উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৪৩
ব্যস্ততা
মমতা রায় চৌধুরী ১৪৩
১৬.৩.২২ রাত্রি ৯.৩৫
মাধুর কাজের চাপে নাজেহাল অবস্থা। ফুল পিসি তো চেঁচিয়ে মাথা খারাপ করে দিল।
'আরে শিখার আইবুড়ো কখন হবে কোথায় হবে আইবুড়োভাত?'
'এজন্যই বলেছিলাম আমাদের বাড়িতে যেতে, সেও গেল না মেয়ে।'
ও মাধু, মাধু উ .উ .উ
মাধু, আজকে খাওয়াবে কে ওকে?'
'ওদিকে সুরঞ্জন ডাকছে, আরে পার্লারের লোক কখন আসতে বলব,ওরা জানতে চাইছে? মাধু , মাধু .উ.উ.উ'
' তুমি আবার চিৎকার করছো কেন?'
ওদিক থেকে বৃষ্টি বলছে
'মাম মাম পিমনি ডাকছে।'
তবু একগাল মিষ্টি হাসি হেসে বলল' হ্যাঁ যাই।'
এ বাড়িতে মাধুরী ছাড়া সবকিছুই অচল।
সুরঞ্জনের কাছে যেতেই ওদিক থেকে আবার শিখা ডাকছে' বৌদিভাই ,বৌদিভাই, বৌদি ভাই।
'হ্যাঁ ,বল শুনছি।'
'দোতালার ব্যালকনি থেকে শিখা, ভুরু কুঁচকে বলল' তুমি কাছে আসলে তবেই বলবো। জোরে চেঁচিয়ে বলবো না।'
মাধু হেসে বলল' এখনও গোপন কথা আমার সঙ্গে?'
এখন তো বোঝাপড়ার লোক হয়েছে ।'
পা মেঝেতে ঘষতে ঘষতে শিখা বলল 'বৌদি ভাই তুমি তো জানো আমি কতটা তোমার উপর ডিপেন্ডেন্ট। কিছু জিনিস আছে তোমাকে ছাড়া কাউকে শেয়ার করতে পারব না বৌদি ভাই।'
'তা বেশ আসছি '।
মাধুরী ছুটলো দোতলার দিকে ।তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে ।
অন্যদিকে ফুল পিসিমা বলছে, 'বললি না বউ কটার সময় হচ্ছে আইবুড়ো ভাত কার বাড়িতে খাবে ও,.'।
মাধু আবার নেমে এসে ফুল পিসিমার কাছে এসে বলল
'ওই তো ঠাকুরপুকুর মেজো মাসির বাড়িতে।'
'ও আচ্ছা।'
'এখনো তো মেজদি আসলো না।'
'সবাই আসবে ফুলপিসি। চিন্তা ক'রো না।'
ওদিকে সুরঞ্জন ফোন করল মনোজকে।
ফোন বেজে চলেছে।
তখন রেখার সাথে মনোজের চলছে তর্ক।
উত্তপ্ত পরিবেশ।
রেখা বলছে' আমি কি এমন করলাম যে তুমি সাত সকালে আমার সঙ্গে এরকম কথা বলছ।'
'কি এমন করলে মানে? তুমি নিজে জানো না?'
'না ,সত্যিই আমি জানি না। তাহলে আমাকে তো বুঝিয়ে দিতে হবে আমার ভুলটা কোথায়?'
'ও তাহলে তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে তাই তো?'
'আমার ছোটলোকের মতো ঝগড়া করতে ভালো লাগছে না। তোমার যা বলার তুমি বলে
যাও ।আমি আর কিছু বলতে পারছি না।'
'কি আমার কথাগুলো তোমার ছোটলোকের মতো শোনাচ্ছে?'
রেখা কোন কথা বলে না ।আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। ওদিকে স্কুলে যেতে হবে ।খামোখা ঝগড়া করে সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই।এমনিতেই সময়ের বড্ড অভাব। খুব তাড়াতাড়ি কাজ করতে লাগলো।
ওদিকে রেখার শাশুড়ি মা আর ননদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুজনে খুব হাসাহাসি করছে। রেখা, এক পলক তাকিয়ে দেখে ননদ শাশুড়ি মাকে রেখার দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলছে
' ঠিক হয়েছে ,ঠিক হয়েছে ।এতদিনে ভাই মুখের ওপর সঠিক কথা বলেছে। খুব তেজ চাকরি করে বলে।'
রেখা বুঝে পায় না যে কি আর চায়
ওরা ?আজকে অন্য সংসারে বিয়ে হলে এই পরিণতি হতো কিনা জানি না ।কপালটা তো আর ফেলে দেয়া যায় না ।নইলে সারাক্ষণ রেখা চেষ্টা করে সংসারের যতটুকু কাজকর্ম করা যায়, স্কুল করছে। তারপর আর কি চায়? ভেবেই পায় না এদের সন্তুষ্টি কিসে?
