০৪ মার্চ ২০২২

মমতা রায়চৌধুরীর ধারাবাহিক পর্ব ১২০




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১২০
অনুসন্ধিৎসু
মমতা রায়চৌধুরী।



উফ কাজের চাপে আর মাথা তুলতে পারছে না রেখা ।স্কুলের কাজগুলো বাড়ি বয়ে  নিয়ে চলে এসেছে। না এনেই বা কি করবে? প্যানডেমিক সিচুয়েশনে তো মেয়ের সংখ্যা বেশি নেই,  যদিও স্কুল টা খুলে দিয়েছে  ।ম্যাগাজিনের প্রকাশের গুরু দায়িত্ব তার ওপর পড়েছে । সময় বেশী নেই তাই লেখাগুলো কারেকশন করতে  এবার দিদিমণিদের হাত লাগাতে হচ্ছে ,সেগুলিকে ফ্রেশ করে লেখার জন্য। তারপর চারিদিকে কাটিং এর কাজ আছে ,কাটিং এর কাজ করতো রিম্পা দি, 
তার তুলনা নেই।  খুব মিস করছে। তবে অনুরাধাদির হাতের লেখা খুব ভালো। অনুরাধাদি বলেছেন " চিন্তা ক'রো না  তুমি কিছুটা লেখ তারপর আমাকে দিও ।আমি করে দেব।'
এরপর বিদ্যালয় সাজানো। নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। শরীরটাও বেশি ভালো যাচ্ছে না । ভালো থাকলে এরকম কষ্ট হয়না। এরমধ্যে বাচ্চাগুলো আবার অসুস্থ হয়েছে।  পারা যায়?
না গিয়ে দেখি ,কিছু খায় কিনা? এতক্ষণ ঘাড় গুঁজে লেখাগুলোকে কারেকশন করা
 হলো । মাথাটা তুলে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবল 'আজকে তো চেঁচাল না ।'দেখি তো কি করছে ?
রেখা বাচ্চাগুলোর কাছে গেল ।কাছে গিয়ে ওদের  টেনে টেনে তুলতে হচ্ছে ,শুয়েই আছে।
ওমা একি পাইলট তুই বমি করছ?
কি বাবা এসব কি বেরোচ্ছে বমি দিয়ে, কি 
খেয়েছ ?এগুলো কি? এত ভালো জিনিস তোমাদের খাওয়ানো হয় , তারপরেও হিজিবিজি কাঠের গুঁড়ো, ইটের গুঁড়ো ,এগুলো কোথায় পেয়েছ? পুরনো দেয়ালটাকে নিচের অংশটুকু
 খু ড়ছ ,তারপর খেয়েছ?'
একরাশ বিরক্তি আর দুর্ভাবনা নিয়ে রেখা বলল
'তোমাদের খেতে দেয়া হয় না তো।'
কি বলবে? ওরা কি আর রেখার ভাষা বুঝতে পারছে? শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মাঝে রেখার গালদুটোকে এসে আদর করে দিচ্ছে।'
একটা উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনা নিয়ে ভাবলো আবার ডাক্তার বাবুকে কল করতে হবে।
মনোজকে  ব্যাপারটা খুলে বলি।
রেখা দ্রুতগতিতে মনোজের ঘরে ঢুকলো।
দরজায় নক করল ।'কিছু বলবে?'
'হ্যাঁ বাচ্চাগুলোর ব্যাপারে কথা ছিল?
'কি হয়েছে?'
'দুপুরবেলা তুমি খেয়াল করো নি বাচ্চাগুলো খেয়েছি কিনা?'
"না দুপুর বেলায় ওরা তো খায় নি।'
আমি এখন গেলাম গিয়ে দেখছি তিনজন শুয়ে আছে ।ওদেরকে ধরে ধরে তোলা হলো  আসলো কাছে। পাইলট বমি করল।'
মনোজ আশ্চর্য হয়ে বলল ' কি বমি করেছে?'
'তবে আর বলছি কি সবথেকে আশ্চর্য লাগছে বমির সাথে কি বেরোচ্ছে জানো?'
