০৪ মার্চ ২০২২

মনি জামান এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৫




ধারাবাহিক উপন্যাস
সেদিন গোধূলি সন্ধ্যা ছিল
( ১৫ তম পর্ব ) 
মনি জামান

রাত্রি শেষে ভোরের আলো ফুটলো ফজরের আযান ধ্বনিতে মুখর চারিদিক,মোমেনা বেগম ভোরে পাড়ার লোকজন ডাকলো তার আর যেন তর সইছে না,চারি দিক যত ফর্সা হচ্ছে ততো দলে দলে পাড়ার সবাই হাজির হচ্ছে মোমেনা বেগমের বাড়ি মনে হয় আজ কোন মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে।
আজ দুশ্চরিত্রা আসমার বিচার হবে মানুষের ভিতর উৎসাহের কমতি নেই,সবাই এসে হাজির হয়েছে,ঘর থেকে আসমাকে বের করে আনা হলো,পাড়ার গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা এসে সবাই উপস্তিত হলো,আসমা এক পাশে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মোমেনা বেগম বললেন,আপনরা সবাই উপস্তিত আছেন এই মেয়ে আমার বংশে চুনকালি মাখিয়েছে,আজ বিচার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম আপনাদের মতামত বলুন কি শাস্তি দেওয়া যায়।
আসমা যে অপরাধ করেছে সে নিয়ে এক জন মন্তব্য করলো যেহেতু আসমা চরিত্রহীন খারাপ একটা বাজে মেয়ে,সে হাতে নাতে ধরা পড়েছে তাই তার শাস্তি হওয়া উচিত তার শাস্তি হোক মুখে চুন কালি মাখিয়ে এ গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া।
কেউ বলছে এমন বিচার হোক যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন অপরাধ এই গ্রামে আর না করে,কেউ বলছে মাথার চুল কেটে গলায় জুতার মালা পরানো হোক।আসমা জানে আজ তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না তাই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে,সারা রাত ঘুম হয়নি শরীর ভিষণ ক্লান্ত লাগছে বাকরুদ্ধ সে।
একজন বলল,আসামির কাছে কিছু জিজ্ঞেস করা হোক সে দোষী না নির্দোষী,
তারও তো কিছু বলার থাকতে পারে
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো হ্যাঁ আসামি কিছু বলুক,প্রশ্ন করা হলো আসমাকে যে ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো,আসমা কিছুই বললো না,আসমা নিরবে সমস্ত অপরাধ আজ নিজের কাধে তুলে নিয়েছে,কারণ সে জানে আজ তার কথা কেউ শুনবেনা ,জীবনে কি চেয়েছিল আর কি পেতে যাচ্ছে সে।
আজ তার রাজকুমার জিকুর উপর খুব অভিমান আসমার,কেন সে তাকে ছেড়ে চলে গেল,বিচারে সিদ্ধান্ত হল আসমার মাথার চুল কেটে গলায় জুতার মালা পরিয়ে সমস্ত গ্রাম ঘুরানো হবে,ঘুরানো শেষে এ গ্রাম ছাড়া করে দেওয়া হবে তাকে।
মোমেনা বেগম হুকুম করলো আসমার মাথার চুল কাটার জন্য,একজন এগিয়ে এসে আসমার মাথার চুল কাটতে শুরু করলো,কোন প্রতিবাদ করলো না আজ আসমা। এ নির্মম ভাগ্য পরিহাস মেনে নেওয়া ছাড়া তার কিছুই করার নেই তার আজ সে জঘন্য যড়যন্ত্রের স্বীকার তাই নিরবে বসে রইলো চুপচাপ চোখে জল ঝরছে অঝোরে,আজ এ নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি আসমার আর কোন অভিযোগ নেই,জিবনের সব চাওয়া পাওয়া আর কষ্ট গুলো সব নিজের কাছে জমা রেখেছে কারো কাছে প্রকাশ করলো না।
আজ ছেলে নয়নকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আসমার,কিন্তু আসমা জানে তাকে দেখতে দেওয়া হবেনা তাই ইচ্ছেটা গোপনই রেখে দিল।আসমাকে সব চুল কেটে নেড়া করা হলো তারপর গলায় জুতার মালা পরানো হলো মুখে চুন কালিও মাখাতে মোমেনা বেগম ভুল করলো না।
আসমাকে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরানো হলো
পাড়ার মানুষেরা ছিঃ ছিঃ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, দলে দলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আনন্দ উল্লাস করে ইট পাটকেল ছুড়ে মারছে আসমাকে,আর বলছে পাগলি পাগলি করে পিছু পিছু চিৎকার করছে,পাড়ার এক ছেলে ফিরোজকে সংবাদ দিল আসমার এই বিচারের নির্মম ঘটনার কথা।
ফিরোজ শুনে ছুটলো মোমেনা বেগমের বাড়ি,এসে যা দেখলো তা কোন মানুষ করতে পারে ফিরোজের জানা ছিলো না,ফিরোজ দেখতে পেলো অনেক লোকজন আসমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ফিরোজ লোকজনকে বলল,আপনারা আইন হাতে এভাবে তুলে নিতে পারেন না,সবাই বাড়ি চলে যান প্রশাসন আছে আসমা অপরাধী হলে তারা বিচার করবে।
ফিরোজের কথা শুনে সবাই মনে মনে একটু ভয় পেয়ে যার যার বাড়ির দিকে চলে গেলো,ফিরোজের দু'চোখে পানি আবেগ তাড়িত কন্ঠে বলল,ভাবি আমাকে কেন একটি বার খবর দিলেননা।আসমা নির্বাক কিছু বললো না,আজ আসমার কিছুই নেই সে সর্বহারা সে বোবা হয়ে গেছে।
ফিরোজ আসমাকে বলল,ভাবি চলেন আমার বাড়ি বলে আসমাকে সাথে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো,সবাই বলতে শুরু করলো দেখ দেখ ফিরোজ ঐ মাগীর সাথে,কেউ বলল জানি জানি বলে সবাই হাসা হাসি করলো।
ফিরোজ শুনেও না শুনার ভান করে আসমাকে সাথে নিয়ে বাড়ি পথে হাঁটা শুরু করলো।বিকালে ফিরোজ বলল,ভাবি আজ থেকে আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন,আমি বাজারে যাচ্ছি গিয়ে ডাক্তার পাঠাচ্ছি বলেই ফিরোজ তার ছোট বোন জান্নাতকে ডেকে বলল,ভাবির কাছে থাকিস কোথাও যাসনা যেন, বলে ফিরোজ চলে গেলো ভবদা বাজারে,হাট থেকে আসমার জন্য শাড়ি ব্লাউজ ঔষধ আর কিছু ফল কিনে নিয়ে ফিরোজ বাসায় এলো।
রাত নামলো আসমা জান্নাতকে বলল,বোন একটা কলম আর একটা কাগজ দেবে আমাকে,জান্নাত বলল,কেন দেবনা ভাবি আমি এনে দিচ্ছি,একটু পর জান্নাত কাগজ আর কলম এনে দিলো আসমাকে।গভীর রাত মনের কষ্টে আসমা লিখলো
-------
কষ্ট তুই একটু অপেক্ষা কর,
আজ রাত ভর সমুদ্র উত্তাল 
হয়নি।
স্রোতম্বী নদী হয়তো মোহনা 
খুঁজে পায়নি,সমুদ্রের ঠিকানা।
গাঙচিল উড়ে উড়ুক কষ্টেরা 
খুরে খায় খাক।
তবুও একটু অপেক্ষা কর,পূর্ণ 
একটি পূর্ণিমা উদিত হোক আজ।
ভোরের আলো ফুঁটলে না হয় 
সলিল সমাধির একটি গল্প 
লিখিস।
উত্তাল সমুদ্রে ভেসে যাওয়া 
একটি মৃত লাশের। 