'আজকে মাসি কাজে আসলো না কেন? আজকেও মাসিকে ছুটি দিয়েছো?'
রেখা কোন জবাব দেয় না।।
'মা দিদিকে দেখেছো বলে ছুটি দিয়েছ?'
মাঝে মাঝে মনোজ এমন খোঁচা দিয়ে কথা বলে না গা টা পুরো রি রি রি করে জ্বলতে থাকে।
রেখা বলল 'মা দিদিকে দেখেছি মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?'
'যা বলতে চাইছি ,তুমি ঠিক শুনেছো। বলতে চাইছি মা দিদিকে দিয়ে কাজ করাতে চাইছে?'
রেখা মনোজের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় এ কোন মনোজকে দেখছে।
'তুমি ঠিকই যদি বুঝে থাকো । তাহলে কাজগুলো কে করে তুমি দেখতে পাও না?'
'হ্যাঁ ,দেখতে পাই তো।সকালে যেটুকু কাজ করে রেখে যাও । বাকি সারাদিনের কাজগুলো কে করে?'
'সারাদিনে কি কাজ থাকে আর?'
'স্কুল থেকে এসে আমি বাসন মাজছি, সারাদিনের খাবার বাসরগুলো তো জমিয়ে রেখে দেয়া হয়। আমার জন্য।'
'আর রান্না?'
'আমার যেটুকু সামর্থ্য আমি সেটুকু করে যাচ্ছি তার বাইরে তো আমি আর করতে পারবো
না ।তাহলে তো আমাকে স্কুল বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়।
আর আমি সেটা কিছুতেই পারব না।'
'মাসির খুব শরীর খারাপ। শরীর খারাপ নিয়ে মাসিকে আমি কাজে আসতে বলবো ?তোমাদের দরকার হয় গিয়ে বলে আসো ,যাও ।আমি পারবো না বলতে।'
মনোজ চুপ করে যায় । মনোজ জানে রেখা তো এরকম করার মেয়ে নয়। শুধু শুধু মা দিদির কথার উস্কানিতে এতগুলো কথা রেখাকে
বলল ।বলা বোধহয় ঠিক হলো না।।'
রেখা ঝটপট কাজ করে নিয়ে জলখাবার বানিয়ে ফেললো, দুটো তরকারিও করে ফেলল। তারপর মিলি তার বাচ্চাদের খাবার দিয়ে আর বাইরে রাস্তার কালী ও তার (বাচ্চাকুকুরগুলোকে)ও খাবার দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
মনোজ যেন কথাগুলো বলে কেমন যেন একটা আত্মগ্লানিতে ভুগতে লাগলো। রেখাকে কথাগুলো বলাটা ঠিক হলো না।।
এরমধ্যে ফোন বেজেই যাচ্ছে, এতক্ষণ দুজনের মধ্যে এত তর্ক হচ্ছিল যে ফোনের প্রতি ধ্যান দিতে পারেনি। এখন ফোনটা রিসিভ করল মনোজ বললো 'হ্যালো।'
'আমি সুরো বলছি হাঁদা।'
"হ্যাঁ বল।'
'বল মানে ?তোরা এখনো বসে আছিস? তোরা আসবি না, নাকি শিখার বিয়েতে?'
"হ্যাঁ যাবো তো।'
মনোজ ভাবছে 'বলে তো ফেললাম সুরোকে কিন্তু
'কি বলবে সুরঞ্জনকে? একটু আগে রেখার সাথে যা উত্তপ্ত কথাবার্তা হলো, তাতে রেখা কি রাজি হবে যাওয়ার জন্য?'
"আর রেখা কোথায় বলতো ?রেখাকে দে না ফোনটা?'
