১৪ মার্চ ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৬৭



ধারাবাহিক উপন্যাস 





শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৬৭)
শামীমা আহমেদ 



শায়লাদের পুরো বাসায় এখন বেশ থমথমে একটা ভাব।সারাদিনে ভাইবোনের খুবই কম কথাবার্তা হচ্ছে। সেদিন রুহি খালার কথাগুলো পর রাহাতের মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। রাহাত ভাবছে,আসলে মুরুব্বীরা অভিজ্ঞ মানুষ। আমরা এখন যা দেখছি সেটা তারা বহু আগেই পেরিয়ে এসেছে। তাইতো সবকিছুর পরিনতি তারা আগেই বলে দিতে পারে। আর আগে থেকে এই সতর্কবার্তায় রাহাত মনে মনে  রুহিখালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
রুহি খালার প্রতিটি যুক্তি পালটা যুক্তি শায়লার ভিতরেও প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে। শায়লা খুব ভালো করেই জানে,এই সমাজে মেয়েরা অনাকাঙ্ক্ষিত হয়েই জন্মায়। তাদের জন্মটাকে কেউ আনন্দের সাথে গ্রহন করে না। তবে প্রয়োজনের সময় সেই মেয়েই নিজের সুখ বিলাসকে তুচ্ছ করে সংসারের হাল কাঁধে তুলে নিতে পারে।নিজেকে নিঃশেষ করতে পারে। তবে শায়লা কখনো সেভাবে ভাবেনি। পিতৃহারা সংসারে একটি ছেলে থাকলে যা করতো সে তাই করেছে।  বড় সন্তান হয়ে সে তার জায়গা থেকে দ্বায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছে। নিজে নিরাপদে থেকেতো  পিছিয়ে আসেনি। কিন্তু তাকে নিয়ে হিসেবের বেলায় সবাই জোড়াতালি লাগাতে চায়।
তার ঘাটতিগুলোকেই সামনে এনে বড় করে দেখা হয়। রুহিখালা আর তার স্বামী এখন তাকে নজরবন্দী করেছে।তাদের কাছে থেকে এক সময়ের আর্থিক সুবিধা নেয়া শায়লাদের পরিবারের উপর এখন অন্যায় আবদার করে চাপিয়ে দিচ্ছে।তবে তাদের এইসব আচরনে শায়লা নিজের ব্যাপারে আরো সচেতন হয়েছে, এটাই প্রাপ্তি।
এখন প্রতিরাতেই নোমান সাহেব কল দিচ্ছেন।শায়লার কি লাগবে?  কানাডা থেকে কি আনতে হবে? কানাডায় এলে,এই দেশের  কোন কোন সুন্দর জায়গা তাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। এমনি নানান কথায় শায়লাকে নিজের দিকে টানতে চাইছে।শায়লা প্রতিটি কথায় একেবারেই  নীরব থেকেছে।

শিহাব অফিসে আজকাল বেশ আনমনা হয়ে থাকছে।একটা সময় ছিল শায়লাকে সে তাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবতে বারন করা ছিল।কেমন করে কিভাবে যেন ধীরে ধীরে শায়লার প্রতি তার দূর্বলতা চলে এলো। একদিনতো সবকিছু গুছিয়ে বলে শায়লাকে ফিরিয়েও দেয়া হলো।কিন্তু শায়লার অসুস্থতায় শিহাব নিজেকে পালটে ফেললো।ভেবে নিলো,হয়তো বিধাতাই শায়লাকে পাঠিয়েছেন তার একাকী জীবনে সঙ্গী হতে।কিন্তু এখন তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,এতটা কাছেই যদি এলো তবে বিধাতার এ কোন খেলায় আবার তাদের দূরত্ব হতে চাইছে।শায়লা বিবাহিত,অন্যের স্ত্রী, শায়লা সবইতো জানিয়েছে। কিছুই গোপন করেনি। কিন্তু কেন তবে কোন গভীরের টানে সে শায়লার প্রতি এমন ভালোলাগা এলো।ছেলে আরাফের কথা ভেবে আরাফের মায়ের শূন্যতা পূরণে শায়লাকে তার খুবই আপন মনে হয়েছে আর শায়লাও আরাফকে আপন করেছে, আমাকে ভালোবেসে। নোমান সাহেব দেশে আসতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকী।এর মাঝে রাহাতও বেশ নীরব হয়ে গেছে।সেই আগের মত সহযোগিতায় থস্কছে না।গতকাল শায়লার সাথে  কথায় সেটাই বুঝলো শিহাব। 
আইনী বিষয়গুলি রাহাত দেখবে বলেছিল। কিন্তু তার কোন অগ্রগতি দেখছিন্স।তবে কি রাহাত শায়লাকে কানাডায় পাঠাতে চাচ্ছে।আর চাইবেইনা বা কেনো? বিবাহিত বোনকে তার  স্বামীর কাছে পাঠিয়ে ভাইতো তার দায় সারতেই চাইবে। শিহাব বুঝতে পারছেনা কিভাবে শায়লাকে এই শৃঙ্খল থেকে সে মুক্ত করে আনবে।শায়লাকে নিয়ে সে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। তার ঘরে শায়লার চলাচল অনুভব করেছে।কত কত রাত জেগে জেগে শায়লার সাথে কথা হয়েছে।সারাদিন সে ব্যস্ততায় নীরব থাকলে শায়লা উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছে, আমার ফিরিয়ে দেয়ার কষ্টে সে নিজের উপর
সেই আঘাত সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। শিহাব আর ভাবতে পারছে না।মনের দাবীর কাছে কি কাগজের আর আইনের বন্ধনের অধিকার বেশি হলো?
শিহাব এভাবে ভাবতে চায়নি কিন্তু শায়লার ঐ মায়াভরা মুখ তাকে এভাবেই বেঁধেছে।
তবে আজ দুদিন হলো শায়লা খুব কম কথা বলছে। তবে কি সে অন্যরকম কিছু ভাবছে? শিহাবের ঘর আজ শূন্য লাগে,কই কতদিন যাবৎইতো সে একাই ছিল,তখনতো কাউকে খুঁজেনি,আবার কোন দিন মনে কোন স্বপ্ন উঁকি দিবে তাতো সে কল্পনাও করেনি।কি করবে এখন। শায়লা যে তার জীবনে অনেকখানি যায়গা নিয়ে নিয়েছে। শিহাব আর কিছু ভাবতে পারছে না।দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম কমে গেছে।সিগারেট খাওয়া বেড়ে গেছে।নাহ, এভাবে অন্য, শায়লাকে পেতে হলে তাকে অন্যভাবে অন্যরকম কিছু ভাবতে হবে। 

