উপন্যাস
টানাপোড়েন১১৭
ভালো থেকো
মমতা রায়চৌধুরী
সবদিক থেকে একটা কালশিটে পড়া চাপা কষ্ট যেন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ছিল ।যেমন করে বেগুন পোড়ালে উপরটা কালশিটে পড়ে যায় আর ভেতরটা নরম।
মনোজের ঘরে সকালবেলা উঁকি দিয়ে ফোনের কথাবার্তাগুলো ভাসা-ভাসা রেখার কানে এসেছিল। স্কুলে গিয়ে সারাদিন সেই কথাগুলো তার মনের আকাশে উঁকি দিয়ে গেছে ।একটা অদম্য কৌতুহল যেনো কাজ করেছে ,ঠিক যেমন করে সামুক যখন ঢাকা খোল থেকে বেরোয় ঠিক তেমন। স্কুলে কাজ করেছে ঠিকই মন বসাতে পারেনি। বারবার শুধু মনে হয়েছে দাম্পত্য জীবনের রসদগুলো কি এভাবেই ফুরিয়ে যায়?
টেবিলে গাদাগুচ্ছ প্রোজেক্টের খাতা জমেছে।
বেশ কয়েকটা খাতা দেখার পর আর মনেই হচ্ছে না খাতাগুলো দেখে। বারবার মনের ভেলায় পাড়ি দিচ্ছে বেখেয়ালি মন।কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষিকা হিসেবে সুনাম আছে তার স্কুলে। সারাদিন হয় বই, না হয় ক্লাস, কিছু-না-কিছু বিদ্যালয় সংক্রান্ত কাজ রেখা করতেই থাকে। এজন্য সারাদিন কাজের শেষে বাড়িতে ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে ফেরে। ফিরে কিন্তু সে ঘাড়ের ব্যথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। বাড়িতে এসে তার কর্তব্যের কোন অবহেলা হয়না ।রেস্ট বাদ দিয়ে সাংসারিক কাজকর্ম করে যায় নিপুণভাবে ।শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যেমন সাংসারিক জীবনে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি ,তেমনি করে স্কুলের ক্ষেত্রেও সূর্য ওঠার মতো দৈনিক চিত্র লক্ষ্য করা যায়। শুধুমাত্র নজরের বৃত্ত থেকে সরে যায় তার শরীরের ক্ষেত্র।
শরীরটা যেন তাকে সাথ দিচ্ছে না কিন্তু মনের জোরটা তার এতটাই যে সেগুলোকে উপেক্ষা ক'রে চলে। ট্রেনে উঠে শরীরটাকে এলিয়ে দেয় সিটের সঙ্গে। আজ যদি রিম্পাদি থাকতো তাহলে অন্তত তার সহমর্মিতার ছোঁয়াটুকু পেতো।হাতটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেখার পিঠে এসে রাখত। বসে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ।আজ কোথায় রিম্পা দি, কোথায় রেখা। আজও চলছে খাওয়া ,চলছে সবার সঙ্গে হাই-হ্যালো, শুধু পাচ্ছে না মনের খোরাক। তার মাঝেও তৃষ্ণার্ত চাতকের কাছে যেমন এক ফোঁটা বৃষ্টি অত্যন্ত মহার্ঘ্য, ঠিক তেমনি তার তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে তার নেশা লেখা ,লেখনি শক্তি। লেখার মধ্যে দিয়েই ফুটিয়ে তোলে দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া পাওয়া দুঃখ কষ্ট ছোট ছোট সুখানুভূতি ,খুনসুটি ।এ সমস্তই তর মনে এসে সঞ্চিত হয়। ট্রেনে আস্তে আস্তে এসবই ভাবছিল রেখা ।
হঠাৎই ফোনের আর্তনাদ শোনা যায়। প্রথমে রেখা ফোনটা রিসিভ করেনি কিন্তু ফোনের আর্তনাদে এবার তাকে ফোনটা ধরতেই হল।
বলল 'হ্যালো'
ম্যাডাম কালকের পর্ব টা পাঠান নি ।
একটু অবাক হয়ে রেখা বলে' হ্যাঁ পাঠিয়েছি তো'।
হ্যাঁ ,পাঠিয়েছেন। কিন্তু আপনি বলেছিলেন যে দু একটা জায়গায় ভুল আছেএকবার ফ্রেশ করে পাঠাবে ন?'
