উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৩২
দু'মুঠো বিকেল ছুঁড়ে দাও
মমতা রায় চৌধুরী
বাপরে বাপ কি এক উষ্ণতা সারা শরীর
জুড়ে ।যেন মনে হচ্ছে শরীরটাকে পুড়িয়ে
দিচ্ছে ।বাড়িতে ফিরে এসে বারবার ওয়াশরুমে গিয়ে ঠান্ডা জলে ছিটে দিচ্ছে শিখা। তবে আজকের বিকেল মনে রাখার মত।
শিখাকে দেখে মাধু বৌদি বলল 'হ্যাঁ রে তোদের আজকে অনেক কেনাকাটা হলো না?
কোন সাড়া না পেয়ে বৌদি ওপরে উঠে আসল 'শিখা ,শিখা, শিখা।'
কেউ কোথাও নেই দরজাটা হাট করে খোলা গেল কোথায়? এদিকে বাথরুম থেকে জলের আওয়াজ আসছে বুঝতে পারল বাথরুমে আছে ।বাথরুমের দরজায় নক করলো 'ঠিক আছিস?'
শিখা চোখেমুখে জল ছিটিয়ে দেয়ার চেয়ে মনে হয়েছিল নিজেকে ঠান্ডা জলে একটু ভিজিয়ে নিলে ভালো হয় তাই শাওয়ারটা খুলে দিয়েছিল শাওয়ারের কলটা বন্ধ করতে করতে বলল
'হ্যাঁ বৌদি?'।
'ঠিক আছে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসবি। খাবার দেব?'
'আজকে আমি কিছু খাব না বৌদি।
শিখা মনে মনে ভাবছে এখনো গা টা যেন আনচান করছে।'
'খাবি না মানে? কেন খেয়ে এসেছিস? বাবা, কল্যাণ এখনই তোকে বাইরে খাইয়ে দিচ্ছে। ভালোই তো এরকম ঘুরতে বেরোবি ,বাড়িতে এসে আর কোন রান্নাবান্নার ঝামেলা থাকবে না।',হাসতে হাসতে বলল মাধুরী।
'আমি চললাম রে। যাই ওদিকে তোর দাদা ,বৃষ্টি সব তোর জন্য ওয়েট করছিল।'
মাধুরী তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসলো ।
বৃষ্টি বলল 'মা পিমনি কি আসবে না খেতে? '
'না মা ,তোমার পিমনি খেয়ে এসেছে।'
সুরঞ্জন বলল 'খেয়ে এসেছে মানে,,,?
'বাইরে বেরিয়ে ছিল না কল্যান আর শিখা।'
মাধুরী চিকেন রেজালা বাটিতে দিতে দিতে বলল কিন্তু ওর জন্যই তো আজকে চিকেন রেজালা করেছিলাম ।থাক কাল খাবে?'
"আমিও চিকেন রেজালা খেতে ভালোবাসি মা।'
যেই শিখার কথা বললাম ওমনি আমারও ভালো লাগে ।ভালো লাগে তো খাও।'বৃষ্টির নরম গাল দুটো টিপে দিয়ে বলল' খুব হিংসুটে হয়ে যাচ্ছ না?'
সুরঞ্জন বলল 'এই মাধু তুমিও একবারে নিয়ে নাও। একসঙ্গে খাই।'
শিখা বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজেকে খাটের উপরে এলিয়ে দিল আর ভাবলো কল্যান গাড়ি কিনেছে নিজেই ড্রাইভ করছিল। শিখাকে ড্রাইভ শেখাতে গেছিল। নতুন ড্রাইভ শিখতে গিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলে। খুব বাঁচা বেঁচে গেছি।ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে যতটুকু না ভালো লেগেছিল তার থেকে বেশি ভালো লেগেছিল কল্যাণের সান্নিধ্য।
কেন এরকম হয়েছিল কে জানে? আর তো বেশিদিন তাদের আলাদা থাকতেও হবে না। তবুও বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ"একটা গেল গেল 'বলে একটা শব্দ উঠেছিল ।'ঘ্যাঁচ 'করে একটা বিশ্রী আওয়াজ করে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কল্যাণ হ্যান্ড ব্রেক টেনে দিয়েছিল।সঙ্গে সঙ্গে শিখার ডান পাটাও আপনানথেকে উঠে এসে এক্সেলেটর এর ওপর চেপেও বসেছিল। গাড়ির সামনে পড়েছিল একটা বাচ্চা ।ঈশ্বরের অসীম কৃপা যার জন্য বাচ্চাটি বেঁচে গেল।পথচারীরা সব, জড়ো হয়ে গেছিল। ভয়ে গাটা খুব কাঁপছিল সেটা এখনো রয়েছে।
যাক কি বিশ্রী কান্ড হত ভাবতেই পারছি না।
তবু এত কিছুর মধ্যে কল্যাণের সান্নিধ্যটা মন ছুঁয়ে গেছে। অথচ বিয়ের আর বেশি দিন বাকি নেই। হ তখন কল্যাণ কে সব সময়ের জন্য পাবে। তাহলে মনে এত অধৈর্য্য হচ্ছ কেন?