লিখা শেষ হলে আসমার দু'চোখ ভেঙ্গে অঝোর ধারায় যেন বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো,আসমা ভাবছে এ পৃথিবীতে তার আর কেউ আপন রইলো না।সন্তান থেকেও নেই,মা বাবার বাড়ি এ কলঙ্কিত মুখ নিয়ে আসমা আর কখনো ফিরে যাবে না।তার রাজকুমার জিকুর কাছেই ফিরে যাবে সে,আসমা সারা রাত ঘুমালোনা মনে হয় ঘুম ও তার শত্রু হয়ে গেছে।
ভোরের আলো ফুটলো আসমা চোখ বুজে শুয়ে আছে,আস্তে আস্তে বেলা বাড়ছে। সকাল আটটায় ফিরোজ আজ ঢাকায় যাবে,আসমাকে ডাকলো ভাবি নাস্তা খেয়ে নেন।আসমা উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে এসে বসলো,জান্নাত ফিরোজ আর আসমাকে নাস্তা দিল,নাস্তা খাওয়া শেষে আসমা ফিরোজকে বলল,একটা কথা রাখবে ভাই,ফিরোজ বলল, কি কথা বলেন ভাবি।
আসমা বলল,আমার একটা ডায়রি আছে অনেক লেখা একসময় তোমার দৈনিকে ছাপাবে ভাই বলে ফিরোজের হাতে রাতের লেখাটাও দিয়ে বলল তোমার কাগজে দিও।ফিরোজ বলল,ঠিক আছে ভাবি কাল আপনার এই লেখাটা দৈনিক ভবদা সাহিত্য পাতায় প্রকাশ হবে,আমি আজ ঢাকায় যাচ্ছি একটু কাজে কাল সকালে ফিরবো, কোন কিছুর দরকার হলে জান্নাতকে বলবেন,বলেই ফিরোজ ব্যাগ পত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
আসমা সারারাত ঘুমালো না জীবনে কি চেয়েছিলো আর কি পেলো,ভাবছে আজ কলঙ্কিনী সে এ মুখ এই সমাজে কি করে দেখাবে।সমাজের এই ঘৃণ্য যড় যন্ত্রের কাছে আজ পরাজিত সে।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much