রাহাতের অফিস থেকে শায়লার মোবাইলে কল এলো।  আপু,আম্মুর কিছু ওষুধ লাগবে।আমাকে কল দিয়েছিল।তুমিওতো জানোই কি কি লাগবে।তুমি একটু বের হয়ে গিয়ে কিনে রেখো।আমি অফিস থেকে বেরুতে পারছি না। ফিরতেও রাত হবে। তুমি রকটু ওষুধগুলো কিনে রেখো।আমি কাল মাকে আনতে যাবো। মা উত্তরায় চলে আসতে চাইছে।নায়লা এখন মোটামুটি ভালো আছে।
 শায়লা সবটা শুনে বললো আচ্ছা আমি বিকেলে বেরুবো।কিনে আনবো।
শায়লা সারাটাদিন একা একাই ঘরে সময় কাটায়। নায়লার বাসা থেকে মায়ের নিয়মিত ফোন আসছে।বড় জামাই কানাডা থেকে আসবে এজন্য তার অনেক চিন্তা ভাবনা। তাকে কি কি দিতে হবে কি কেমন আপ্যায়ন করা হবে।বিয়ের সময় যে কয়দিন ছিল তাতো হোটেলেই থেকেছে।এবার যেন জামাই আদর করতে পারে এ জন্য রাহাতের সাথে কথা বলা।বিদেশের জামাই যেন যত্ন আত্মি ঠিকঠাক মত হয়।মা দু'একদিনের মধ্যেই উত্তরা চলে আসবে।টেলিফোনে রুহি খালার সাথেও দফায় দফায় আয়োজন নিয়ে কথা হচ্ছে। রাহাতের শায়লাকে পাশ কাটিয়ে চলা শায়লার  মনে আঘাত দিলেও কিন্তু পরক্ষনেই  শিহাবের কথা  মনে হলেই সে আবার মনের শক্তিতে দৃঢ় হয়।
শিহাবের দেয়া ব্রেসলেটটি শায়লার প্রতিমূহুর্তের অনুসঙ্গ। ভেবে নেয় শিহাব তার সাথেই আছে।রাহাত যদিও শায়লার সাথে অচেনার মত আচরণ করছে তবে সে এটা ভালো করেই জানে শিহাবের মত একটা ছেলে তার বোনের জন্য কতটা মানানসই।
তবুও রাহাত নিজের সুন্দর আগামীর স্বপ্নে শায়লাকে নিয়ে আর দৌড়াতে আগ্রহী নয়।
  শায়লা দুপুরের খাবার শেষ করে বিছানার কাছে এলো।সকাল থেকে সাংসারিক বেশ একটা চাপ যায়।যদিও বুয়া আসে তবুও গোছগাছ করে রাহাতকে অফিসে পাঠানো 
রান্নাবান্না নিজেকেই গুছাতে হয়।আবার এইসবের জন্য কেনাকাটাও তারই করতে হয়।শায়লা জানে যদিও আজ বা বিগত দিনে তার সাহায্যে সহযোগিতা ছাড়া সংসার না চললেও দিনে দিনে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে।এরপর রাহাতের ঘরে স্ত্রী আসবে আর সে তখন সবকিছুর দায়িত্ব নিবে।মেয়েরা বাবার বাড়িতে আর কয়দিন?তারাতো বাবার বাড়িতে মেহমান হয়ে জন্মায় আর অচেনা একটা পরিবারের সাথে জীবন কাটিয়ে দেয়। তবে অচেনা হলেও শিহাবদের পরিবারের সবাইকে শায়লার খুবই ভালো লেগেছে।খুব মন চাইছে আবার একদিন যেতে। আরাফের আর বাড়ির অন্য বাবুগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে।এই বাসায় একটা ছোট্ট শিশু নেই বহুকাল।কবে যে নায়লার একটা বাবু হবে? তবে হলেই বা কি? ওর শ্বশুরবাড়ি যে ধনী মানুষ  তারা কি আর খুব একটা আসতে দিবে?