স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ২০)
শামীমা আহমেদ
সন্ধ্যায় লক খুলে শিহাব ঘরে ঢুকেই সোফায় বসে পড়লো। শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি! কত যে দৌড়াদৌড়ি গেলো সারাটাদিন!
মোবাইলটা হাতেই ধরা ছিল। কোন দ্বিধা না করেই সে শায়লাকে মেসেঞ্জারে কল দিল।
যেন সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শায়লাকে জানাতেই হবে।
শায়লা মায়ের সাথে ড্রয়িংরুমে সন্ধ্যার চা নিয়ে বসেছে সাথে মুচমুচে পাপড় ভাজা । সামনে টিভি চলছিল।
মেসেঞ্জার কলে শিহাবের মুখ ভেসে উঠল। শিহাবের নাম দেখে শায়লা দ্রুত মায়ের কাছ থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে এলো।রিসিভ করতেই শিহাব জানতে চাইলো,
সকালে ভালোভাবে বাসায় পৌছে ছিলেন তো?
শায়লা সারাদিনে সকালের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। মনে পড়তেই বলে উঠলো, আরে হ্যাঁ হ্যাঁ,এখান থেকে এখানে, এতো চেনা পথ।
আপনি কখন এলেন?চা খেয়েছেন?
এইতো সবেমাত্র ঘরে ঢুকেছি।সেই যে সকালে বেরিয়েছি নানান সব কাজ সেরে মাত্র ফিরলাম।
আজ গাজীপুরে ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলাম।এতো দিক দেখতে হয়! এক কর্মচারীর,কাজ করতে গিয়ে মেশিনে হাত ইঞ্জুরি।তাকে নিয়ে সারাদিন হাসপাতাল ডাক্তার থানা পুলিশ করা।আর সাংবাদিকদের খোঁচাখুঁচিতো আছেই। সারাক্ষণ টিকটিকির মত লেগে থাকে। এমনিতে কোন খোঁজ থাকে না, কিন্তু মালিক পক্ষের বিপক্ষে কিছু লিখতে হলে তখন সবার আগে ক্যামেরা নিয়ে হাজির। আরে সব টাকা খাওয়ার ধান্দা,বুঝলেন! সারাটাদিন লেগে গেলো সব কিছু সমাধান করতে। তা আপনি কেমন আছেন?
শায়লা বুঝতে পারছে,,শিহাব খুবই ক্লান্ত।তাইতো এত লাগামহীন কথা বলছে।এই সময়টা তার পাশে কেউ থাকা খুব প্রয়োজন।
শায়ল চুপ করেই রইলো।শিহাব এক নিঃশ্বাসে সব বলে যাচ্ছিল।বেশ হাঁপাচ্ছিল।
শায়লার খুব মায়া লাগল।আহা, মনের ভেতর কত কথা জমে আছে, কাকে বলবে? ঘরে ফিরে সারাদিনের ঘটে যাওয়া কথাগুলো অন্তত শোনার জন্যতো একজন মানুষ থাকতে হয় । আরে ঝগড়া করতেও তো একটা মানুষ লাগে।
শায়লার চোখে পানি চলে এলো।কোথায় যেন কষ্টের কাঁটা বিঁধলো।
শুধু খুব আস্তে করে বললো, ঠিক আছে, ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম করেন। একটু চা বানিয়ে বসে টিভি দেখেন।
শিহাবের কানে যেন কথাটা পৌছুলো না।
আচ্ছা, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতে পারি?
অবশ্যই, বলুন,
আপনার ফোন নাম্বারটা কি দেয়া যাবে?সব জায়গায় তো আর নেটওয়ার্ক থাকে না। সারাদিন খুব ইচ্ছে করছিল আপনাকে সবকিছু জানাই। ওয়ার্কাররা একেবারে তেড়ে আসছিল।
শায়লা বুঝে নিল সারাদিন তার যেমন গেছে শিহাবের হয়তো তেমনি অনুভব হয়েছে।প্রতিটি মূহুর্তে তার শিহাবের কথা মনে পড়ছিল।শায়লা ভেবেছিল বুঝি তারই এমনটি হচ্ছে।
আচ্ছা,আমি নাম্বার লিখে দিচ্ছি।
শিহাব জানালো, আর হ্যাঁ,আমার নাম্বার শেষে টু ফাইভ সিক্স।
আচ্ছা রাখছি।
শায়লা একেবারে স্থির হয়ে বসে রইল।চোখ বন্ধ করে সে শিহাবের কিচেনে নিজেকে ভেবে নিল।চুলায় চা বসিয়েছে আর শিহাব বারান্দায় চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে।বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দার গাছগুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার।ঘরে শিহাবের প্রিয় গজল হালকা টোনে বাজছে।চায়ের সাথে পাপড় ভাজা হয়েছে। শিহাবের খুব প্রিয়! যখনি দেয়া হবে তখনই বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলবে! শায়লা কেনাকাটায় পাপড় আনতে ভুলে না।কারণ শিহাবকে চমকে দিয়ে খুশি করা,শায়লার এই দৃশ্যটা খুব পছন্দের!
