সেদিন গোধূলি সন্ধ্যা ছিল
( ১৬ তম পর্ব )
মনি জামান
রাত শেষে ভোরের আলো ফুটলো চারি দিকে,পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনতে শুনতে যেন সকাল হলো,সকালের নাস্তার জন্য জান্নাত আসমাকে ডাকলো ভাবি আসেন নাস্তা রেডি।আসমা ঘরের ভিতর বুঝতেই পারলো না এখন সকাল আটটা বাজে,আসমা উঠলো দাঁত ব্রাস করে চোখ মুখ ধুয়ে খেতে এলো টেবিলে।
জান্নাত বলল,ভাবি খেয়ে নিনি আসমা নাস্তা নিয়ে নাস্তা খেলো,খাওয়ার পর বলল,বোন তুমি স্কুলে যাবে না আজ?জান্নাত বলল,হ্যাঁ ভাবি যাবো নয়টায় আমাদের ক্লাশ শুরু আগে ঘরের কাজ গুলো সব সেরে নেই।
বাড়ির সব কাজ সেরে জান্নাত স্কুল ড্রেস পরে আসমাকে বলল,ভাবি আমি স্কুলে যাচ্ছি তাড়াতাড়ি ফিরবো আপনি কোথাও যাবেন না।আসমা বলল,বোন তুমি স্কুলে যাও আমি একটু ঘুমাবো আমার খুব ঘুম পাচ্ছে বলেই আসমা ঘুমাতে গেলো তারপর শুয়ে পড়লো শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে,কখন ঘুমের অতলে ডুব দিলো আসমা জানে না, যখন জেগে উঠলো আসমা তখন দুপুর হয়ে গেছে কখন টেরই পেলো না তখনো ও আসমা শুয়ে আছে।জান্নাত কখন ফিরেছে স্কুল থেকে আসমা কিছুই জানে না জান্নাত যখন আসমাকে ডেকে বলল,ভাবি উঠেন গোসল সেরে নেন বেলা অনেক হয়েছে,আসমা উঠে বসলো তারপর ওয়াশ রূমে গিয়ে দুপুরের গোসল সেরে নিলো আজ একটু ঝরঝরে ফ্রেশ লাগছে নিজেকে,জান্নাত বলল,ভাবি কিছু লাগলে আমাকে বলবেন আমি একটু থালা বাটি ধুতে যাচ্ছি,আসমা বলল,ঠিক আছে কিছু লাগলে বলবো তোমাকে বোন বলেই আসমা আবার ঘরে চলে এলো।
আসমার ললাটে কলঙ্কের তকমা লাগানোর পর থেকে লজ্জায় কোথাও বের হয়নি আজ দুইদিন,সারাদিন ঘরে কাটে আসমার একাকি সময়।আসমা ভাবছে ফিরোজকে তার কথা গুলো বলা উচিত,কিন্ত ফিরোজ তো ঢাকায় কাজে আছে,বাড়ি ফিরলে আসমা আর যেতে পারবেনা যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে সেখানে যেতে,চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো তারপর কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলো।
সাংবাদিক ফিরোজকে উদ্দশ্যে করে লিখলো-
প্রিয় ফিরোজ ভাই,
জানি তুমি ঢাকায় আছো কাজে,আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি,তবে আমাকে ক্ষমা করো ভাই আমার কিছুই করার নেই,তাই সেদিন তোমার বিয়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,হয়তো তুমি দুঃখ বা অনেক কষ্ট পেয়েছো আমাকে অহঙ্কারিও ভেবেছো কিন্তু আমি কখনো অহঙ্কারি ছিলাম না। আমার রাজকুমার জিকু আমার হৃদয়ে এতোটা জায়গা জুড়ে আছে,সেখানে আমি আর কারো কথা ভাবতে বা কল্পনাও করতে পারিনা,কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দিও ভাই।আর কখনো তোমার সাথে আমার দেখা হবে না কথা ও হবে না,এমন কি আমার বাবা মা ছোট দুটো বোনের সাথে ও না।তুমি ঢাকা থেকে ফিরে যদি আমার মৃত লাশ পাও তবে তোমার কাছে অনুরোধ আমার লাশটা আমার রাজ কুমারের কবরের পাশে আমাকে কবর দিও,যদি অপরাধ করে থাকি বোন হিসেবে এই অভাগী বোনের অনুরোধ টুকু রেখো ভাই এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।
