১১ জানুয়ারী ২০২২

শামীমা আহমেদ /পর্ব ৫২




শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৫২)
শামীমা আহমেদ 

খুব সকাল সকালই রাহাত অফিসের উদ্দেশ্যে  বেরিয়ে গেলো। যাবার সময় চোখের ভাষায় শায়লাকে বুঝিয়ে গেলো আজ অফিসে গিয়েই শিহাব ভাইয়ার সাথে কথা বলবে।শায়লা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে স্বস্তির সম্মতি প্রকাশ ঘটালো।ডাইনিংয়ে মায়ের সাথে শায়লা নাস্তা সেরে নিলো।মায়ের অভিব্যক্তিতে বেশ বুঝা যায় মনের ভেতর  অনেক প্রশ্ন জমা।কিন্তু শায়লার কাছে তার কিছুই জানতে চাইল না। শায়লাও আগ বাড়িয়ে কিছুই বলছে না।সবকিছু রাহাত, শিহাব আর সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছে।  শিহাব তাকে বিশ্বাস রাখতে বলেছে আর রাহাত তাকে আস্বস্ত করেছে।এখন সময়ই সব ফায়সালা করবে।
শায়লা পারতপক্ষে মায়ের মুখোমুখি হয় না।পাছে মা আবার কি শুনতে কি শুনবে, বয়স হয়েছে, এতটা কঠিন সিদ্ধান্ত মা মানতে পারবে কিনা আর এর সাথে তো রুহি খালাকে মোকাবেল করাও বিশাল এক  ভাবনার ব্যাপার!
দরজায় কলিংবেল হলো।শায়লা এগিয়ে গেলো।বুয়ার আগমন।পেছনে ইন্টারনেট বিল নেয়ার জন্য ছেলেটি দাঁড়িয়ে। ছেলেটির নাম মাসুদ।প্রতিমাসেই বিল নিয়ে যায়। খুবই ভদ্র গোছের ছেলেটি,স্কুল পড়ুয়া বয়সী,তবুও এই বয়সে কাজ করছে।বুঝা যায় ভালো ঘরের সন্তান নিশ্চয়ই অর্থাভাবে এই কাজ করা।শায়লা ঘরে গেলো বিলের টাকা আনতে।ফিরতেই এরই মাঝে রুহি খালার প্রবেশ ঘটলো।তাকে ঠেকাবার সাধ্য কার? অবশ্য শায়লারা কখনোই সেটা চায় না।ভাড়াটিয়া হলেও খুবই বিপদের আপনজন এই রুহি খালা।
শায়লা বেশ বুঝতে পারছে আগমনের হেতু! চোখে মুখে রাজ্যের প্রশ্নের ভীড়।মাকে তো আগে থেকেই সতর্ক করা আছে। দুজনেই ডাইনিং টেবিলে বসলো।মনে হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক কোন আলোচনা শুরু হবে!কাজের বুয়া মরিয়মের মায়ের ঘর ঝাঁট দেয়া চলছে। কেমন আছো মরিয়মের মা? ডাইনিং এ আসতেই রুহি খালার জিজ্ঞাসার  জবাবে কথার তুবরী ছুটলো যেন! এক সেকেন্ড মনে হয় দশটা কথা বলে ফেলে!