 মনোজ হাঁ করে রেখার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো।
বমির সাথে ইটের গুঁড়ো ,কাঠের গুঁড়ো এসব বেরোচ্ছে।
'ওরা এসব পেল কোথায়?'
তোমাদের পুরনো বাড়ি না ,পুরনো দেয়ালের কিছুটা অংশ বেরিয়ে আছে আর তার সঙ্গে মেজেটার অবস্থাও ওই। ওখান থেকেই।'
'না এদের নিয়ে তো আর পারা যাচ্ছে না।
এত ভাল ভাল খাবার খাওয়ানো
 হচ্ছে ।তারপরেও এই।'
রেখাও চিন্তিত মুখে মনোজের কথাবার্তা শুনতে লাগলো। তারপর মনোজ বলল 'হ্যাঁ দেখি ডাক্তার বাবুকে কল করি।'
"আমি তো সেই জন্যই বলতে আসলাম।'
মনোজ একটু চিন্তিত ভাবে বলল'তবে এখন তো ডাক্তার বাবুকে ফোন করলেও পাওয়া যাবে না। একটু পরে ছাড়া।'
তাহলে এক কাজ করি এর আগের বারে ডাক্তারবাবু যে ওষুধগুলো দিয়েছিলেন সেগুলোই ওদের খাইয়ে দি একটু করে কি বল?'
"হ্যাঁ সেই ভালো সেটাই করো আপাতত।'
রেখা বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল ঘরে ওদের যে ওষুধের ডিব্বা আছে তার থেকে দেখলো কি কি ওষুধ আছে বেঁচে আছে ওষুধের শিশি টা ভালো করে নাড়ালো।
Rantac syrup হাতে নিয়ে মনোজ কে উদ্দেশ্য করে বলল 
'তাড়াতাড়ি এসো তুমি ।ধরবে। না হলে খাওয়ানো যাবে না।'
মনোজ বলল ', চলো, চলো, চলো, যাচ্ছি।'
যেতে যেতে রেখা শুনতে পেল কাকে যেন বলছে 'এসে পরে কল ব্যাক করছি।'
কার সাথে এত কথা বলে কে জানে অথচ ঘরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। আজকাল আমার দিকে ঠিক করে তাকায়ও না। কপালে যেটুকু নিয়ে এসেছি সেটুকুই তো…।
মনোজ বললো' কই ওষুধ টা  কই? ভালো করে ঝাকিয়ে  নাও।'
রেখা ওষুধ টা ভালো করে ঝাঁকাতে শুরু করলো এরমধ্যে মনোজ বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে বললো
' কই আমার পাই লট, আমাদের তুলি সোনা ,কই ? সবাই সব এক এক করে বেরিয়ে আসলো ।একটা বড় হাই তুলল।
একটা একটা করে ধরলো'রেখা ওষুধ খাইয়ে দিল।
খাওয়ানোর শেষে প্রত্যেককে দুজনে মিলে আদর করল ।তারপর  মনোজ বললো 'দেখা যাক কি হয়  রাত্রিবেলায় ফোন করবো ডাক্তারবাবুকে।'
রেখা বাথরূমে গিয়ে ভাল করে হাত পরিষ্কার করল । কিছুটা চোখেমুখে ঠান্ডা জল দিল কিন্তু বাথরুম থেকে জলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ফোনের শব্দটাও শোনা যাচ্ছে । 
রেখা বেরিয়ে এসে হাতমুখ ধুয়ে মুছে নিতে নিতে একবার ভাবলো' কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। সারাদিন গেল এভাবেই। একটু ক্লান্তি লাগছে কিন্তু না চা খেতেই হবে। এই সময়টা কফি হলে খুব ভালো হতো। প্রতিবার শীতের মরসুমে খুব ভালো করে কফি খায় ।ভাবতে লাগল আগে স্কুল থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই ও (মনোজ)কফি করে 
ফেলত ।দুজনের জমানো কথা যেন সেই কফি টেবিলে বসেই শেয়ার
 করত ।কোথায় গেল সেই সোনালী দিনগুলো। একটা দীর্ঘশ্বাস  ফেলে নিয়ে নিজেই গেল রান্না ঘরে। তারপর গ্যাসের চুলায় প্যানে চায়ের জল বসিয়ে 