জিভ কেটে' ও হ্যাঁ ভুলে গেছি ।সত্যি ভীষণ ভাবে দুঃখিত।'
গাব ফল খেতে গিয়ে কাকের গলার ভেতরে যখন আঁটি ঢুকে যায় তখন সে ভাবে, সে খুব ভুল
করেছে l রেখার ও ঠিক তেমনি অবস্থা হয়েছিল।
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ভদ্রলোক বললেন' না ঠিক আছে ।আজকে আপনি তাহলে দুটো পাঠিয়ে দিন।'
'ঠিক আছে। তাই হবে।'
ফোনটা কেটে মনে মনে ভাবছে' বললাম তো পাঠিয়ে দেব কিন্তু খুব চাপ আছে।
শরীরটা তো সাথ দিচ্ছে না। কিন্তু মনের জোর হারালে তো হবে না এই লেখাযই তাকে প্রাণশক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে । কাছেই লেখা কমপ্লিট করতেই হবে।'
এসব ভাবতে ভাবতেই তার ভাবনা উড়াল থামিয়ে দেয় ফোনের আর্তনাদ।
একে তো ট্রেনেতে ভিড় ।তাও রক্ষে যে জায়গাটা পাওয়া গেছে । ব্যাগ হাতরে হাতরে আবার ফোনটা বের করল। বের করতে করতেই গেলো ফোনটা কেটে ।
ফোনটা বের করে নম্বরটা চেক করতে দেখতে যাচ্ছে কে ফোনটা করেছে ?এমন সময় আবার ফোন বেজে উঠল ।
'ও বাবা, এত রিম্পাদির ফোন।'
"হ্যালো'
"কি ব্যাপার রে ।কোথায় আছিস?'
এখান থেকে চলে যাবার পর তুমি যেন সব ভুলে গেছ। এ সময় কোথায় থাকতে পারি বলো?'
রিম্পা দি তো হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে' হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস ।আমি তো বাড়িতে ।তাই আমি ভাবলাম তুই ও বাড়িতে।'
' তুমি এ সবই ভাবতে থাকো ।কাছে পিঠে চলে গেছ তো ,ওই জন্য বলো ?'
'হ্যাঁ ,এবার তুই ট্রেনে। বুঝতেই পারছি ট্রেনের আওয়াজ, ভিড় ।তারমানে স্কুলে গেছিস ।একদম ঠিক ।
আচ্ছা পিকনিকে যাবি তো ?যেতে কিন্তু হবে ।না করতে পারবি না, আর মনোজকে বলেছিলি?'
' ওর কথা ছাড়ো তো যেতে হলে আমি যাব কিন্তু আমার শরীরটা জানো তো কিছুদিন ধরে সাথ দিচ্ছে না।
" আরে ছাড় না মনটাকে ঠিক রাখ , শরীর ঠিক হয়ে যাবে। বলেই হো হো হো করে হাসতে লাগলো।
তারপর বলল' তোর সঙ্গে যতই হাসি-ঠাট্টা করি না কেন ।তবে একবার তোর ডাক্তার দেখিয়ে নেয়া উচিত। মনোজকে বল। আমি কি তোকে নিয়ে যাব?'
রেখা বলল 'সে দেখা যাবে ।
দেখি তোর দেখা যাক সেটা কবে হয় আবার এক যুগ পার করে দিস না যেন। আচ্ছা শোন
'তোদের মিড ডে মিল কবে থেকে ?'