"ওতো বাথরুম আছে।'
মনোজের কথায় কেমন যেন একটা , নিরুৎসাহ ভাব প্রকাশ পেল ।সুরঞ্জন ভাবতে লাগলো "কিছু কি হয়েছে?'
'তা তোরা কখন বের হচ্ছিস?'
"আজকে মনে হয় হবে না ।বিয়ের দিন যাব।'
"মানে কি বলছিস ?বিয়ের দিন আসবি?"
'রাগ করিস না বন্ধু, জানিস তো আমাদের কতগুলো বাচ্চা আছে ওদেরকে খাওয়ানো দাওয়ানো এসব তো করাতে হয় ।দুদিন আগে গিয়ে কোন লাভ নেই ,এতে ওদেরই অসুবিধা হবে।"
সুরঞ্জন বলল' তোরা না আসলে বিয়ে বাড়ির আড্ডাটা কি করে জমবে বলতো?'
"যা ভালো বুঝিস কর আমার আর কিছু বলার নেই।"
এরপর ফোনটা কেটে দিলো।
ফোনটা কাটার পর মাধুরী লক্ষ্য করল সুরঞ্জনকে কেমন নিরুৎসাহ দেখাচ্ছে।
মাধু আর ঘাঁটালো না সুরঞ্জনকে ।প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে।
ওদিকে ডিজাইনার ব্লাউজ বানাতে
দিয়েছিল ।শিখার ও আছে। অন্যদিকে মাধুরও আছে, তা দিতে এসেছে। তারা ডাকাডাকি করছে।
ফুল পিসি চিৎকার করছে ও মাধু কে ডাকছে দেখো।
"হ্যাঁ যাই ।যাই পিসিমা।'
ওদিকে ক্যাটারিং এর ছেলেরা ডাকছে, জলখাবার হয়ে গেছে।
মাধু গেটের কাছে যেতে যেতে বলল' ফুল পিসিমা, আপনারা সবাই আসুন জলখাবারটা খেয়ে নিন।'
'রানী বৌদিরা কোথায় গেল ওনাদের কেউ একটু জানিয়ে দিন না পিসিমা।'
গেটের কাছে যেতেই দেখা হয়ে গেল মেজ পিসিদের সঙ্গে।
"ও মাধু ,বাপরে বাপ কি ট্রেনে ভিড় !কি ট্রেনে ভিড় !তোমায় কি বলি?'
পিসিমা আপনারা যান উপরে ।নিজে নিজে রুমে গিয়ে লাগেজ গুলো রাখুন আমি মনা কে পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
'মনা মনা, মেজ পিসিরা এসেছে ওনাদের লাগেজ গুলো একটু উপরে নিয়ে যাও।'
'হ্যাঁ ,যাই বৌদি।'
'ও বাবা তিনুটা কত বড় হয়েছে পিসি?'
জবা ভালো আছো তোমরা? জিবেশ কোথায়? ''ওই তো দাদার সঙ্গে কথা বলছে।''
'যাও যাও তোমরা রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নাও তারপর ফ্রেশ হয়ে জলখাবারটা খেয়ে নাও।'
'তোমরা এসেছো কি ভালো যে লাগছে।'
জবা বললো 'তোমার বাবার বাড়ির লোক আসেনি?'
'না ,না । ও জানো না শিখার তো আমার দাদা শালার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। ওরা তো ওখানে ব্যস্ত।'
'ও তাই বুঝি?'
এতসব লোকজনের মাঝে শিখা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা ঘেটু ঘেটু করে ওরা শ্লোক আওড়াছে আর পয়সা আদায় করছে।।
শৈশবের স্মৃতিগুলো বড় বেদনাদায়ক সেই শৈশবকে হাজারো বার ফিরে পেতে চাইলেও পাওয়া যায় না। তবুও সেই শৈশবটা বেঁচে থাকে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে কিছু পালা পার্বণের মধ্যে।শিখা মনে মনে এটা ভাবল। আর ওরা সেই ঘেটু গান করতে করতে চলে যাচ্ছে। ওটা উপর থেকে দেখতে লাগলো। একবার মনে হলো শিখা ডাকে। গেট পেরিয়ে যখন যাচ্ছে তখন ডেকেই ফেলল 'এই শোন, শোন ,তোরা এদিক আয়।'
বাচ্চারা এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাল । তখন শিখা ওদেরকে ইশারায় ডাকলো ওরা খুব খুশি হল।
বলল' আমাদের কিছু দেবে?'
