টানাপোড়েন ১৩৯
ভয়েস বিভ্রাট (৪)
মমতা রায় চৌধুরী
দিদির ফোনটা আসার পর কল্যান একটু স্বস্তি পেল ক্লান্ত অবসন্ন দেহে যেন একটা টাটকা বাতাস। কি শান্তি, কি শান্তি। এবার ভাবছে একটু ঘুমাবে গতরাত্রে একদমই ঘুম হয়নি। কি করে টাকা পয়সার অ্যারেঞ্জ করা হবে,? কি করেই বা বিয়েটার সঠিকভাবে সমাধান হবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। যে কল্যান বুদ্ধিদীপ্ত বলে পরিচিত সেখানেই তাঁর বুদ্ধিনাশ হতে চলেছে। আবার যেন আস্তে আস্তে মাথার জটগুলো খুলতে শুরু করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখটা লেগে এসেছে ।বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড় করে ওঠে বুক। আবার ভাবতে না ভাবতেই,কলিংবেলের আওয়াজ ।ঘড়ির দিকে তাকালো কল্যাণ 'ও বাবা , মাসির আসার সময় হয়ে গেছে তো । ক্লান্ত শরীরকে তুলতে পারছে
না । তবুও আপন মনে বলল 'যাই দরজাটা খুলি। 'আস্তে আস্তে উঠে দরজাটা খুলে দেখল "সত্যিই যেটা ভেবেছিল তাই মাসি এসে দরজায় কড়া নাড়ছে।
ঘুমন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে মাসি বলল'তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?'
হ্যাঁ,একটু চোখটা লেগেছিলো।'
একটা মস্ত বড় হাই তুলল আবার তারপর"ইশারায় চা দেবার কথা বলল।'
'হ্যাঁ , তুমি বসো আমি দিচ্ছি এক্ষুনি।'
মাসি তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গিয়ে চা করে নিয়ে আসল।
'চায়ের সাথে কিছু খাবে? সন্ধ্যেবেলায় নাস্তা?'
কল্যান জিজ্ঞেস করল' কী খাওয়াবে?'
'একটু পকোড়া ভেজে দেবো? খাবে?'
কল্যান ঘাড় নাড়লো।
কল্যান একটা ম্যাগাজিন উল্টে দেখতে লাগলো।
মাসি কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁধাকপির পকোড়া নিয়ে চলে আসলো। আবার একটু ধনেপাতার চাটনিও করেছে।
কল্যান বললো wow।
কল্যান ইশারায় মাসিকে এক কাপ কফি দিতে বলল।
মাসিও একগাল হেসে কি সুন্দর কফি বানিয়ে নিয়ে চলে আসলো ।সত্যি মাসি আজকাল কল্যাণের ইশারার কথা অনেক বুঝে গেছে। মাসি বেশ বুদ্ধিমতী।
হঠাৎ একটা ম্যাগাজিনে রসালো গল্প দেখে কল্যাণের মনটা চলে গেল তার বন্ধু বিবেকের প্রেমের পরিণতিতে। সত্যি বিবেকটা বটে নিজের থিসিসের কাজটা দিব্যি বিদেশে গিয়ে হেনরীর সাথে জমিয়ে প্রেম করে তার কাছ থেকে নিজের কাজগুলো হাসিল করে নিল। আবার তাকে কাঁদিয়ে চলে ও এসেছে। আসলে বিবেক যখন পূর্ণবয়স্ক যুবক ।তার শরীরে যৌবনের ঢেউ লেগেছে আর হেনরি র তখন যৌবন মধ্যগগণে এসে
ঠেকেছে ।
তাই হেনরি নিয়ে জীবনসঙ্গিনী করার কথা ভাবতে পারেনি । শুধু তাই নয় রক্ষণশীল বাঙালি পরিবারে বিদেশি মেনেও নেবে না। তা জেনেও সেই গিয়েছিল। কিছু বুঝতে পারিনি হেনরি এতটা বিবেককে পছন্দ করবে।এটা সে মনে মনে জানত কিন্তু তার থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও নেই। এতটাই তাকে সাহায্য করেছে একটা কৃতজ্ঞতা বলেও তো কিছু
থাকে । কিন্তু এটা ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না।
তাই কি করে তার হাত থেকে মুক্ত হওয়া যায় সেই উপায় খুঁজছিল। সে হেনরীর কাছে হাঁপিয়ে উঠেছিল।
হেনরি টুকটাক সব কাজ থেকে শুরু করে থিসিসের টাইপিং থেকে শুরু করে সবই করে দিত ।তাইএকদিন একটা ইচ্ছাকৃতভুল করে বিবাহিতা মাসতুতো দিদির ছবিটা তার পেপার এর মধ্যে রেখে দিয়েছিল যাতে হেনরীর
খুব সহজেই নজরে চলে আসে। এবং যেদিন সে কাজটি করেছিল সেই দিনই হেনরির ওখানে
লাস্ট দিন হয়েছিল । হিন্দি যথেষ্ট আঘাত পেয়েছিল।হ্যাঁ তাকে যথেষ্ট অপমান করেছিল ।বলেছিলি ' সব ইন্ডিয়ানরাই চিটিং করে। যাই হোক সে কিন্তু কখনো নিজের থেকে আর তার রাগ ভাঙাতে যায়নি তার ভেতরের ক্ষোভগুলোকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেনি কারণ এটাই চেয়েছিল বিবেক। এই গল্প আবার কল্যানদের কাছে বলেছিল।
তখন কল্যান বলেছিল ' সে কাজটি মোটেই ঠিক করেনি ।এতে বিবেক উত্তর দিয়েছিল এতে হয়ত হেনরি তার সঙ্গে তার জীবন সঙ্গিনী হলে হেন রী ভেসে উঠত কিন্তু তার জীবনটা ডুবে যেত এটা কখনো তাদের পরিবারে মেনে নিত না।
" শুধু পরিবারের দোহাই দিয়ে কি লাভ বল ভাই। তুই কি নিজে মেনে নিতে পারতিস ?