ভালোকথা মনে করেছো এই মিড-ডে-মিল নিয়েএকটা না যা কান্ড হয়েছে না, তোমাকে না বললে আমার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না ।যদিও এখন পেটে ভাত নেই । ছুঁচোতে পেটে ডন
মারছে। বাড়িতে গিয়ে খাবার খেতে হবে।।
তবুও বলছি অনুরাধা দি নাকি অসুস্থ । কাল যখন বেরোচ্ছি ট্রেন ধরবো বলে তখন বড়দি পঞ্চমীর হাত দিয়ে একটা কপি পাঠিয়ে
দিলেন ।
আমি বললাম কি এটা?
ও বলল 'আমি কি দেখেছি নাকি? বড়দি দিতে বললেন তাই আমি ছুটে এসে দিচ্ছি
আপনাকে ।"
'ওদিকে বড়দি শুনতে পেয়ে জানলা দিয়ে বলছেন এই লেখাটা পঞ্চম শ্রেণীর পোটাল থেকে একটা মেয়েদের লিস্ট বার করে আর ফোন নম্বর বার করে তোমাকে দেয়া হয়েছে। অনুরাধা দি তো অসুস্থ ।মিড-ডে-মিল সংক্রান্ত মেসেজ পাঠাতে হবে ,সঙ্গে ওদের ফোন করে দিতে হবে একটু একটু করে দিও ।'
'কি বলি বলো তো ? না করতে পারি না ।আমার হয়েছে যত জ্বালা।'
' সে তো বুঝলাম ।ব্যাপারটা কি হয়েছে
বাবা বল না আমার জানতে ইচ্ছে করছে। আমার আর তর সইছে না। উগলে দে তাড়াতাড়ি।'
কোন মা কুকুর তার সন্তানের জন্য খাবার সঞ্চয় করে এনে যেমন উগলে দেয়, উদগ্রীব হয়ে থাকে তাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য। ঠিক সে রকম।
রিম্পা দি এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন মনে হচ্ছে মনের ভেতরে একটা আকুলি-বিকুলি চলছে কি মজার কান্ড হয়েছে ,সেটা শোনার জন্য। একজন গার্জেনকে যখন ফোন করা হলো। ফোন ধরে কি বলল ' জানো?'
রিম্পা দিয়ে একদম যেন জাঁকিয়ে বসেছে শোনার জন্য কোন দিকে ধ্যান নেই ।তপস্বী যেমন তপস্যা করতে বসলে তার অন্য কোন দিকে ধ্যান থাকে না ।ঠিক সে রকম।'
আরে জানবো কি করে ?কখন থেকে শুধু জানো জানো বলছিস ।বলে ফেল না।'
যেই ফোনটা ধরল ধরে বললো
"হ্যালো"।
জান রিম্পা দি যখন আমি বললাম ভুবন মোহিনী গার্লস হাই স্কুল থেকে বলছি।
তখন ঐ গার্জেন কি বলল 'জানো ?
বললো 'কেন ফোন করেছেন বটেক?'
যখন আমি বললাম' আপনার মেয়ের নাম লক্ষী মুর্মু।'
গার্জেন বলল ' ত আছে বটে।'
আমি বললাম' সামনের মাসে 3 তারিখে মিড ডে মিল দেওয়া হবে।'
গার্জেন একটু অবাক হয়ে বলল''কি আছে বটে?'
আমি যতদূর বুঝলাম এ গার্জেন এর ছেলেমেয়েদের পড়া এবং স্কুল সংক্রান্ত কোন বিষয়ে যোগাযোগ নেই ।
আমি বললাম চাল আরো আনুষাঙ্গিক বিষয় গুলো দেয়া হবে।'
সবথেকে অবাক লাগল কি 'জানো ?'
রিম্পা দি বললো ' কি?'
গার্জেন আমাকে বলছে' তু লিয়ে লে বটেক।,'
আমি তখন বললাম' কি বলছেন আপনি ?নিয়ে নেব মানে?'