শায়লার দু'গাল বেয়ে বৃষ্টিধারা নেমে এলো।নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করে,কেন এমন হয়? যার যেখানে থাকবার ইচ্ছে সে কেন সেখানে পৌছুতে পারে না?
সন্ধ্যায় শায়লার ঘরের বাতিটা দেয়া হইনি।অন্ধকার ঘরে একা বসে শায়লা।দু'দিন আগেও অজানা অচেনা একটা মানুষের জন্য এমনভাবে অনুভব করবে শায়লা, তা কখনোই ভাবেনি।
রাতের খাবার পর্ব শেষ করে শায়লা ঘরে এলো।অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল এলো। শায়লা শেষ ডিজিট তিনটি মিলিয়ে নিলো।টু ফাইভ সিক্স। শিহাবের নাম্বার।
শায়লা রিসিভ করেই জানতে চাইলো, রাতের খাবার খেয়েছেন তো?নাকি আলসেমি করেছেন?
না খেয়েছি।
মা অনেককিছু রান্না করে পাঠিয়েছেন।
বৃদ্ধ মাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন?
মা ইচ্ছে করেই এসব করে
একা ছেলের জন্যতো করবেই,মায়েরাতো ছেলেকে বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বিশ্রাম নিতে চায়।
কি আর করা? আমার মায়ের সে ভাগ্য নেই।থাক সে কথা।আপনার কথা বলেন।
শায়লা নিজেকে আর আড়ালে রাখতে চাইল না।যদিও এমন কোন সুন্দর অতীত বা বর্তমানকে ঘিরে তার জীবন চলা নয়,তবু শিহাবতো আপন হয়ে এগিয়ে এসেছে, তাকে কিছু বলেতো হালকা হওয়া যায়।
জীবনে কাউকে না কাউকে তো আপন ভেবে নিতে হবে।নয়তো একটা মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব।সে দম আটকে মারা যাবে।খুব অল্পদিনের পরিচয়ে শিহাব তার খুব আপনজন হয়ে উঠেছে।
শায়লা আর কোন ভুমিকা না করে তার জীবনে ঘটে যাওয়া নির্জলা সত্যটা খুলে বললোএবং সে যে এখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সেটাও জানালো।
সবটা শুনে শিহাব এতটুকু অবাক হলো না।তার নিজের জীবনের চলা দিয়েই বুঝেছে এই পৃথিবীতে যেমন বিচিত্র মানুষ আছে তেমনি বিচিত্র তাদের জীবনকাহিনী। তবে কেউ পরিপূর্ণভাবে সুখী নয় এটা বলা যায়।সবটা শুনে শিহাব শায়লাকে কানাডায় যাওয়ার ব্যাপারে মতামত দিল। দুটো ফুটফুটে শিশু মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।একজন পিতা তাদের জন্য একজন মা এনে দেয়ার চেষ্টায় সাত সাগর পেরিয়ে এসেছে।শিহাবের চোখে আরাফের মুখটা ভেসে উঠল। আরাফও তো মায়ের আদর বঞ্চিত।বাবা হয়ে সে কিছুই করতে পারছে না।শায়লার মাঝে মাতৃসুলভ একটা মায়া জড়িয়ে আছে।
শিহাবকে খুবই পজিটিভ মানুষ মনে হলো।
শায়লা ভাবলো অন্যের সমস্যা খুব দ্রুতই সমাধান করা যায়। কিন্তু শায়লাতো শিহাবের মতই একজন,, না না ছি! এসব কি ভাবছে।
আড়ালে থেকেও শিহাব যেন শায়লাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছে। এমনভাবে নিয়মিত যোগাযোগে আছে যেন শায়লার খোঁজখবর নেয়াটা তার দায়িত্বে পড়ছে। শায়লাও কল্পনায় কল্পনায় একাকী এই মানুষটার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছে,যেন টেবিলে খাবার সাজিয়ে প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার অপেক্ষা করছে।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much