---
ইতি আসমা।
আসমা চিরকুট লিখে টেবিলের উপর সুন্দর করে কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিলো,তারপর ঘরের জানালার সিক ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে বাইরের আলো ঝলমলে দুপুরের উত্তপ্ত রোদ যেন ঝা ঝা নৃত্য করছে,তবুও আজ এত সুন্দর দুপুর মনে হয় কখনো দেখেনি সে।আসমার খুব মনে পড়ছে আজ তার ছেলে নয়নের কথা,স্বামী জিকুর কথা।প্রবল ইচ্ছে করছে তার স্বামীর কবরটা ও শেষ বার একটু দেখে আসার জন্য,আসমা জানে সে এই কলঙ্কিত মুখ নিয়ে বের হতে পারবেনা কোথাও,তবুও ইচ্ছে করছে যদি একবার তার প্রিয় রাজকুমারের কবরটা শেষবারের মত দেখতে পেত।আজ সব ইচ্ছের কবর দিয়েছে সে,মোমেনা বেগমের বাড়ি থেকে করব স্থান একটু দুরে ফিরোজদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কবর স্থান দেখা যায় দিনের বেলায়।
আসমা জানালা দিয়ে দেখছে কিন্তু সেটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, শুধু বাঁশ বাগান আর ঝোপঝাড় ছাড়া কিছুই দেখা যায় না,পুরো কবর স্থান জুড়ে যেন ঘিরে রেখেছে বাগান গুলো।
আসমার আজ বার বার মনে হতে লাগলো পাষান পৃথিবীর এই জীর্ণ কুঠিরে সে একা, অথচ একদিন ভালবাসার বাসরে রাজকুমারের সাথে গল্পে গল্পে কেটেছে কত যে নির্ঘুম রাত কত আনন্দ কত প্রেম দিয়েছে তার রাজকুমার তাকে উজাড় করে।
এ জীবনে রাজকুমার ছাড়া তাকে আর কেউ এত ভালোবাসেনি অথচ আসমা আজ সমাজের চাপিয়ে দেওয়া কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে এ পৃথিবীতে বেঁচে আছে, ভাবছে আসমা চোখ দুটো অশ্রুতে ছল ছল করছে যেন শ্রাবণ শুরু হয়ে গেছে।আসমার এই ক্ষণিক জীবনে ঘটে যাওয়া কষ্ট গুলো তাকে এতোটাই বিমূঢ় করে তুলেছে যা জীবনে কখনো ভাবেনি আসমা এমন হবে তার জীবন,আজ স্মৃতির বাক্স গুলো সব রেখে যাচ্ছে সে।জীবনের সব চাওয়া যেন দুহাত ভরে নিয়েছে কুড়িয়ে, অযত্নে লালিত কষ্ট নামের প্রিয় মুহুর্ত গুলো।আসমা কাঁদছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,আজকের বিকেলটা গোধূলি রঙ মাখাছে যেন আকাশকে, আবির ছড়াচ্ছে দিন আর সন্ধ্যার প্রণয়ের খেলা চলছে এখ ঠিক এই মুহুর্তে।একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে আসমা জানালায় দাঁড়িয়ে অবলোকন করে দেখছে পৃথিবীর শেষ দৃশ্য গুলো,এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কত স্বপ্ন ছিলো তার,আজ সব স্বপ্ন মুছে গেছে তার জীবন থেকে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান এক বাস্তব কঠিন সত্যের সামনে।