অন্যদিকে আজকে কল্যাণের গলাটা ভালো ছিল না মাঝে মাঝে গলাটা ধরে আসছিল গলায় কি ইনফেকশন হয়েছে ?একবার ফোন করার দরকার।
ভাবতে ভাবতেই রিং করলো । ফোন বেজে গেল ধরল না। আবার ঘুরিয়ে ফোন করলো ফোনের রিংটোন বাজছে'ক্রমশ গল্পগুলো পাতা জুড়ে যাচ্ছে, দুমুঠো বিকেল যদি চাও ছুঁড়ে দিতে পারি...।'
এবার ফোন ধরল বলল' হ্যালো'।
'আমি বলছি।'
বুঝতে পারছি বলো।
তোমার গলার অবস্থা তো খুব খারাপ।
গারগিল করেছ?
না এখন করা হয়নি।
সেকি?
'এত নেগলেট কেন করো?'
'না ,শিখা এসে একটু কাজে বসে ছিলাম।
একটা ভাইটাল লেকচার দেওয়ার আছে সেটাই রেডি করছিলাম।'
'কিন্তু যা গলার অবস্থা দেখছি তুমি পারবে?
বিশ্রাম দাও না গলাটা কে।.. ছুটি নেয়া যায়না?'
'তা যায় তবে এখনই ছুটি নেব এরপর তো ছুটি কাজে লাগবে।'
'থাক শরীর খারাপ বরং তুমি ছুটি নাও আর গলার ডাক্তারকে দেখিয়ে নাও।'
'আর কটা দিন দেখিনা?'
'গলাটা তোমার বড্ড খারাপ হয়েছে এরপর আরো কটা দিন দেখবে, বুঝতে পারছ সামনে একটা ভাইটাল তোমার প্রোগ্রাম রয়েছে?'
"সব বুঝতে পারছি।'
"না ,তুমি আগে ডাক্তারের কাছে যাবে, কথা দাও।"
'দেখি কালকে তো একটা জায়গায় যাবার আছে লেকচার দেবার আছে। তারপরে সে না হয়..।'
'তুমি ঠিক আছো?'
"আমি তো ঠিক আছি কিন্তু তোমাকে নিয়ে তো টেনশন হচ্ছে।'
', তোমার রিসেপশনের শাড়ি কেনার জন্য আরেকদিন বেরোতে হবে বুঝলে?'
'আমাকে যেতেই হবে তুমি কিনে নিও তাহলেই হবে।"
'তোমার একটা পছন্দের ব্যাপার আছে বিয়ে বলে কথা সারা জীবনের ব্যাপার তোমার পছন্দটা তাতে থাকবে না?'
শিখা কিছুক্ষন চুপ করে থাকে ।
এরকম দুমুঠো বিকেল পেতে তো ভালোই লাগে। তোমার ভালো লাগলো?'
শিখা বলল' কি করে বোঝাবো তোমায় আমি। আমার ভেতরে কি যে হচ্ছে।'
কল্যান বললো ' বলো, বলো কি হচ্ছে ?'
"জানিনা।'
'তাহলে আমাদের গল্পের পাতা যেখানে জুড়ে যাচ্ছিল তুমি এখানেই শেষ করে দিতে চাইছ।'
'এসে আমাকে অসময়ে শাওয়ারে ঢুকতে হয়েছে।'
'সেকি?
'তুমি ঠিক আছো?'
'হ্যাঁ স্নান করতে হলো।'
'কেন?