যার জন্যই তো তুই এই সমস্ত কান্ড করেছিস। তবে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও তো কথা
আছে ।ঠিক ওভাবে না কাঁদিয়ে আসলেই ভালো হতো কাপুরুষের মতো চলে আসাটা ঠিক হয়নি।
অনিন্দ্য বলেছিল' সত্যি কথাটা সত্যি ভাবে বলতে পারতে'।
"কি সত্যি কথা বলতে পারতাম আমি ।
বলতাম" তোমাকে ভালোবাসি না।'
বিবেকের স্পষ্ট উত্তর কল্যাণ ,অনিন্দ্যরা ক্ষুব্দ হয়েছিল এবং বলেছিল এই কথাটা স্পষ্ট করে বরং হেনরিকে বললে ভাল হত।
কল্যাণ বসে বসে
কফি খেতে খেতে ভাবছে 'সত্যিই তো । পৃথিবীতে তো একজনই জিতবে ।একজন না হারলে অন্যজন জিততে পারে না ।তাইবিবেক জিতেছিল ।তাই হেনরি হেরেছে। আজ তার জীবনে প্রভা যে কাণ্ডটি করেছে, প্রভা তাকে চিট করেছে। তাই আজকে শিখার মত একটি সহজ সরল মেয়েকে পেয়েছে।,
কল্যান ভাবছে তার অতীত জীবনের কথা শিখাকে বলা দরকার মনের ভেতরে কোন কিন্তু রাখতে নেই।
ভাবতে ভাবতে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো কি করে বলবে শিখাকে তাহলে কি তাদের প্রথম ভালোবাসার রাতে বলবে এইbকথা? না, না, না তাহলে বরং রাতটাই মাটি হয়ে যেতে পারে।
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। তখনো কল্যান সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধতা নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে চাইছ
আবার ফোন বেজে উঠলো
এবার মাসী রান্না বান্না শেষ করে যাবার পথে বলল" বাবা তোমার ফোন বেজে যাচ্ছে।
তাহলে আমি আসি?
হ্যাঁ ,মাসি এসো।'
এ বাবা ডাক্তার সরকার ফোন করে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ নমস্কার ডাক্তার বাবু।
আপনাকে বেশি কথা বলতে হবে না আপনার তো ভয়েস রেস্টে থাকার কথা আমি বলছি আপনি শুনুন।
আপনার সব ঠিক হয়ে গেছে নিশ্চয়ই ।তাহলে শুনুন সামনের মাসের কিন্তু দু তারিখে আপনার ডেট ফেলা হলো ।
আপনার বিয়ের ডেটটা কবে?
28 তারিখ। খুব চাপ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে?
