে নিজেকে সঁপে দিলো। টেবিল ল্যাম্পের আলো আঁধারিতে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি হলো।খাটের চারদিকে গোলাপ বেস্টিত আবরণে চমৎকার সুঘ্রাণে দুজনে ডুবে রইলো। অনন্তকালের তৃষ্ণার আজ পিপাসা মিটবে। কাল সকালের এক নতুন ভোরে হবে আগামীর স্বপ্ন বুনন।পিছনে পড়ে থাকবে দুজনে দুজনাকে পাওয়া না পাওয়ার সেই দোলাচলে ডুবে থাকার ইতিহাস। আজ শিহাব তার নিজেরই আরোপিত অলিখিত শর্ত নিজেই ভেঙে চিরদিনের জন্য শায়লাকে আপন করে পেলো।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much