দিল ।ভাবছিল কফি করবে কিন্তু দেখল কফি নেই ।যাই হোক গ্যাসের চুলায় প্যানেতে জল গরম হতেই দুধ দিয়ে দিল, কি করবে চা ই খাবে ।যা হবে, হবে। ভালো করে জল ফুটলে ফোটানো দুধ ভালো করে মেশালো, চা পাতা 
দিল ।রেখার যেন কেমন পাগল পাগল মনে হতে লাগলো। খুব সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে চা পাতাটা  থেকে ।নতুন এনেছে আপনমনে বললো।
নিজের কাপে চা ঢাললো , মনোজের জন্য  কাপে ঢেলে, কাপ দুটো নিয়ে মনোজের ঘরের দিকে গেল।একদম ভালো লাগছে না। একটু মুখরোচক কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। চানাচুর নিল। মনোজ ঘরে গিয়ে চা টা নামিয়ে বলল '
' চা ।বিস্কিট খাবে তো?'
মনোজ তখন ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিল । 
' চায়ের সঙ্গে বিস্কুট নেবে ।'
'দাও একটা  '।
'বেশ খোশ মেজাজে গল্প করছে ।কে ফোন করেছে মনোজকে ?'
কার সাথে কথা বলছে।তাচ্ছিল্যের স্বরে আপন মনে বলল' বলুক গে যার সাথে খুশি। '
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল হাসির শব্দের সঙ্গে বিয়ে 
শব্দটা ।রেখা ভাবতে লাগল কার বিয়ে?
 এত হাসিখুশি নিজের টেবিলে বসে চা খাচ্ছে আর পেপারটা উল্টাচ্ছে।'
'বাহ ,আবার লেখা বেরিয়েছে 
স্বপ্নীলের ।অসাধারণ ।কি দারুন লিখেছে। এত ভালো লাগছে, মনটা ভাল হয়ে গেল। এক চুমুক চা খেয়ে, বাকি স্বপ্নিলের লেখায় নিজেকে ডুবিয়ে দিল।চা ঠান্ডা হয়ে গেল। ক্লান্তি দূরে চলে গেল। যেমন ছন্দ ,তেমনি বাস্তবতা, কি অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে।
হঠাৎই মনোজের গলা পাওয়া গেল 'রেখা ,রেখা ,রেখা. আ. আ. আ...।
মনোজ একদম বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলল 'কার ভাবনায় মগ্ন বলো তো তুমি ?তোমাকে কখন থেকে ডাকছি ,পাড়ার লোক বোধহয় এবার ছুটে আসবে আমার ডাক শুনে।
রেখা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো বলল  হ্যাঁ, কি বলছো ?বলো?'
সুরোফোন করেছিল ? আবার আজকে  ফোন কেটে দিল ।তুমি এত বেয়াক্কেল হয়ে যাচ্ছ কেন বলতো? কোন কান্ডজ্ঞান নেই ।কি হচ্ছে এসব। কি জানি বাবা।
মনোজ মেজাজ দেখিয়ে আবার ঘরে চলে গেল।
ভাবলো তাইতো সে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিল, আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে দেখল  'ওরে বাপরে কি ঠান্ডা হয়ে গেছে ।সত্যিই রেখার খুবই ভুল হয়ে গেছে। কি জন্য ফোন করছে কে জানে?'
রেখা একটু ভয়ে ভয়ে আর উদ্বিগ্নচিত্তে মনোজের ঘরে গেল ।দেখে মনে হচ্ছে এক মনে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বসে কি যেন মাঝে মাঝে টাইপ করে যাচ্ছে। রেখার উপস্থিতি টের পেলো কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই একটা টিকটিকি ধপ করে পড়ল নিচে ।দুজনার মাঝে যেন দুজন দুজনের উপস্থিতিটাকে স্মরণ করিয়ে দিল । মনোজ রেখার দিকে তাকিয়ে বলল' কি ব্যাপার তুমি এখানে?'