--কেরুম আর থাকুম খালা? গরীবের ঘরে মাইয়া হইলো গলার কাঁটা গিলাও যায় না বাইরও করন না। পোলা পোলা কইরা চাইর চাইরটা মাইয়া হইছে।এই শেষ বয়সের পোলা কবে বড় হইব,সংসারের হাল ধরব? বড় মাইয়াডা ডাঙ্গর হইতেই বস্তির মালিকের পোলার জ্বালায় রাহন যাইতে ছিল না। তাড়াহুড়া কইরা বিয়া দিলাম।জামাই সিএনজি চালায়।বছর ঘুরতেই বাচ্চা পেডে।এহন শুনি জামাইয়ের আগে একটা বিয়ে আছে। সেহানে দুইখান পোলাপান। আমার মাইয়া আর তার সংসার করবো না।আইয়া পড়ছে।
ঘরে এত খাওনের মুখ,আবার নতুন আরেকজন লইয়া আইলো।স্বামী  রিকশা চালায়া আর কয় ট্যাকা আনে? আপনেগো বড়লোকের ঘরে মাইয়া বিয়া না দিলেও ক্ষতি নাই, বিয়া দিলেও বাপের বাড়ি থাকার কোন অসুবিধা নাই।আমগো হইছে পুড়া কপাল।মরিয়মের মায়ের বিশাল এক লেকচার গিলতে হলো সবাইকে।যদিও এর প্রতিটি বর্ণই বুকের ভেতর কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসা।শায়লা বুঝে নিলো বিয়ের পর সেওতো বাপের বাড়ি থাকছে এটাও তো একটা চিন্তার বিষয়। মরিয়মের মা রান্নাঘরে ব্যস্ত হলো। এবার রুহি খালা মুখ খুললেন।যা সে মনের ভেতর বহন করে এনেছেন।তবে তা যে শায়লার জন্য সুখকর কিছু নয় তা শায়লা বুঝতে পেরেছে।সেদিন শায়লাকে শিহাবের বাইক থেকে নেমে আসাটাতো সে সহজভাবে নেবেনা যেখানে তার সকল তত্ত্বাবধানেই শায়লার বিয়ে হয়েছে।রুহি খালা শায়লার মাকে খুবই সম্মান করে।তাই বেশিকিছু বলে ঘাটালো না।শুধু জানালো এই মাসের পঁচিশ তারিখে নোমান সাহেব দেশে আসছেন।দশদিন থাকবেন।শায়লার যাবতীয় কেনাকাটা গোছগাছ করে তিনি নিজের সাথে করে নিয়ে যাবেন।শায়লা যেন নোমান বাবাজির সাথে কথা বলে।বছর ঘুইরা আসলো বিয়ার। নিজের সংসারে যাওয়াতো উচিত।কথাগুলো বলেই রুহি খালা বিদায় নিলো।শায়লা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো তবে ভেঙে পড়লো না।রাহাত আর শিহাব শায়লার অনেক মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে।শায়লা হিসেব করে নিলো আজ পাঁচ তারিখ পঁচিশ হতে আর বিশ দিন।শায়লা মোটেও ভীত নয়।
শিহাবকে একটা কল দিতে হবে।কাল রাতে যে অবস্থা করেছিল সে!! শায়লা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা কাছে আনলো।

একটা দারুন ঘুম দিয়ে  বেশ এক সুখকর অনুভুতিতে শিহাবের ঘুম ভাঙল। মন থেকে সব কালো মেঘ সরে গেছে। শায়লা তাকে মনের শক্তি যুগিয়েছে।আহ! শায়লা, আমার জীবনে তুমি না এলে আমি বোধহয় বাঁচতেই পারতাম না। শিহাব চোখ মেলেই মোবাইলে শায়লার ছবিটা অনেকক্ষন তাকিয়ে দেখলো। নিবিষ্ট মনে শায়লার মেরুন রঙা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল।শায়লার ঠোঁটেই যেন তার সব আবেদন জমা হয়ে আছে আর কাজল কালো চোখ দুটোই যেন কতকালের তৃষ্ণা। হঠাৎই শিহাবের দৃষ্টিভ্রমে ছবির শায়লা যেন কথা কয়ে উঠলো!
কি দেখছো অমন করে?
শিহাব চমকে গেলো!!৷ নিমেষেই মুচকি হেসে বললো,
তোমাকে,,
আমাকে এত দেখার কি আছে?
বাহ! তুমিই তো ছবিটা পাঠিয়েছো দেখবার জন্যে,আমি দেখবো না?
