উপন্যাস
টানাপোড়েন ২০৩
রেখার স্বপ্নের পরমায়ু
মমতা রায় চৌধুরী
রেখা আজ বেশ কয়েকটা লেখা কমপ্লিট করল পত্রিকায় দেবার জন্য।'সিড়ি' পত্রিকার সম্পাদকের তাড়া আছে। গতকালকেই ফোন করে রিমাইন্ডার দিয়েছেন। ওই পত্রিকার লেখাটা কমপ্লিট করতে না পারলে সত্যিই রেখা মুখ দেখাতে পারবে না।
অলরেডি দুটো উপন্যাস ওনার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ।" বার্তা" পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে গল্প। ওই পত্রিকার সম্পাদক অলরেডি ফোন করে জানিয়েছেন আরেকটি গল্প রেডি করতে দর্শকরা নাকি খুব খাচ্ছেন ।ফলে রেখার চাপ আছে। লেখা কমপ্লিট করে রেখা দাঁড়াল জানলার কাছে। আকাশটার যে মাঝে মাঝে কি হয় মানুষের মতো কখনো মুখ ভার কখনোবা প্রসন্ন হাসির উজ্জ্বল ছটা । রাতের নিস্তব্ধতা রেখাকে মাঝে মাঝে টানে।সে নিস্তব্ধতা রেখার দুচোখে যেন মায়া কাজল পরিয়ে দেয়। হঠাৎই এই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল বিদ্যুতের ঝলকানি। রেখা দেখল না আর জেগে থাকলে হবে না ।এবার দু'চোখের পাতা এক করতে ই হবে। কালকে আবার যেতে হবে কলেজের মেয়েদের পুরস্কার নেওয়ার আছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই রেখা এবার বিছানায় নিজের শরীরটাকে ছেড়ে দিল
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে ,রেখা নিজেও জানেনা ।ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির শব্দে ।রেখা এবার জানলার কাছে গেল জানলা দুটোকে বন্ধ করতে। হঠাৎই নজরে পড়লো তুতু,মিলি, পাইলট কিরকম থ্রি ইডিয়েট এর মত রেখাদের বাড়ির দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে গেছে। রেখা উদগ্রীব হয়ে উঠলো ।রাতে কি শাটার টা খুলে দেয়া হয়নি? খুব রাগ হল রেখার মনোজের ওপর।এবার নিজেই দরজা খুলে নিচে গেল। রেখা অবাক হয়ে গেল সত্যিই তো খোলা নেই মনোজের এই কান্ডজ্ঞানহীনতার জন্য আরো একবার খুব রাগ হলো।
সামনে একটা বস্তা ছিল ওটাকে চেপে ধরে রেখা ওদের গা মুছিয়ে দিলো।। রেখা তুতুকে বললো" কি ব্যাপার রে ,হঠাৎ রাত্রে বাইরে আসলি?'
তুতু ওর লেজ নাড়িয়ে কাছে আসলো রেখা একটু আদর করে দিলো ।তারপর কলাপসিবল গেট লাগিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো।
এবার রেখা ঘুমোতে গেল অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেল । কালকে অনুষ্ঠান শেষ কখন হবে , তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই । লেখাগুলো মোটামুটি রেডি,একটু ফ্রেশ করে নিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হলো। এটা সবথেকে বড় চাপের ব্যাপার ছিল , সেটাতে সে চাপ মুক্ত
রেখা তাই নিশ্চিন্তে বিছানায় শরীরটাকে ফেলতে ফেলতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল
রেখা দেখছে ওর কাজ কত
বাকি ?এখনো লেখা বাকি। এদিকে কাজের মাসি আসে নি ।আজকে ওর একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাবার কথা স্কুল থেকে মেয়েদের নিয়ে ।কি হবে এখন? রেখা ভীষণ রেগে গেল ।,যে মাসিকে এত ভালবাসে সেই মাসিও রেখাকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে।
না এদের জন্য কিছু করা যাবে না।
কলিং বেলের আওয়াজ দরজা খুলতেই দেখতে পেলে চৈতির মা
একেতে কাজ কর্ম নিয়ে নাজেহাল অবস্থা সেই সময় এসেছে চৈতির মা। চৈতির মার আলুথালু বেশ,চোখের দু'কোনে কালি। চৈতির মা কে জিজ্ঞেস করল
" কি ব্যাপার দিদি হঠাৎ এ সময় আপনি?"