আসমা ভাবছে পৃথিবীর কোন সংবিধানে,কোন আইন প্রণেতা লেখেছিল কি ধনী গরীবের ভালোবাসা অপরাধ?যদি নাই লিখে থাকবে তাহলে সমাজ এত নিষ্ঠুর কেন,কেন গরীব ঘরের মেয়ে বলে?আসমা ভাবছে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কষ্টের কথা গুলো আসমা ঘরে একা সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই,আসমার ছেলে নয়নের কথা মনে পড়ছে খুব কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার জন্য কিন্তু কিছুই করার নেই তার,বাড়ি ফিরে যাবার ও উপায় নেই শাশুড়ি কলঙ্কের তিলক এঁকে দিয়েছে তার ললাটে আজ সে কলঙ্কিত। এ মুখ নিয়ে সন্তানের সামনে কি করে দাঁড়াবে আসমা?মন স্থির করলো সন্তানের কাছে ফিরে যাবেনা সে হঠাৎ জান্নাত রাতের খাবারের জন্য ডাকলো ভাবি খেতে আসুন ভাত নিয়ে এসেছি।আসমা চমকে উঠলো উঠেই চোখ মুছে বসলো কারণ গভীর ভাবনায় এতক্ষণ মগ্ন ছিলো সে।
আজ কিছুই ভালো লাগছেনা আসমার, জান্নত আবার ডাক দিয়ে বলল,ভাবি আসেন খাবার টেবিলে আমি ভাত বেড়ে রেখেছি এসে খেয়ে নিন।আসমা এবার উঠে ওয়াশ রূমে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে সোজা খাবার টেবিলে এসে বসলো।
জান্নাত আসমাকে খাবার দিয়ে বলল,জানেন ভাবি ফিরোজ ভাই ফোন করেছিল আমাকে,ফোনে আমাকে কি বলেছেন?আসমা শুধু বলল,কি বলেছে!জান্নাত বলল,ফিরোজ ভাই আমাকে বলেছেন আপনার আদর যত্নের কোন রকম যেন ত্রুটি আমি না করি,সবসময় আপনার সাথে যেন থাকি।কথাটা শুনে আসমা হাউমাউ করে কাঁদে উঠলেনপর যখন আপন হয় তখন এমন মনে হয় আপনত্ব হৃদয় স্পর্শ করে,জান্নাত বলল,ভাবি কাঁদবেন না সব দেখবেন ঠিক হয়ে যাবে কাল সকালে ফিরোজ ভাই বাড়ি আসবে এসে আপনাকে ঢাকায় নিয়ে যাবে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করাবে ভাইয়া বলেছে আমাকে।
আসমা কোন রকম একটু খেলো তারপর হাত মুখ ধুয়ে জান্নাতকে বলল,বোন কিছু ভালো লাগছে আজ আমার,আমি একটু ঘুমাবো।জান্নাত আসমাকে বলল,ঠিক আছে ভাবি আপনি রূমে গিয়ে শুয়ে পড়ুন,আমি পড়ার রূমে গিয়ে পড়তে বসি
কালকে আমাদের পরীক্ষা।আসমা বলল,যাও বোন পড়তে বসো,জান্নাত চলে গেলো আসমা খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে সোজা রূমে চলে এলো,এসেই শুয়ে পড়লো দেওয়াল ঘড়ি দেখলো রাত আটটা বাজে।আসমার চোখে আজ আর ঘুম নেই একটা অস্থিরতা মনের ভিতর কাজ করছে, কখন রাত নির্জন হবে সেই অপেক্ষা।
এশার আযান হচ্ছে আযানের ধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ,জানান দিল রাতের শেষ নামাজ ঘনিয়ে এলো নামাজীরা মসজিদে এসো।আসমা শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছে কখন নিরব নিঝুম হবে রাত,কখন মানুষের কোলাহল কমবে ভাবতে ভাবতে কখন রাত দশটা বাজলো বুঝতে পারলো না।
ভাবছে আর একটু রাত ভারী হোক তারপর ঘর থেকে বের হবো,অপেক্ষা করছে আসমা সেই মহেন্দ্র ক্ষণের।আজ এই মুহুর্তে আসমা অস্থির হয়ে উঠলো বিতৃষ্ণা তাকে ঘিরে ধরেছে,আসমার মনে হলো সে এখনো বসে আছে কেন তাকে তো বের হতে হবে।কিন্তু এখনো যে রাত গভীর হতে বাকি সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তারপর বের হতে হবে।আসমা অপেক্ষা করছে যদিও জানে সে এ অপেক্ষা অনেক কষ্টের তবুও এ অপেক্ষা তার সময়ের।
চলবে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much