ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৭৬)
শামীমা আহমেদ
বারান্দায় বসে কাপের চা শেষ করে সিগারেট ফিল্টার এস্ট্রেতে গুজে দিয়ে শিহাব অফিসে যাওয়ার তাড়নায় উঠে দাঁড়ালো। ভেবে নিলো দ্রুত শাওয়ার সেরে বেরিয়ে যেতে হবে। বারান্দায় শুকাতে দেয়া নীল তোয়ালেটি খুঁজতেই দেখা গেলো রিশতিনা টাওয়েল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে। শিহাব একটু চমকেই গেলো ! তবুও নিজেকে সংযত করে এক হেচকা টানে টাওয়েল নিয়ে বেশ বড় বড় পা ফেলে হেঁটে ওয়াশরুমে ঢুকল। রিশতিনা নির্বিকার দৃষ্টিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল।ভাবলো, এই মানুষটা একসময় তারই ছিলো। সে নিজেও কতটাই না আপন ছিল তার। দুজন দুজনার জন্য সেকি অনুভুতি আবেগের প্রকাশ ছিল।মনে হতো পৃথিবীর আর সব কিছুই তুচ্ছ।রিশতিনার বিয়ের দিনটির কথা ভীষণভাবে মনে পড়তে লাগলো। সেদিন ছিল অক্টোবর মাসের আঠারো তারিখ।দুজনে সকাল দশটায় শিহাবের এক সিনিয়র ভাই এবং বন্ধু নাঈম ভাইয়ের বাসায় যায়।তখন শিহাবকে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছিল। সেখানে সামান্য নাস্তা সেরে সবাই কিভাবে কি করা যায়বতার আলোচনা চলছিল। রিশতিনার মনে আছে সেদিন সে নীল শাড়ি পরেছিল আর শিহাব কালো শার্ট আর ক্রীম কালারের প্যান্ট পরেছিল।চোখে সানগ্লাস সেঁটে দুপুরে যখন কাজী অফিসের জন্য বেরুলো রিশতিনা অবাক হয়ে শিহাবের দিকে তাকিয়ে ছিল।রিশতিনা মুগ্ধ হয়ে শুধু শিহাবকেই দেখছিল! শিহাবের কয়েকজন বন্ধুকে সাক্ষী করে বিয়ে পড়ানো হয়। যদিও শিহাব এভাবে বিয়েটা করতে চায়নি কিন্তু রিশতিনার প্রবল চাওয়াকে বাস্তবরূপ দিতেই শিহাব রাজি হয়েছিল। রিশতিনা একদিকে যেমন বাবামায়ের প্রচন্ড শাসনে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে বেরুতে চাইছিল আরেকদিকে ছিল ভীষণভাবে শিহাবকে হারানোর ভয়। তাইতো তার এত তাড়া ছিল। বিয়ে সেরে গুটিগুটি পায়ে দুজনে শিহাবদের বাড়িতে প্রবেশ করে।শিহাবের মা ভাবী সবাই তাকে সহজভাবে গ্রহন করলেও তাদের সবার চোখে মুখে ছিল এক চাপা ভীতি আর আতংক ! যে কোন মূহুর্তে রিশতিনার বাবার প্রবেশ ঘটতে পারে,ঘটতে পারে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা। ভাবী খুব অল্প সময় পেলেও ওদের বাসর ঘরটি ফুলে ফুলে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল।সারাটা রাত রজনীগন্ধা আর বেলির ঘ্রাণে দুজনের সে এক মাতোয়ারা রাত কেটেছে ! এরপর রাত গভীরে কিছুটা সময় দুজন বারান্দায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে একরাতে যতখানি সুখ শুষে নেয়া যায় তাতে পূর্ণ করেছে আর যখন ভোর ঘনিয়ে আসে রিশতিনা শিহাবের বুকে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
এসব ভাবতে গিয়ে রিশতিনার চোখে জল ভরে গেলো। অথচ সে এখন শিহাবের বিছানায় একাকী বসে আছে। কাল রাতে একাকী রাত কাটিয়েছে।আর এজন্য শিহাবের মনে এতটুকু দুঃখবোধ নেই। এভাবেই শিহাব নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলো ? রিশতিনার মনের ভেতর একটাই প্রশ্ন, কোথায় হারিয়ে গেলো সেই সুন্দর মায়াবী রাত ? বিবাহিত জীবনের দুইটি মাস যেন চোখের পলকে ফুরিয়ে গেছে ! কেমন করে শিহাব এতখানি বদলে গেলো ? সেতো শিহাবের অপেক্ষায় ছিলো কিন্তু শিহাব কেন তারজন্য অপেক্ষা করলো না।কেন তার জায়গায় অন্য আরেকজনকে মনে ঠাঁই দিলো। হঠাৎ ওয়াশরুম খোলার শব্দে রিশতিনা তাকাতেই শিহাবের দিকে চোখ আটকে গেলো। ভেজা শরীরে শিহাবের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলকণা, ধবধবে সাদা শরীরে মনে হচ্ছে মুক্তোদানা বসানো ! নিচের অংশে আকাশনীলা টাওয়েল জড়ানো। রিশতিনার চোখে চোখ পড়তেই শিহাব একটু লজ্জিত হলো।এভাবে বেরিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।হয়তো সে রিশতিনার কথা ভুলেই গিয়েছিল। রিশতিনা পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিচে রাস্তায় গাড়ি চলাচল দেখতে লাগলো। শিহাবকে নিজের স্বাধীনমত তৈরি হতে রিশতিনা দূরত্ব নিলো।যদিও বিয়ের পরের দুটি মাস রিশতিনা শিহাবের বাইরে যেতে হলে শার্ট প্যান্ট ম্যাচিং করে গুছিয়ে দিতো। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছেলেমেয়েরা একটু এডভান্স এসব ব্যাপারে বেশ স্মার্টই থাকে।
শিহাব নিজের মত তৈরি হয়ে নিলো। এখন বেরুতে হবে।হাতে মোবাইল, বাইকের চাবি, হেলমেট সানগ্লাস নিয়ে ঘরের চাবি হাতে নিতেই রিশতিনার কথা খেয়াল হলো। সে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো,রিশতিনাকে কোন নামে সম্বোধন না করে বললো, আমি যাচ্ছি। ঘরের চাবিটা টেবিলে রইল। তুমি যাওয়ার সময় লক করে চাবিটা কেয়ারটেকার বিল্লালের কাছে রেখে যেও। কথাটা শুনে রিশতিনার বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেলো, চোখ জলে ভরে উঠলো।
তবে কি শিহাব চাইছে না যে সে এখানে আর থাকুক।এখনো কি তাকে ক্ষমা করা যায়না ?
শিহাব আবার বলে উঠলো, আমি যাচ্ছি।
রিশতিনা এবার পিছনে ফিরলো এবং যারপরনাই অত্যাশ্চর্য হয়ে গেলো।শিহাব আজো সেই বিয়ের দিনের কম্বিনেশনের শার্ট প্যান্ট পরা! কালো শার্ট আর ক্রীম প্যান্ট!
শিহাব পিছনে আর না তাকিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে লিফট কল দিলো। মনে মনে ভেবে নিলো, রাতে শায়লার সাথে ভালোভাবে কথা বলা হয়নি। অফিসে গিয়ে কল দিতে হবে।
দরজা খোলাই রইল।রিশতিনা অচেনা এক শিহাবের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much