"ঠিক আছে কি আর করা যাবে এটাও তো আপনার জীবনে ভাইটাল।'
'ওকে 'ডাক্তারবাবু।
ফোন রাখতে না রাখতেই আবার ফোন বেজে উঠলো।
'হ্যালো'
হ্যাঁ বলো।
শিখা বলছে কি ব্যাপার বলতো একবারও খোঁজ নিলে না কিছু বললে না। আমি তো কতটা টেন্সড আছি।"
'হ্যাঁগো সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে টেনশনের কোন কারণ নেই।'
"সব ব্যবস্থা মানে।'
'বিয়ে আর আমার অপারেশন।'
শিখা বলল 'ও ও ও ও'
কল্যাণীও খুব বড় করে উচ্চারণ করল ওওও।
'ঠিক আছে তোমায় অত বেশি কথা বলতে হবে না চুপ করে থাকো ।'
'বাহ্ রে চুপ করে থাকলে তোমার কথা শুনবো কি
করে ? আমরা কাছাকাছি বসে আছি যে শুধু তোমাকে দেখে যাব।
তবে মনের আয়নাতে দেখতে পাচ্ছি।
আমার কিছু কথা বলার আছে ,শিখা তোমাকে।'
এখন কোন কথা তোমাকে বলতে হবে না ।'
"এই কথাগুলো তোমার জানার দরকার। কারণ তুমি আমার জীবনে আসতে চলেছ। আমি কোন কিছু গোপন রাখতে চাইনা।'
"আমার ও অতীত নিয়ে তোমাকে বলতে চাই 'বলল শিখা।
'কল্যান কেমন চমকে
উঠল ।অতীত ! শিখারও অতীত আছে ।সে তো কখনো কল্যাণকে বলেনি সে কথা।'
কল্যান বলল 'আগে আমারটা শোনো।'
শিখা বলল 'অতীত থাক না তাকে ইতিহাসের পাতাতেই থাকতে দাও ।বর্তমানে টানা হেঁচড়া ক'রো না ।ইতিহাস তোমার স্মৃতি চারণ করাবে বটে নতুন করে কোন বন্ধনে জড়িও না।'
কল্যান ভাবছে ' শিখা কত ভালো ভালো কথা বলছে।'
শিখা মনে মনে ভাবছে 'সে কি তার নিজের অতীত ঢাকার জন্যই কল্যাণকে বারবার নিষেধ করছে।
ঠিক আছে তুমি যখন জানতে চাইছো না আমি আর তোমাকে জোর করব না ।তবে তোমার জানা উচিত ছিল আমি কিন্তু তোমাকে বলতে চেয়েছি।'
শিখা অনেক কষ্টে বলল-আমারও তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।'
কল্যান বলল 'কিসের
কথা ?'
'তোমার যেমন একটা অতীতের কথা বলছ আমারও এইরকম একটা অতীত আছে।'
শিখার বৌদি এসে শিখাকে ইশারায় বলতে নিষেধ করে।
শিখা ফ্যালফ্যাল করে তার বৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।'
কল্যান ভাবতে থাকে শিখারও অতীত আছে,?কি থাকতে পারে শিখার। শিখা ও কি আমার মত পোর খাওয়া।
ভেরি ইন্টারেস্টিং।'
এমন সময় শিখার বৌদি মাধু বলল 'হ্যাঁরে কল্যাণকে জিজ্ঞেস কর অপারেশন টা কবে?
এখন ঠিক আছে তো আগের থেকে একটু।'
কল্যান সব শুনতে পাচ্ছে।
শিখা বললো' ও তো বলছে সবই অ্যারেঞ্জ হয়ে গেছে।'
"ঠিক আছে তোরা কথা বল।'
ইশারায় শিখার অতীত সম্পর্কে বলতে নিষেধ করে গেল
'আর বেশি কি কথা বলব না । বেশি কথা বললেই তোমার কষ্ট দরকার নেই ।রাখো এখন।'
'"ok'
ফোন কাটার পর সিগারেট ধরালো সিগারেট খাওয়া নিষেধ আছে। তারপর ভাবল এটা শেষ করে আর খাব না।'
আবার ফোন বেজে উঠল সিগারেট হাতে নিয়ে ফোনটা রিসিভ করল' ও বাবা দিদি ফোন করেছে।'
সিগারেট ফেলে দিল।
ফোনটা রিসিভ করল বলল' হ্যাঁ, দিদি বলো।'
'হ্যাঁ রে, ডেটটা ঠিক হলো।'
'হ্যাঁ দিদি ঠিক হয়েছে মাসের দু তারিখে।'
'ঠিক আছে বাবা দুগগা দুগগা করে এখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাক। মধুসূদন ঠিক করে দিক। বলেই দুহাত জোর করে কপালে ঠেকালো।
ঠিক আছে বেশিক্ষণ কথা বলবো না তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়।'
'ওকে দিদি।'
একটু খেয়ে নিল তারপর ভাবলো সত্যি, রাত জাগা যাবে না।
ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই মায়ের কথা মনে হলো।
এরকম যখন ছোটবেলায় ক্লান্ত লাগত মা তখন কেমন চুলের মধ্যে বিলি কেটে কেটে দিত এভাবেই রোজ রাত্রে ঘুম পাড়িয়ে দিত মা। আজকের মা কোথায় ?মা তো না ফেরার দেশে চলে গেছেন ।শত চেষ্টাতেও তাকে আর ফিরে পাবোনা। একবার দেখে যাও তোমার কল্যাণকে ।দেখো ,গলার অবস্থা কি?'
সত্যি মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে ।মা কেমন সুন্দর চুলের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে বিলি কেটে কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।। আজকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে সব সময় খারাপ অবস্থায় মাতার আশীর্বাদ মাথায় রাখতেন। দু'চোখ জলে ভিজে গেল। কষ্টের অশ্রুতে কল্যাণের বালিশ ভিজে যেতে লাগলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much