ও, আমি পাঠিয়েছি বলেই দেখছো? নয়তো....ঠিকাছে ছবি ফেরত পাঠিয়ে দাও।
শিহাবের এবারের মনোকথন যেন আহ্লাদে বলে উঠলো,শায়লা, তুমি ছবি না পাঠালেও তোমার মুখটা সর্বক্ষণ আমার মনের ভেতরে গাঁথা। যতক্ষন জেগে থাকি প্রতিটাক্ষণ দিব্যদৃষ্টিতে তোমায় দেখি। ঘুমকেও দূরে ঠেলে রাখি তোমায় ভাববো বলে। যখন দীর্ঘক্ষণ বাইক চালাই সামনে হয়তো পথ দেখে চলছি কিন্তু আমার মনের আয়নায় পুরোটাই  তুমি,মনে হয় তুমি আমার সাথেই চলছো,আমার পেছনেই বসে,আলতো করে আমায় ছুঁয়ে আছো।তোমার অনুভুতি আমার বাইকটাকে উড়িয়ে নেয় পঙখীরাজ ঘোড়ার মত।নিজেকে মনে হয় স্বপ্নপুরীর ঘোড়সাওয়ার আর দৈত্যবন্দিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা তুমি আমার রাজনন্দিনী! আহ! শায়লা কেমন করে তুমি আমার হলে?
সে এক বিস্ময়!
আমার ঘুম ভাঙানিয়া! আমার কৃষ্ণ যামিনী!

এমনই সুখের ভাবনায় ডুবে থাকলেও  শিহাব আচমকা শায়লার কড়া শাসনের মাঝে  পড়লো! যেন ট্রাফিক সার্জেন্ট  আইন ভাঙার অপরাধে থামিয়ে দিচ্ছে!সহসাই শায়লার কল এলো।
--ঘুম থেকে কি জেগেছো রাজকুমার?আজ অফিসে যেতে হবে না?
আহ! শায়লার এমন বেরসিক প্রশ্নে শিহাবের সম্মোহনী অনুভবটা ছুটে গেলো! নাহ! এরা প্রেমিকা থাকাকালীনই ভালো থাকে, বউ বউ ভাব  হলেই যত আনরোমান্টিক হয়ে যায়।তবে শিহাব খুব গোপনে  সিদ্ধান্ত নিলো  শায়লার জন্য চিরকালই সে রোমান্টিক মুডে থাকবে। 
---হ্যাঁ,এইতো উঠছি।শিহাবের জবাব।আর যাচ্ছি বাবা অফিসে যাচ্ছি। আর শুনে রাখো নন্দিনী, অফিসটা কিন্তু আমারই,কারো অফিসে কিন্তু আমি চাকর নই,আমার যখন ইচ্ছা আমি যাবো,,বুঝলেন ম্যাডাম!! বলেই শিহাব, ওকে,বাই বলেই ওয়াশরুমের এমারজেন্সি কলে এক ভোঁ দৌড় দিলো!
অফিসের জন্য তৈরি হয়ে  শিহাব শায়লাকে মেসেজ পাঠালো,শায়লা,তুমি আমার ফিরে পাওয়া চাঁদ।তুমি আমার মায়া ধরানো নিশুতি রাত!খুব ভালো থেকো।
আহ! জরুরি কথাটাই তো লেখা হলোনা, শিহাব আবার মোবাইল  অন করলো,লিখলো,
তোমাকে নিয়ে  শুক্রবার জিগাতলায়  যাচ্ছি,রাহাত আর মায়ের অনুমতি নিয়ে রেখো। বাই।
মূহুর্তেই শায়লার কাছে মেসেজ পৌঁছে গেলো।শায়লা মেসেজ দেখে মিটিমিটি হাসলো।কোন রিপ্লাই দিলো না, নয়তো অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে।শায়লার চোখে কল্পনায় সে শিহাবকে ভেবে নিলো। নিশ্চয়ই সকালের ফ্রেশ লুকে শিহাবকে অপূর্ব লাগছে।আর সানগ্লাস লাগিয়ে যখন বাইক চালাবে কত মেয়ে যে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে। পরক্ষণেই শায়লা ভাবলো, আচ্ছা আজ  একটা ছবি চাইবো। নয়তো বলবো, অফিসেই একটা সেল্ফি তুলে পাঠাও!