'এই শোনো, তুমি সব বোঝো। তারপরও তুমি এভাবে আমাকে প্রশ্ন করছো?'
ইসসসস স।
'ঠিক আমি কল্পনা করছি তুমি ভিজে জলে ভেজা গায়ে কোনরকমে বাথগাউনটা জড়িয়ে স্নান থেকে ছুটে এসেছ তাই না ?তারপর তোমার সদ্য স্নাত দেহ থেকে বের হচ্ছে সুবাস। ভিজে চুল লেপ্টে আছে তোমার গালে ,কপালে ,চোখের পাতায় অভ্রচুর্নের মত জলকণা জমে আছে ।কবে যে তোমাকে এই রূপে দেখতে পাবো। নিজেকে সামলাতে পারছি না ।'
ঠিক এভাবে যখন তুমি আমার বাড়িতে আসবে সদ্য স্নান করে তুমি আমার কাছে এসে দাঁড়াবে চুল থেকে বিন্দু বিন্দু সুরভিত টুপটাপ করে পড়তে থাকবে প্রসাধনহীন মুখের চারপাশে ভিজে চুল লেপ্টে থেকে কি অসাধারণই না
লাগবে ।তোমার গাউনের নিচে থাকবে না কোনো বর্ম চর্ম ।শুধুই তুমি আবরনহীন সমস্ত সুবাস আমি আমার ইন্দ্রিয়দিয়ে নিজের কাছে টেনে নেব।'
'হয়েছে মশাই, আর কাব্য করতে হবে না।'
'আমি তোমার বাড়িতে যাইনি ,আমি নিজের বাড়িতেই আছি আর তুমি তোমার বাড়িতে আছো।
এবার বাস্তবে ফিরে এসো'
'শোনো তুমি অবশ্যই কথা দাও যে তুমি ডাক্তার দেখাবে।'
'জো হুকুম ম্যাডাম।'
শোন আমি ফোন রাখছি আমার কালকে একটা ভাইটাল lecture আছে ।ওর জন্যআমাকে রেডি হতে হবে বুঝেছ?
'বুঝলাম।
'রাগ করলে'
'রাগ করে ও তো উপায় নেই।'
'ঠিক আছে এখন রাগ করলেও পরে সুদে আসলে ফেরত দেবো।'
'টেক কেয়ার।'
'তুমিও নিজের প্রতি যত্ন নিও। বাই।'
ফোন কেটে দিল।
সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ল। খেতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছিল।
ল্যাপটপের অক্ষরগুলো টপাটপ ফণা তুলে স্কিন ভরিয়ে দিতে লাগলো।
আজকে কি হয়েছে কল্যাণের পদে পদেই কি যেন একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাক লেখা গুলো আসছে না। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয়।
এরমধ্যে কলিং বেল বাজল। দরজা খুলতেই দেখা গেল কয়েকজন ভদ্রমহিলা।
ল্যাপটপ বন্ধ করে কল্যান ভদ্রমহিলা দফায় বসার জন্য অনুরোধ করলেন।
নমস্কার।
নমস্কার।
আমরা এসেছি অল বেঙ্গল উইমেনস লীগ থেকে।
আমাদের তিতলি ম্যাম পাঠিয়েছেন।
কিন্তু এতটাই কাজে ব্যস্ত কল্যাণ সে কথা মুখ ফুটে বলতে পারছে না তাহলে সর্বদা মুখে হাসি দেখেই স্বাগত জানাতে হয়।
এবার এদের হাত থেকে কিভাবে অব্যাহতি পাবেন। এদের হাজারো চাহিদা।
এতকিছু মন দিয়ে শোনার সময় ও কল্যাণের কাছে নেই। জানি কি করে এদের কাছ থেকে অব্যাহতি পেতে হয়।
কয়েকটি কৌশল আয়ত্ত করে রেখেছে।
প্রথমে যখন তাদের কথাগুলো আর শুনতে ইচ্ছে করবে না তখন কল্যান হয় একটু অমনোযোগী হয়ে যাবে না হলে কিছু শুনাও শুনতে না পাওয়ার ভান করবে নয়তো জবাব না দেবে তাতেও যদি শেষ রক্ষা না হয় তখন আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়াবে।
কারণ আজকে তাকে এই লেখাটা রেডি করতেই হবে।, যা ভাবা সে রকমই কাজ।
শেষপর্যন্ত তাদেরকে বিদায় জানিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আবার ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ল।
এর মধ্যেই কাজের মাসি এসেছে।
রিতা মাসিএসে বলল 'কফি খাবে?'