"হ্যাঁ ,দেবো তো ।আয়।'
আসলে আজকে তোমাদের বাড়ি কি আছে? বিয়ে নাকি গো? তোমার বিয়ে?'
'তোরা আয় না।'
বাচ্চারা খুশি হয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালো। শিখা তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে ,সেই সময় ফুল পিসিমার চোখে পড়াতে বলল
' আরে তুই কোথায় যাচ্ছিস ?এই অবস্থাতে কোথাও যাবি না একা একা।'
একটু থমকে দাঁড়ালো
শিখা বললো 'সামনে গেটের কাছে যাচ্ছি।।
কোথাও যাওয়া হবে না ।'
।এ কিরে কি অবাধ্য মেয়ে তুই কথা শুনবি না
এবার কি করে বাচ্চাগুলো গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, কত আশা করে ডেকেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।।'
মাধুরী ভাড়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। তখন বলল 'ও বৌদি ভাই ও বৌদি ভাই শোনো না?'
'এখন না শিখা, একটু পরে আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।।
'না তুমি এখনই আসো, খুব দরকার।'
"বায়না করিস না শিখা হেসে বলল।'
'আমি তো যেতে পারছি না তাই তো তোমাকে ডাকছি। ওদিকে থানার বড়বাবু বসে আছে।'(ফুল পিসিমা)।
মাধু বলল' কি যে বলিস না মাঝে মাঝে?
বল কি হয়েছে?
ঘেটু গান করতে করতে যাচ্ছিল ওদেরকে ডেকেছি আমি ওপর থেকে ওদেরকে কিছু টাকা দিতে হবে আমি যাচ্ছিলাম ফুল পিসিমা আমাকে বারণ করল।।
গাল ফুলিয়ে শিখা বলল।
ও আচ্ছা ঠিক আছে আমি দিয়ে দিচ্ছি মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মাধুরী শিখার।
মাধুরী গিয়ে ছেলেগুলোকে একশটা টাকা ধরিয়ে দিল।
ছেলেগুলো এত খুশি হল মাধুকে প্রণাম করতে আসলো, বললো না বাবা ,তোমরা ঘেটু নিয়ে আছো, থাক তোমরা এসো।
বাচ্চারা বলল 'তোমরা খুব ভালো, কাকিমা।'
মাধু বাচ্চাগুলোকে কাছে টেনে একটু আদর করে গালটা টিপে দিল।
শিখা সব উপর থেকে দেখতে পেল আর বলল মনে মনে এজন্যই আমার বৌদি ভাই সব থেকে ভালো।'
'তোমাদেরকে খুব মিস করবো
বৌদি ভাই ।বিশেষত মা মারা যাবার পর থেকে তুমি যেভাবে আমাদেরকে আগলে রেখেছো
তুমি ।ভালো থেকো বৌদি ভাই সব সময়। আর চোখের কোনে জল এসে জমা হলো।'
বৃষ্টি এসে বলল' পি মনি তুমি কাঁদছো?'
'কাঁদছো কেন পি মনি?'
বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে আরো কেঁদে উঠলো শিখা।
অন্যদিকে মাধু বৌদি সকলকে নির্দেশ দিতে থাকলো ।সব আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ।'যাও ফুল পিসি ,মেজ পিসি বাকি যারা যারা আছেন সকলকে ডেকে নিয়ে আসো নাস্তা করে নিক। তারপর তুমিও খেয়ে নিও কেমন ?তারপর যেমন যেমন বলেছি লাগেজ গুলো সব সাজিয়ে রেখেছো তো মনা সব?
ঘাড় নেড়ে বলল 'হ্যাঁ সব ঠিকঠাক করে রাখছি'।
মেজ পিসি, ফুল পিসি সকলে গল্প করছে সেই হাসির ছটাও বেরিয়ে আসছে থেকে থেকে ।শুধু শিখাই পারছে না আনন্দ করতে ।কেন ?কি জানি মনটা কিসে ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে সে নিজেই বলতে পারবে না।'
বিয়ে বাড়ির এত ব্যস্ততায় তার বৌদি ভাইয়ের যে কতটা কষ্ট হচ্ছে একার উপরে এত চাপ বৌদি ভাই ছাড়া এ সংসারটা সত্যিই অচল।
অন্যদিকে থেকে থেকে সানাইয়ের শব্দ কানে ভেসে আসছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much