তখন বললো 'আমাকে জ্বালাস নি তো বটে।'
আমি বুঝলাম যে আমার কথা বলাটাই বৃথা।
' সে তো রীতিমতো নেশায় বুঁদ হয়ে আছে।'
এমন সময় ফোনে আওয়াজ পেলাম ওর বউ এসে বলছে' তু কার সঙ্গে কথাটো বুলছিস?
দেখি বলছে 'তু কথাটা ক্যানন বুল না'।
তখন সেই মহিলা ফোনটা নিয়ে বলছে 'কে বুলছিস?'
তখন আমি আবার বললাম' আমি স্কুল থেকে বলছি।
তখন দেখলাম একটু সপ্রতিভভাবে বলল 'ম্যাডাম আছিস কেনে?'
আমি বললাম, ' হ্যাঁ, মিড ডে মিল এর জন্য বলছিলাম।'
'কোন দিন টা তো যেতে হবেক দিদিমুনি'
"সামনের মাসের 3 তারিখে।'
"উর কথাটো তো কিছু মুনে করিস নি।
ও তো লেশা ভান করে আছে লা?
আমি ঠিক পৌঁছেটো যাবক।'
' ঠিক আছে।'
ফোনটা নামিয়ে না আমি কি করব হাসবো
না , না কাঁদবো ,কি করবো? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না ।'
ওই লোক যখন বলল যে তুই লেলে বটেক।
আমি ভাবছিলাম যে বড়দি কি দায়িত্ব
দিলেন ।আজকাল কিনা করতে হচ্ছে আমাদেরকে। '
বললাম বড়দিকেও ।
বড়দি বললেন 'তাহলেই ভাবো। তবে কিছু ভেবো না রেখা ।মানুষের সঙ্গে জনসংযোগটাতো
হচ্ছে বল। কত ধরনের বিচিত্র মানুষ ,তাদের জীবনযাপন ,তাদের কথা বলার ভঙ্গি স,বকিছুই আমরা জানতে পারছি এটাও দরকার আছে।
সম্পর্কে আরও সমৃদ্ধ হতে পারছি আমরা।'বড়দি আমার চোখ মুখের অবস্থা দেখে নিজেও হাসতে শুরু করলেন আর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন' এগিয়ে চলো ,এগিয়ে চলো।'
রিম্পা দিয়ে বলল' কি কান্ড রে।'
তবে একটা কথা বলি তোর কিন্তু উপন্যাসের চরিত্রগুলো তোর চোখের সামনে ভিড় করছে এবং তাদের ডায়লগগুলো এটাই কাজে লাগিয়ে দে।
ইতিমধ্যেই ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল মদনপুর স্টেশন ছাড়লো কল্যাণী স্টেশন এর দিকে এগোতে শুরু করলো বললো শোন রাখছি তাহলে পিকনিকে আসছিস কনফার্ম মনে থাকে যেন কোন অজুহাত শুনবো না ভালো থাকিস।
রেখা মনে ভাবল 'ভালো থাকিস, ভালো
থেকো ,এই ভাবনাগুলো যতক্ষণ মনের মধ্যে রাখবো ।ততক্ষনে ভালো থাকবো। ভালো থাকাটা তো এভাবেই ।এজন্যই মনের ভেতরে বেশিক্ষণ কষ্ট চেপে রাখতে চাইছি না ।দুদিনের এই পৃথিবীতে এসেছি ।যত কষ্ট চেপে রাখবো ,ততই কষ্ট পাবো.। গানের একটা লাইন মনে পড়ে গেল 'পারবো না ছুঁতে শুধু ,স্বপ্নে এসেই বলব তুমি ভালো থেকো।'টানাপোড়েনের এই জীবনে শুধু এটাই বলব ভালো থাকার মানুষগুলো সবাই ভালো থাকুক। ডানায় ডানায় ভর করে, উড়াল দিয়ে চলুক ভালো থাকার বার্তা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much