,'হ্যাঁ দিলে খুব ভালো হয় মাসি।
ল্যাপটপে চোখ শুধু হেসে কথাটা বলল।
' আমাকে একটু গারগিল করার জল দাও তো। গলাটা খুব ধরে আছে।'
'হ্যাঁ ,দাঁড়াও আমি এক্ষুনি দিচ্ছি।'
গারগিল এর জল দিয়ে গেল রিতা মাসি ।গারগিল করল তারপর ব্ল্যাক কফি করে দিয়ে গেল।
মাসি বললো আজকে রাত্রে কি করব চানার তরকারি আর রুটি খাবে?'
'আজকে আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মাসি?'
'না ,না ,না খেলে কি করে হবে। ওভাবে বলো না তো ,কিছুতো খাও।'
'মাসি কফিটা খুব ভালো হয়েছে।'
'যাক তোমার ভালো লেগেছে আমি খুব খুশি।'
'কি করব বল?'
'কি বলি বলতো? আমার তো খেতে ইচ্ছে করছে না?
ঠিক আছে শোনো ঘরে কলা আছে তো মাসি?'
'হ্যাঁ ,আছে।'
'ঠিক আছে তুমি ডিম টোস্ট করে যাও আর সেরকম হলে আমি ওটস খেয়ে নিতে পারি।
ঠিক আছে।'
'আর শোন ও মাসি কালকে একটু সকাল সকাল আসবে কালকে কিন্তু আমার একটা জায়গায় ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে।'
'তাই আসবো।'
'মাসি খাবার বানিয়ে রেখে বলে গেল শোনো তোমার গলাটা কিন্তু আমার মোটেই ভালো লাগছে না ।তুমি কাল গলার ডাক্তারকে দেখিয়ে ফেলো বাবা।'
'দেখি চেষ্টা করব নিশ্চয়ই। তুমি ভেবো না মাসি।'
'মাসি চলে গেল। আরো ঘন্টাখানেক লেখার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করল। একটা লেখা দাঁড়ালো কিন্তু মনের মতো হল না। আর পারা ও যাচ্ছে না।
একটু রিলাক্স করার দরকার।
ল্যাপটপ টা বন্ধ করার আগেই আবার ফোন বেজে উঠল।
কল্যাণ বলল 'হ্যালো।
কল্যাণ মনে মনে এটাই চাইছিল শিখার ফোনটা আসুক।
মনে হচ্ছিল দুমুঠো বিকেল স্পর্শ করে যায় স্নিগ্ধতায়। বড্ড ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু না ফোনটা প্রফেশর দত্তর কাছ থেকে।
'আপনার লেখা রেডি?'
'হ্যাঁ রেডি করেছি।'
আমাদের কলেজ থেকে আপনিই যাচ্ছেন।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।'
তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে আপনি পৌঁছে যাচ্ছেন প্রিন্সিপালকে বলে দিচ্ছি।'
কারণ এই কাজটা আপনার দ্বারাই হত।
ঠিক আছে রাখছি তাহলে আপনি রেস্ট নেন তবে আপনার গলাটা কিন্তু ধরা ধরা লাগছে গলায় কিছু হয়েছে কি?'
'ঠান্ডা লেগে বোধ হয়।'
'ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন। রাখি তাহলে।
বেস্ট অফ লাক।'
ফোনটা নামিয়ে রেখে কল্যান চলে গে'ল ছাদে।
একাকী নিজেকে জানতে ইচ্ছে করছিল। এতক্ষণ ধরে একটা টানাপোড়েন চলছিল। ছাদে গিয়ে দেখল মস্ত একখানা তামার পুষ্প পাত্রের মতো লালচে চাঁদ উঠেছে।
অপরূপ তার সৌন্দর্য। শন শন শব্দে হাওয়া বইছে। এই তামার থালাটি ও একসময় ঢাকা পড়ে যাবে অসুখী হয়ে উঠবে রাত্রির চিকন মুখ।
তবু এই মুহূর্তে এই চাঁদের সৌন্দর্য তার মনটাকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিল। আর দুমুঠো বিকেল এর যোগাযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much