ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৭)
শামীমা আহমেদ
শিহাব,তোমাকে আমি কথাগুলো ওভাবে বলতে চাইনি। আরাফের জন্য তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না।আমার কথায় তুমি কিছু মনে করোনা।
শিহাব হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।কথাগুলো তার পেছন থেকে ভেসে আসলে শিহাব পিছন ফিরে তাকালো। পিছনে সুমাইয়া দাঁড়িয়ে।
সুমাইয়া কখন এসেছে শিহাব তা টের পায়নি। শিহাব একটু বিরতি নিয়ে বললো,
না ভাবী, আমি কিছু মনে করিনি। তুমিতো ঠিকই বলেছো। আরাফের জন্য এখন মায়ের সান্নিধ্য ভীষণ প্রয়োজন।
আচ্ছা শিহাব একটা কথা জানতে চাইতে পারি ? আবার অন্য কিছু ভেবোনা।
না না,, অবশ্যই জানতে চাইবে ভাবী।
সেদিন যে শায়লা মেয়েটিকে নিয়ে এলে,তা প্রায় দুইমাস হতে চললো। তার ব্যাপারে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিলে ?মেয়েটিকে তো ভালোই লাগলো। আরাফের সাথে খুব অল্প সময়ে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমরা তো ভাবছিলাম তুমি সহসাই কিছু বলবে।
শিহাব ভাবলো সব না হলেও কিছুটাতো ভাবীকে বলা যায়।
ভাবী শায়লার বিষয়টি নিয়ে আমি খুব জটিলতার মধ্যে আছি। যদিও শায়লার দিক থেকে আমার প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা আছে।
কেন কি হয়েছে ? সে কি আর তোমার সাথে সম্পর্কে নেই ? নাকি তুমি বিবাহিত বলে ওর পরিবার রাজী হচ্ছেনা? আমি কি কোন কথা বলবো ওদের সাথে ?
না না ভাবী, তার দরকার হবে না।
তাহলে কি দরকার আর জটিলতায় গিয়ে।এমনিতেই নানান ঝামেলা বয়ে গেছে তোমার জীবনে। এবার আমরা দেখে শুনে একজনকে আরাফের মা করে আনি।
শিহাব এর কোন উত্তর দিতে পারলো না।শায়লাও যে বিবাহিতা,আর তা দেড় বছর হয় বিয়ে হয়েছে। শায়লার বিয়ের পর তার সাথে পরিচয় সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা তা ভাবীকে কিভাবে বলবে। সেতো আজই চেয়েছিল শায়লাকে নিয়ে আসতে।শায়লাও রাজী ছিল কিন্তু আরাফের দূর্ঘটনা সব পালটে দিল। তাছাড়া আজই তার স্বামী কানাডা থেকে দেশে আসছে। দশদিন থাকবে, ফেরার সময় শায়লাকে তার সাথে করে নিয়ে যাবে। এমনও হতে পারে আজই আজীবনের জন্য শায়লার সাথে তার সম্পর্কের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।যদিও শায়লা কে পাওয়ার জন্য সে সব রকম চেষ্টা করেও কোন কূল করতে পারছে না।তবে এইসব কথা কিভাবে ভাবীকে বলবে। যদিও ভাবী খুবই আপনজন কিন্তু শায়্যলাকে নিয়ে তাদের মনে আশা জাগিয়ে কেমন করে সে স্বপ্ন ভঙ্গ করবে।
শিহাবের নীরবতায় সুমাইয়া বুঝে নিলো শিহাব আর শায়লা আরাফের বাবা মা হতে পারছে না। তবেতো রিশতিনাকে ফিরিয়ে দেয়া শিহাবের উচিত হয়নি।
তবে কেন রিশতিনাকে ফেরালে ? সুমাইয়ার কঠোর জিজ্ঞাসা।আরাফের সত্যিকারের মা তো রিশতিনাই। সেতো এসেছিল সন্তানের কাছে। তাকে তার সংসার ফিরিয়ে দিতে পারতে।
শিহাব এবার বেশ স্পষ্টভাষী হলো। ভাবী,দয়া করে রিশতিনার অংশটি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। আরাফের জন্য মা দরকার আমি মা এনে দিলেইতো হয়।