"না আসলাম ।
আমাকে আসতেই হতো।'
আপনি তো লেখিকা সমাজের বাস্তবতা নিয়ে আপনার লেখার রূপ দেন ।গল্পে বা উপন্যাসের আমাকে একটু জায়গা দেবেন আমাদের তো নশ্বর দেহ ওখানে আমাদের জায়গাটা চিরস্থায়ী থাকবে ।
চৈতির মার কথাগুলো যেন কেমন হতাশার মতো শোনাচ্ছিল "কেন, কি হয়েছে?'
বসুন বসুন প্রথমে এক গ্লাস ঠান্ডা জল আর দুটো মিষ্টি দিল। "রোদে তেতে পুড়ে এসেছেন।
আগে একটু বিশ্রাম নিন তারপরে কথা শুনবো।'
"আমার অত সময় নেই গো আমার কথাগুলো আপনি শুনুন।
আমার জামাই আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করছে এই বাড়িটা
ওদেরকে লিখে দিতে হবে শুধু তাই নয় আপনার দাদার ট্রিটমেন্ট ভালো করে করানোর
দিকে ওদের কোন নজর নেই।"
এরমধ্যে রেখা দেখতে পেল চৈতির মার দুই চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
"এ কথাগুলো আমি কাকে বলব দিদি, উপরে থুতু ছিটালে নিজের গায়ে লাগে।
এত জ্বালাচ্ছে এত জ্বালাচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে
না ।মেয়েটা তো এখন পোয়াতি ওকে কি দোষ দেব ?ওকে তো শ্বশুর বাড়ি ঘর করতে হবে জামাই এর কথা শুনে চলতেই হবে।"
"দাদার শরীর অবস্থা এখন কেমন?"
"ভালো নেই।"
কালকেই পার্থকে জিজ্ঞেস করছিলাম দিদি, কবে বাড়িতে আসবেন, তুমি জানতে পারলে আমাকে একটু জানিও ।তারপর ভেবেছিলাম আমি করব তা আর পেরে উঠি নি। এত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম , কিছু মনে করবেন না দিদি।'
"আমি বুঝি আপনার সংসারের কাজ রয়েছে ,তারপর স্কুলে নানা কাজ নিয়ে আপনি ব্যস্ত এর ওপরে রয়েছে আপনার লেখালেখি।"
হঠাৎই রেখার হাত দুটো ধরে বলল *আপনার লেখায় আমি যেন থাকি ।"
রেখা তার জীবনে এই প্রথম কোনো বাস্তব চরিত্র তার কাছে আকুতি মিনতি করছে তার লেখায় স্থান দেবার জন্য।'
'দিদি আপনি খুব করে লিখবেন দোষ,গুণ ,ব্যর্থতা সার্থক জীবনের কথা আপনার সাহিত্যে রূপায়িত করবেন।'
রেখা মনে মনে ভাবছে কোন কোন গল্পের লেখক এর এর ভেতরে কোন চরিত্রের আবেদন শুনতে পেয়েছে।
সাক্ষাৎ রেখার গল্প বা উপন্যাসের বাস্তব চরিত্র এভাবে আকুতি জানাবে এটা ভাবতে "পারেনি।
হয়তো তাই হবে তার জীবনের লেখক এর সাহিত্যের পাতায় এরকম কত চরিত্র আসবে আকুতি জানাবে। এক হিসেবে ভালো। কল্পনা করে চরিত্র অঙ্কন না করে হাতের কাছে চরিত্র যখন তার কাহিনী নিয়ে হাজির হয়। তখন লেখকের অত ভাবনা চিন্তা করতে হয় না।'
মনে পড়ে যায় লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষ এর" পরমায়ু' গল্পের কথা।
লেখক সুরপতি চৌধুরী র প্রথমদিকে বেশকিছু গল্প ছাপা হয়েছিল ।কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে দেখা গেছে লেখক এর নামই ভুলতে বসেছে, এমন কি যে প্রকাশক তার বইটাকে প্রকাশ করেছেন সেখানে গেলেও দেখা যায় য
লেখক যখন নতুন করে বই ছাপানোর কথা বলেছেন প্রকাশক ক। তখন তার যুক্তি এখন সবই নতুন নাম নতুন বই তার মাঝে সুরপতি চৌধুরী মুছে যেতে বসেছে।
মনে পড়ে তার কাতর উক্তি"ভুল,সব ভুল।কত অবুঝ ওরা, সাধারণ মানুষ। লেখক এর কাছে অমরত্ব চায়, কিন্তু লেখক কের নিজের আয়ু ক' দিনের….।"
তাহলে কি রেখার এরকম অবস্থা হবে আজ রেখার লেখায় কত চাহিদা কত সম্পাদক তার কাছে লেখা চেয়ে পাঠান, কাতর অনুরোধ করেন
আজ তাঁর লেখা নাকি খুব খাচ্ছে সম্পাদকদের কথা অনুযায়ী ভবিষ্যতে কি এরকমই থাকবে নাকি! উইপোকা খাওয়া বাসা যেমন ঝুরঝুর করে পরে ঠিক তেমন অবস্থা হবে রেখার। ভাবতে ভাবতে ও যেন কেমন অস্থির হয়ে উঠল ।তারপর ভাবলো না না এটা কখনো হতে পারে না, কখনো হতে পারে না ।লেখকরা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকে সেই সৃষ্টি মানুষের ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত শিকর গেড়ে বসে।
এসব ভাবছে আর কেমন যেন রেখা ঘেমে স্নান করে উঠছে।
আপন মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে ঠিক তখনই মনোজের ঘুমটা ভেঙে যায় মনোজ দেখছে "রেখা যেন কেমন বিছানায় শুয়ে পাগলের প্রলাপ বকছে যেন মনে হচ্ছে। আর হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে তখন মনোজ রেখা কে ধাক্কা দেয় কি হয়েছে ?তোমার কি হয়েছে?