না মানে সুরোদা কেন ফোন করেছিল সেটাই জানার জন্য এসেছি।
কোন কথার উত্তর দিল না ল্যাপটপে টাইপ করেই যাচ্ছে।।
 খুবই কি দরকার?
মনোজ বলল' দু দুবার এরকম হল। তুমি এমন ভাব দেখাও যেন সারা রাজ্যের কাজ তুমি শুধু একাই করো। অন্য কেউ করে না। '
'তুমি এভাবে কেন আমার সঙ্গে কথা বলছ ?'
তুমি প্রায়ই আজকাল আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলো।
 কেন ?কেন বলতো?'
'কেন তুমি বোঝনা ?কেন কথা
 বলি ?'
রেখাএকটু ভেতরে ভেতরে ফুসছে '
বলল 'না আমি বুঝিনা  ।তাই তো তোমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করছি। বলো কি জন্য?'
'তুমি কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করার মুড নিয়ে এসছে এখানে ।তাহলে সরি এখন তোমার সঙ্গে ঝগড়া করার আমার কোন মুড নেই।'
Ok
রেখা আবার চলে আসলো।
কাপ  খুব যত্নে রেখে দিল ।তারপর ভাবল একটু নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে নেবে ।এতগুলো কথা  ভেবে ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু রাত্রে খাবার  তো তৈরি করতে হবে আগের মত মনোজর মন ভালো থাকলে আমার এত কাজ অসুবিধার কথা জানলে ও বলত' থাক কিছু করতে হবে না  ।আমি হোটেল থেকে নিয়ে আসছি কিন্তু আজকাল সেটাও করে না।
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে আটা বের করে গোটা চারেক রুটি করে ফেলল ।আর রুটির সঙ্গে খাবার জন্য ব্রকলি ফ্রাই বানিয়ে ফেলল।  আর একটা করে ডিম সেদ্ধ।
বাচ্চাগুলোর জন্য অল্প করে খাবার নিয়ে গেল খাওয়াতে। অল্প পরিমাণে খেলো। হাতে ওদের এঁটো থালাটা নিয়ে রাখতে যাবে তখনই কলিংবেলের আওয়াজ ''জয় গনেশ,' জয় গনেশ , জয় গনেশ দেবা'। 
রান্না ঘর রেখা বলে উঠল ' এখন আবার কে আসল?'
এবার মনোজই  গিয়ে দরজা খুলল।
এ কি পার্থ, এই সময়?
'এসো ,এসো ,ভেতরে এসো ।
রেখা দেখ,  পার্থ এসেছে। '
হাতের  এঁটো থালা নামিয়ে
'আরে পার্থ ভাই , এই সময়?
সব ঠিক তো,?
"হ্যাঁ এমনি সব ঠিক আছে  একটা কথা বলার জন্য আসলাম বৌদি।"
 রেখা
উৎসুক ভাবে মনোজের মুখের দিকে তাকাল ,সঙ্গে সঙ্গে পার্থর মুখের দিকেও।
সে রকম ব্যাপার কিছু নয় বৌদি।'
'মা একবার আপনাকে যেতে বলেছে।'
'কেন কিছু ব্যাপার আছে?'
পার্থ হেসে বলল 'সেটা আপনি মায়ের কাছ থেকেই শুনে নেবেন। এটাই বলার জন্য এসেছিলাম । অবশ্যই কিন্তু যাবেন কেমন।'
পার্থ চলে যাবার পর রেখা ভাবতে লাগলো 'আজকের পার্থ র চোখ মুখে ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তামুক্ত এক অনাবিল ভালোবাসার মুক্ত আকাশ।'এতদিনের টানাপোড়েন কি তবে শেষ হলো? ভাবতে ভাবতেই রেখা র হৃদয়ে থেকে গেল একরাশ কৌতূহল ।
অনুসন্ধিৎসু মন রহস্যের সাগরে ডুব দিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much