০১ মার্চ ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১১৬




উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১১৬
মনের হদিস কে বা জানে?
মমতা রায় চৌধুরী

ভোরের দিকে সবেমাত্র চোখটা লেগেছে অমনি ফোন বেজে উঠলো।ফোনের আওয়াজে রেখার বুক ধড়ফড়ানি শুরু হল। আশ্চর্য হয়ে ভাবলোএত সকালে কে করবে? আর কি কারণেই বা প্রথমেই যতসব অশুভ কথাগুলোই মনে আসতে থাকে। তবুও ভয়ে ভয়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। ভাল খারাপ যাই হোক । তার তো সামনাসামনি দাঁড়াতেই হবে । কাজেই বিলম্ব না কোরে ফোনটা তুলে বলে ''হ্যালো'। 
প্রথম দিকটা একটু চুপ থাকে তারপর যখন আবার বলে 'হ্যালো '।
তখন অন্য পক্ষ উত্তর দেয়' দিদি আমি' সমু' বলছি।'
হঠাৎই সোমদত্তার ফোন আসে রেখার কাছে।
একটু অবাক হয়ে যায়। এতদিন পর
ফোন  করেছে, কি ব্যাপার? ভেতরে একটা কৌতুহল থেকেই যায়। একেবারে বিছানায় উঠে বসে রেখা। ঠিক শুনলো তো গলাটা।
সব ভাবনার অবসান ঘটিয়ে বলল কে সমু?
একটু নীরব থেকে উত্তর দেয় ', হ্যাঁ, দিদি।'
'এত সকাল বেলায় ফোন করছিস? সব ঠিক আছে তো? কি হয়েছে? কাকু ,কাকিমা ঠিক আছে?'
 যদিও কালকে কাকু কাকিমার সঙ্গে কথা হলো রাত্রের মধ্যে আবার কি হলো মনে মনে ভাবল।
' হ্যাঁ ,সবাই ঠিক আছে।
 'তাহলে হঠাৎ ফোন করলি?'
একটু চুপ করে থেকে বলে' আজ পার্থর বিয়ে?'
'কার বিয়ে?'
'দিদি, পার্থর বিয়ে।'
'ও পার্থর বিয়ে। তা ভালো কথা তো?'
তুইতো সংসারটা করলি না ।এবার তোর জন্য আর কত দিন ওয়েট করবে বল পুরুষ মানুষ তো।'
'হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। যেন যখন আমি ছিলাম ওর সঙ্গে ও যেন কোন মেয়ের দিকে তাকাতো না সবার কাছে তো তার নিজের চরিত্রটা উদার মহৎ নির্ভেজাল একটা ভালো মানুষ হিসেবে   বাজিয়ে গেছে ।যত দোষ সব আমার ছিল।'
হঠাৎ আজ এসব কথা কেন বলছিস? তোকে তো কত দিন বলেছিলাম, কোন সমস্যা থাকলে আমাদের বল ।তখন তো কোন কথাই বলিস নি।'
'হ্যাঁ ,বলি নি এ কারণে ।সবাই আমাকে দোষারোপ করুক ।ভালো থাকুক ও।কিন্তু আমি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম দিদি ।এবার ওর মুখোশটা তোমাদের কাছে খুলবো।'
'তাতে কি লাভ হবে বল বিয়েটা তো আর আটকানো যাবেনা।'
"আমি বিয়ে আটকানোর কথা বলছি না। তাছাড়া আমি ওর সাথে সংসার ও করতাম না।'
'তাহলে?'
'কার সাথে বিয়ে করছে জানো ?আমি যাকে নিয়ে সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাকে ই।'
'কাকে?'
'ওর অফিসের কলিগ মোনালিসা।'
'মানে?'
'মোনালিসা ও ডিভোর্সি। ওর দুটো বেবি আছে।
জানো ইদানিং কি শুরু করেছিল প্রায় দিনই ড্রাংক হয়ে বাড়ি ফিরত। পাবলো তো এখন বুঝতে শিখেছে ওর বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে ভয় পেত। ওকে কোনরকম সামলে নিয়ে বেহুশ অবস্থায় যখন অফিস থেকে গাড়ি করে ওকে দিয়ে যেত তখন ওকে আলাদা ঘরে শুয়ে দিতাম আর জানো আমাদের সঙ্গে যখন শারীরিক মিলন হতো তখন কাকে নাম ধরে ডাকতো মোনালিসা, মোনালিসা , দিদিভাই মোনালিসা। বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকে। '
'তুমি ভাবো আমি যখন প্রথম কাউকে ভালোবেসেছিলাম। তাকে তো আমার বাড়ি থেকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। আমাকে বিয়ে দেয়া হলো পার্থর সঙ্গে ।আমি তো মেনে নিয়েছিলাম। ওকেই আমি খুশি রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তুমি ভাবো যখন দুজন মিলিত হতাম মানে শারীরিকভাবে তখন আমার স্বামী আমার জায়গায় অন্য মহিলাকে এক্সপেক্ট করছে ।ভাবতে পারো শুধুমাত্র যেন একটা যৌন ঋণ কাজ 
করত আমাদের ভেতরে। কেন যৌন ঋণ বলতো শব্দটা ব্যবহার করলাম। মনে হতো ওকে না পেয়ে চোখ বুঝে আমার জায়গায় মোনালিসাকে ভেবে তার শরীরে একটা বিদ্যুত খেলে যাচ্ছে।  মনে হত যেন সেই ঋণ শোধ দিচ্ছে।'
"এসব কি বলছিস সমু?'