তখন বড় বড় করে মঞ্চের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে আমার কি হয়েছে?
তুমিতো আপন মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলে কি হয়েছে তোমার ?শরীর খারাপ লাগছে?"
এক গ্লাস জল এনে রেখা দিলো 'এই নাও জল খাও ।'
রেখা ঢকঢক করে জল খেলো তারপর বলল
"কই নাতো শরীর তো ঠিকই আছে।"
ও বুঝেছি তাহলে তুমি স্বপ্ন দেখছিলে?
রেখা ভাবল "হ্যাঁ সত্যিই স্বপ্নই দেখছিল।
"খুব কি খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে?"
রেখা লজ্জা পেয়ে বলল, না ঠিক তা নয়। তারপর মনে মনে ভাবল এটা তার স্বপ্ন কিন্তু কতটা পরমায়ু। আচ্ছা বল তো এখন কটা বাজে ?।
পাঁচটা বাজে। এখন একটু ঘুমিয়ে নাও তোমাকে ডেকে তুলব।'
আর যদি মাসি না আসে আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে কি করে হবে? আমার কলেজে যাবার কথা আছে।'
"না ,না ঠিক মাসি আসবে মাসি ওরকম নয় আর সেরকম হলে আমি তোমাকে ডেকে দেবো।'
রেখা হো হো করে হেসে উঠলো বলল "বাবা তোমার ভরসায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি তারপর তুমি আর তোমার যা কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে
না ।তারপরে আমার কি অবস্থা হবে বলো ।দেখা গেল কপাল এমন খারাপ মাসিও কাজে আসলো না ,আর কখনোই কাজ সেরে নির্দিষ্ট টাইম এর ট্রেন না পেলে একটা প্রোগ্রামের যাবার ব্যাপার রয়েছে। তাহলে আমার কি অবস্থা হবে ভাবো।"
"আচ্ছা তুমি সব সময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন রেখা।"
"তাহলে কি করবেএখন উঠে তুমি কাজ করবে?'
রেখা মনে মনে ভাবল তাও তো ঠিক ।
"এক কাজ কর আমি ঘুমাচ্ছি ,তুমি এলার্ম দাও মাসি যে টাইমে কাজে আসে ,সেই টাইম এর মধ্যেই । মাসি আসলেও ভালো না আসলেও ভালো।"
মনোজ বলে' এটা তুমি ভালো বুদ্ধি বাতলেছ, এটা করে দিই। এতে কারোর কোন টেনশন থাকবে
না ।না আমার ,না তোমার ।কেউ কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না।'
মনোজ এলার্ম দিল তারপর বলল আচ্ছা" আজকে তুতু কোথায় ?"
"তুমি আর ওসব কথা ব'লো না ।আজকে তুতু তো বাইরেই ছিলো। তুমি তো শেষে দরজা বন্ধ
করেছ ।পরে যখন আমি ডাকতে গেলাম আসলো না ।তারপর তো বৃষ্টি হলো ।বৃষ্টির মধ্যে ভিজছে দেখে আবার আমি গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে।আবার সাটার টাও বন্ধ করে রেখেছো , সেটা খুলে ওদের ঢুকিয়ে দিলাম।"
"তা বেশ ।নাও তোমার জিৎ ',আমার হার। এবার ঘুমাও তো।"
মনোজ রেখার চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগল তারপর কখন যে দু জনা একে অপরের কাছাকাছি একটি বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে জানেই না। ঘুমিয়ে ভেঙেছে মাসির কলিং বেলের আওয়াজে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much