এই নায়লা ছোট্ট বোনটা ছিল।ফ্রক পরিয়ে চুল বেঁধে দিতো স্কুলে যাওয়ার আগে।ছুটির দিনে আপুর হাতে ভাত খাওয়ার বায়না ছিল।দিন শেষে আপুর গলা জড়িয়ে ঘুমানো।আজ কোথায় গেল সেইসব দিন।আজ সে ধনীর ঘরের স্ত্রী।এই বোনের কথা আর খুব একটা মনে পড়ে না।শায়লার চোখটা ভিজে উঠলো!  পরক্ষনেই ভাবলো ছিঃএসব কি ভাবছি?নায়লা ভালো আছে  বড় বোন হিসেবে এটাই তার চাওয়া।
নানান ভাবনায় ডুবে শায়লা একেবারে চুপটি করে দুপুরের ভাত ঘুমে ঢলে পড়লো।
শিহাবের কলে ঘুম ভাঙল।শায়লা কি করছো? 
এইতো একটু ঘুমিয়েছিলাম।
তুমি ঘুমাতে পারছো? আমার যে ক'রাত যাবৎ একেবারেই ঘুম নেই।শায়লা স্মাকে ভুলে তুমি কিভাবে ঘুমাও? 
তোমাকে ভুলে ঘুমিয়েছি কে বললো?এই যে তোমার দেয়া ব্রেসলেটটি আমার হাতে সর্বক্ষন।
আহ! শায়লা তোমার কাছে আমি বারবার হেরে যাই।তবে এই হেরে যাওয়ায়ও আমি তৃপ্ত।তোমার কাছেই তো হেরে যাওয়া!
শিহাব,একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
হু,
তুমি কি সত্যই আমাকে তোমার কাছে নিতে চাইছো?
কোন সন্দেহ,,?
না, সেটা নয়, আমাকে আপন করতে হলে রিশতিনার মত আবার সেই নানান আইনী জটিলতায় যেতে হবে।
হউক তা, কষ্ট করে  পাওয়ায় আনন্দ আছে আর রিশতিনাকে পেতে কোন আইনী জটিলতা ছিল না বরং ওরা রিশতিনা ছাড়িয়ে নিতে আইনের প্রভাব খাটিয়েছে, থ্রেট দিয়েছে। শুধু আমার সেই দুধের শিশুটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব হজম করেছি।তবে আবার আজ,আরাফের জন্য মা এনে দিতে যদি আইনের কাছে যেতে হয় তো যাবো।তোমার মাঝে আমি আমার জন্য যেমন গভীর ভালোবাসা দেখেছি আরাফের জন্য তেমনি মায়া দেখেছি।
শিহাব,তোমার সাথে পরিচয়টা আরো আগে হওয়া উচিত ছিল।
হু,ঠিক বলেছো।
শিহাব প্রসঙ্গ পালটে বললো,শায়লা এসো বিকেলে একসাথে চা খাই। 
হু হতে পারে, আমার কিছু কেনাকাটা আছে বেরুবো।
তবে শায়লা আজ আমি নিজে হাতে চা বানিয়ে খাওয়াবো। 
কিভাবে? 
আজ তুমি আমার বাসার অতিথি।
তোমার বাসায়?
হ্যাঁ, আজ আর বাইরে না।আমার বাসার বারান্দায় বসে দুজনে চা খাবো।
শায়লা চিন্তিত হলেও, মনকে সামাল দিতে না পেরে বলে ফেললো,  আচ্ছা আমি আসবো।
কখন বেরুবে? আমাকে বেরোনর আগে কল দিও।
আচ্ছা,জানাবো।ভালো থেকো।
তুমিও,দেখা হচ্ছে,,
শায়লা ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে তিনটা বাজছে। সাড়ে চারটার দিকে সে বেরুবে মনে মনে ঠিক করে নিলো।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much