শায়লার ছেলেমানুষিতে সে নিজেই হেসে পরক্ষনেই  ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো।এত সুখ এত স্বপ্ন কি আমার জীবনে সত্য হয়ে ধরা দেবে? শায়লার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।
লাঞ্চের আগে আগেই রাহাত শিহাবকে কল দিলো।এ নিয়ে প্রায় অনেকদিনই কথা হলো শিহাবের সাথে কিন্তু দুজনার আজো দেখা হয়নি।কী অদ্ভুত এক যোগাযোগ। তবে যাই হোক শিহাবকে কিন্তু রাহাতের বেশ ভালো লেগেছে। শুধু আফসোস হয়  আর কিছুদিন আগে কেন আপনি আপুর জীবনে এলেন না?
কেন পরিচয়টা হতে এত দেরি হয়ে গেলো।কিন্তু তবুও মন্দের ভালো যে,আপু এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।চিরকালইতো ইন্ট্রোভার্ট টাইপের আপু।
শিহাবের সাথে রাহাতের কথা হলো।দুজনেই মার্জিত আর ভদ্রতা প্রকাশে চূড়ান্ত দেখালো।দুজনার মনে একটি কমন বিষয় শায়লা।শায়লাকে সম্মান জানাতে শিহাবের সর্বোচ্চ চেষ্টা আর  আপুকে খুশি করতে যেন রাহাতের প্রানান্তকর ইচ্ছা।
শিহাব জানালো পরশুদিন শুক্রবার তোমার আর মায়ের অনুমতি মিললে আমি শায়লাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাই।শায়লার কাছে জেনেছো কিনা আমার চার বছরের একটি ছেলে আছে নাম আরাফ।
রাহাত অকপটেই জানালো, হ্যাঁ,আপুর কাছে জেনেছি।
শিহাব বলে চললো, শায়লাকে আমার বাবা,মা, ভাবী আর আমার  আরাফ বাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।যদি এতে না তোমাদের কোন আপত্তি থাকে।আর শায়লাই আরাফের মা,আমি আমার ছেলেকে সেটাই জানাবো। আরাফ সারাজীবন শায়লার কাছে মায়ের আদর পাবে আমার শুধু এটাই চাওয়া।
শিহাবের কথা খুবই স্পষ্ট এবং গোছানো। রাহাতের খুবই ভালো লাগে।তাইতো শিহাবকে দেখার জন্য রাহাতও বেশ উদগ্রীব হয়ে উঠলো!  
শিহাব জানালো,নিশ্চয়ই দেখা করবো।আমারতো একই এলাকায় থাকি।তুমি চাইলে যে কোনদিন সন্ধ্যার পর আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারি।রাহাত এবার একেবারে পুরোপুরিই শিহাবের ভক্ত অনুরক্ত হয়ে গেলো।দুজনেরই সিদ্ধান্ত হলো বৃহস্পতিবার রাতে দেখা হচ্ছে।জায়গাটা পরে শিহাব জানিয়ে দিবে। 
চমৎকার একজন মানুষ আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠছেন! রাহাত খুবই আনন্দিত হয়ে উঠলো! আপুর কাছে শুনেছে সে দেখতেও নাকি সালমানখানের জুরুয়া ভাই!! রাহাত মনে মনে পুলকিত হলো বেশ! সে শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের কাজে মনযোগী হলো।ওপ্রান্তে
শিহাব ফোন রাখতেই রিশতিনার রাতের সেই নম্বরটা থেকে কল এলো। হয়তো গুলশানে সে শিহাবেরই অপেক্ষায়। শিহাব কিছুটা কি যেন ভেবে নিয়ে রিশতিনার কলটা রিসিভ করলো ।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much