এবার সুমাইয়া, একটু সাহস সঞ্চয় করে কথাটা বলেই ফেললো, তাহলে শিহাব আমার মামাতো বোন রুবিনা তোমাকে খুব পছন্দ করে।খবর দিলে সে এখুনি চলে আসবে। যদি তুমি তাকে গ্রহন করো। রুবিনা খুবই ভালো একটা মেয়ে।মাঝে মাঝেই আমাদের বাসায় আসে।সারাদিন আরাফের সাথে থাকে।ওর যত্ন নেয়।
আরাফের জন্মের পর থেকে আজ অবধি ভাবীই আরাফকে আদর যত্নে বড় করছে। ভাবীর এমন চাওয়াকেতো তার সম্মান জানানো উচিত আর যেখানে আরাফের
আজ এই অবস্থায় জ্ঞান ফিরলে সে মাকেই খুঁজবে।
ভাবী, শায়লার সাথে আমার একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।এখন হুট করে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। সবদিক মেলাতে আমার আরেকটু সময় লাগবে।
শিহাবের কথায় সুমাইয়া বেশ হতাশ হয়ে কেবিনে ফিরে গেলো।
শিহাব শায়লার কোন মেসেজ পাচ্ছে না। কি জানি কি হচ্ছে ওদিকে।শিহাব আর কিছু ভাবতে পারছে না। তার ভীষণ অসহায় লাগছে।প্রতিটি দিন সকাল হলেই সে ভাবে আজই শায়লা আমার কাছে চলে আসবে।আশায় আশায় বুক বেঁধে বারবার তা নিরাশায় ডুব দিচ্ছে।
কেবিন থেকে মা বেরিয়ে এলেন।শিহাব মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো।
বাবা, দুপুর হয়েছে। বাসা থাকে কিছু খেয়ে আয়। সুমাইয়া তো সকাল থেকে এখানেই।
বাসায় বুয়া সব রান্নাবান্না করেছে।যা, চারটা মুখে দিয়ে আয়।আরাফ এখনো ঘুমাচ্ছে। কখন যে জাগবে ? জেগেইতো তোকে খুজবে।
তুমি কি খেয়েছো মা ?
না, তা কেমন করে। আমি আর বৌমা তো এখানেই।বাসায় বাচ্চাগুলো মায়ের জন্য না খেয়ে আছে।
তাহলে বরং তোমরা বাসায় গিয়ে খেয়ে আবার আসো। আমি এখানে ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নিবো।
না তা কেন? বাসায় কত খাবার।আমি আর বৌমা গিয়ে তোর জন্য খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
না মা শুধু ঝামেলা করোনা।
সুমাইয়া তৈরি হয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বললো, আরাফ বেশ ঘুমাচ্ছে। ওর স্যালাইন চলছে।
আমি আর মা বাসায় যাচ্ছি। তোমার খাবার নিয়ে আবার আসছি। তুমি আরাফের কাছে ওর পাশেই থেকো।
মা আর সুমাইয়া বেরিয়ে গেলো। শিহাব কেবিনে ঢুকে গেলো। আরাফের দিকে তাকাতেই অজান্তেই চোখ জলে ভরে গেলো।
আহা,বাচ্চাটাকে রেখে আমি কিভাবে এতটা দুরে থাকি।
ডাক্তার ভিজিটে এলেন। সব রকম রিপোর্ট দেখে জানালেন।নাহ, মাথের ভেতরে কোন ইনজুরি নেই। আজ রাতটা হস্পিটালে থাকুন। ঘুম ভাঙলে বাচ্চার মা বাবা আপনারা কাছে থাকুন। বাচ্চা যেন উত্তেজিত না হয়।কাল দুপুর নাগাদ চলে যেতে পারবেন। নিয়মিত অষুধগুলো খাওয়াবেন। সেলাইটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে। এক সপ্তাহ পর আবার দেখিয়ে নিতে যাবেন।
ডাক্তারের কথায় শিহাব একটু নিশ্চিন্ত হলো।
সে চেয়ার নিয়ে আরাফের খুব কাছে বসে রইল। তার খেয়াল হলো, অনেকক্ষন শায়লার সাথে কথা হচ্ছে না।
সে শায়লাকে মেসেজ পাঠালো, কি করছো ?