'আমি ঠিক বলছি দিদি।'
'স্বামী-স্ত্রীর ভেতরে যে সম্পর্ক ।সে সম্পর্ক থাকতে হবে বিশ্বাসের দিদিভাই, থাকতে হবে 
ভালোবাসার ।বিশ্বাস যেখানে ভেঙ্গে যায়, সেখানে ভালোবাসা কি করে থাকে দিদিভাই?'
রেখা সমুর কষ্ট গুলো বুঝতে পারে।'
' সত্যিই তো ত বিশ্বাস ,ভালোবাসা এসব না থাকলে বন্ধন কিভাবে অটুট থাকবে?'
সমু তখনও বকে যাচ্ছে । আসলে এতদিনের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস টা যেন উপচে পড়ছে। শিব ভেঙেচুরে সব শেষ করে দিতে চাইছে।
'বলছে মনোজদার মতো তো সবাই নয় দিদিভাই।'
রেখাও চুপ করে থাকে।
আর ভাবে' সবাই মনোজকে কত ভালো মানুষ ভাবে। তাই রেখা বললেও রেখার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?'
আজ পর্যন্ত সমুকে যেভাবে দোষারোপ 
করেছে  ।পার্থকে সেখানে বড় করে দেখানো হয়েছে কিন্তু সমুর ভেতরে জমানো কষ্ট, যন্ত্রণা 
বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা আছে সেটা কখনো উপলব্ধি করতে পারে নি।'
'তুই এখন কি করবি ভাবছিস?তুই তো  ওই ছেলেটার সঙ্গে সংসার করবি নাকি?'
"তুমি খেপেছে দিদিভাই ।আমি জানি ও বিবাহিত ওর সংসার আছে। আমি জেনে বুঝে ওর সংসারটাকে নষ্ট করব?'ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।'
রেখা সত্যিই অবাক হয় ।সে কিরে, তাহলে এতদিন যে তুই ওর সঙ্গে ….।'
সমুএকটু ম্লান হেসে বলে
'ভালোবাসার অভিনয়গুলো করেছি। কেমন সুন্দর অভিনয় করলাম বলো? পারফেক্ট না দিদিভাই?
ওটা না করলে যে আমি ডিভোর্স পেতাম না দিদিভাই।'
সত্যিই রেখা আশ্চর্য হয়ে যায় যে সমু ম্যাচিওর হয়ে গেছে ।ওর ভেতরে যে একটা মিথ্যা মিথ্যা খেলা গেছে চলে ,সেটা কেউ ধরতেই পারলাম না।
"এবার তুই কি করবি তাহলে?'
"না ভালোবাসার অভিনয় করলেও, ও কিন্তু আমাকে একটা কাজ দেখে দিয়েছে
 দিদিভাই ।সেজন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ।
তবে হ্যাঁ, ও আমাকে ভালোবাসে দিদিভাই ।কিন্তু আমি সেই ডাকে সাড়া দিতে পারব না। ফাইতফুল গু ধারার মতো আমার ভেতরে বয়ে যাবে কিন্তু প্রকাশটা থাকবে না।আমি বলেছি যদি ভালোবাসো তাহলে আমাকে একটা কাজ দাও যাতে আমি আমার সন্তানকে যথাযোগ্য মানুষ করতে পারি।'
"তা তোর কথা রেখেছে?'
"হ্যাঁ দিদিভাই।'
'যাক যেভাবে ভালো থাকিস ,সেভাবেই থাকার চেষ্টা কর ।না বুঝেই তোকে অনেক কথা বলেছি বোন ।কিছু মনে করিস না।
তবে পার্থর মুখোশ খুলে দিয়ে ভালোই করেছিস। কাকিমা কাকু কে জানাব ব্যাপারটা।'
সমু একটু চুপ থাকে, তারপর বলে "তোমরা কেমন আছ দিদিভাই?'