তৎক্ষনাৎ শায়লার রিপ্লাই চলে এলো, এইতো সবাই এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে,এক্ষুনি যাবে তাই দেখছি।
তুমি যাবে না অতিথিকে রিসিভ করতে ?
তোমার কি মনে হচ্ছে? আমি যাবো ?
কি জানি শায়লা, আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।তোমার ফেলে আমি কত দূরে চলে
এলাম।জানিনা তোমাকে ফিরে পাবো কিনা।
এভাবে বলো না শিহাব।আরাফ অসুস্থ। এখন ওর দিকে খেয়াল দাও।
শায়লা আমি বোধহয় তোমায় হারিয়ে ফেলছি।
কখনোই না।কোনদিনই না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
আচ্ছা রাখছি।কেউ এসেছে দরজায়।
আচ্ছা।ভালো থেকো।
শিহাব উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই ভীষণ অবাক হলো! একজন খুবই সুন্দরী মহিলা জানতে চাচ্ছেন,এটাই তো তিনশ চার ননবর কেবিন তাইনা ?
শিহাব বেশ অবাক হলো? কে উনি? এই কেবিনে এলেন!
আচ্ছা এখানে পেশেন্ট কি আরাফ, ছোট্ট শিশুটি ?
শিহাবের আশ্চর্য হওয়ার মাত্রা আরো বেড়ে গেলো!বললো,হ্যাঁ, আরাফ, আমার ছেলে।কিন্তু আপনি কে ?
আমি রুবিনা। আরাফের চাচী সুমাইয়ার মামাতো বোন। আমি প্রায়ই আরাফকে দেখতে আসি। ওর সাথে খেলা করি।কিন্তু আজ এসে শুনলাম আরাফ হসপিটালে। শুনেই তাই ছুটে এলাম ওকে দেখতে।
শিহাব এবার উনাকে চিনতে পারলেন।হ্যাঁ,তাইতো,অনেক আগে একবার ভাবীর বাসায় দেখা হয়ে ছিলো। ভাবীর অনেক ধনী বড় মামার একমাত্র মেয়ে। যার জাকজমকপূর্ণ বিয়ের তিনদিন পর ডিভোর্স হয়ে যায়। মেয়েটি খুব কোমল স্বভাবের।স্বামীর পরকীয়া সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি।আজ দুপুরে ভাবী যার কথা বলছিলেন।
রুবিনা হাতে খাবেরের ব্যাগ দেখিয়ে বললো,
আমি আরাফকে দেখতে আসবো শুনে সুমাইয়া আপু আমার সাথে আপনার জন্য খাবার পাঠিয়ে দিলেন।
আপনি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।আমি আরাফের খেয়াল রাখছি।
শিহাবের বুঝতে কষ্ট হলো না যে, ভাবী এটা ইচ্ছে করেই করেছে। যেন রুবিনার প্রতি শিহাব আগ্রহী হয়ে উঠে তারই চেষ্টা।
এক কেবিনের ভেতর একজন অপরিচিত মহিলার সাথে সময় কাটাতে শিহাব ইতস্ততবোধ করছিল। শিহাব আড় চোখে দেখেলো, রুবিনা তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।শিহাব বেশ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো।
আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছি।
শিহাবের শায়লার কথা খু মনে হতে লাগলো।তবে কি শায়লাও এভাবে নোমান সাহেবকে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে ?
আজ সকালে শায়লাকে রেখে এসে সে বিরাট একটি ভুল করেছে। আর এজন্য সে নিজেকেই নিজে বারবার ধিক্কার দিতে লাগলো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much