'এইতো চলছে রে বোন।'
"তুই তাহলে এখন কোথায় থাকবি।'
'আমাকে তো একটা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে তবে আমি বলেছি আমি অফিস থেকে যে স্যালারি টা পাবো তার থেকে আস্তে আস্তে টাকাটা শোধ করে দেব।'
"বাহ, কোথায় নিয়েছিস?'
"ও ই  তো গড়িয়ার কাছে।
একদিন এসো দিদিভাই অনেক কথা হবে।'
"হ্যাঁ ,নিশ্চয়ই যাবো রে ।তুই ভালো 
থাকিস ।পাবলোর খেয়াল রাখিস।"
'হ্যাঁ দিদিভাই ,রাখি তাহলে।'
বাপরে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে বিছানার উপর রেখা ।মানুষের মনের খবর কে রাখতে পারে ? এত কিছু ঘটে গেছে অথচ উপর থেকে ওকে দেখে কিছু বোঝা যেত না ।ওর ডেসপারেটলি এসব কান্ড কারখানা দেখে কত দোষারোপ করা হয়েছে। ঈশ্বর ওকে একটু মনে শান্তি দিন, আনন্দ দিন এই প্রার্থনাই করি।'
রেখা মনে মনে ভাবতে থাকে 'রেখার  ভেতরের যন্ত্রণার কথা  কাকে বলবে?'
বিষন্ন মন নিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড মাঠখানাকে দেখতে থাকে। মনে হচ্ছে এই  মাঠ পেরোতে পারলে সব বাধা-বিপত্তি উধাও হয়ে যাবে ।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ মাঠ পেরোনোর আগেই ছন্দপতন। কলিং বেল বেজে গেল' জয় গনেশ ,জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা।'
রেখা ভাবলো নির্ঘাত মাসি এসেছে।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে দরজাটা খুলল।
' বৌমা"আজকে না কাজ করব না।
রেখা বলল 'কেন মাসি?'
আর ব'লো না আমার নাতিটার রাত থেকে পাতলা পায়খানা হচ্ছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি তাই তোমাকে যাবার পথে একটু বলে গেলাম চিন্তায় থাকবে তো?'
'তা বেশ করেছ মাসি। না ,না তোমাকে কাজ করতে হবে না। তুমি নাতিটা টিটমেন্ট করাও গিয়ে।'
কিছুক্ষণ চুপ করে মাসি দাঁড়িয়ে থাকে 
"কি মাসি, কিছু টাকা পয়সা লাগবে?'
মাসি তখনও চুপ করে তারপর বলে' আসলে কখনো তো এভাবে চাইনি।'
"না ,না ছি :ছি :ছি: এভাবে বলছ কেন ?তুমি একটু ওয়েট করো।' বলেই রেখা ঘরে গিয়ে হাজার টাকা এনে মাসির হাতে গুঁজে দেয়।' 
" যাও নাতিকে  ডাক্তারের কাছে  নিয়ে যাও।'
মাসি দুই হাত জোড় করে বললো' তুমি যে কি উপকার করলে বৌমা'।
"না ,না ,এভাবে কেন বলছো মাসি? ঠিক আছে তুমি এস । রেখা খেয়াল করল মাসির দুচোখে চিকচিক করছে জল।
"যদি নাতি ঠিক থাকে। তাহলে বিকেলে আসবো।'
'না, তোমাকে আর বিকেলে আসতে হবে না কাজে।'
"মাসি একটু হেসে চলে গেল।"
'রেখা দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে 
আসলো ।তাড়াতাড়ি করে কাজে হাত লাগাল কারণ আজকে তো স্কুলে যেতে হবে। সকালবেলায় প্রাতঃক্রিয়া না সারলে আবার হয় না ।বাথরুমে ছুটল গিজার টা চালিয়ে জলটা গরম করতে বসালো ।তারপর প্রাতঃক্রিয়া সেরে ফ্রেশ হয়ে  রাধা গোবিন্দের ভোগ চাপিয়ে রান্না ঘরে ছোটে।  রান্নাঘরে গিয়ে একদিকে বাচ্চাদের জন্য দুধ গরম করতে বসিয়ে দিল ।আজকে ওরা দুধ বিস্কিট খাবে ।রুটি করার সময় থাকবে
 না ।রাত্রে যে বাসন গুলো ছিল সেগুলো কে বেসিনে সাবান দিয়ে ভালো করে বাসনগুলো ধুয়ে নিল। তারপর ভেবে নিল ঘর মোছার মত আজকে পরিস্থিতি নেই। যা হবে হবে ।এবার আস্তে আস্তে এক এক  করে খাবার  বানাতে শুরু। আগের দিন রাত্রে যে সবজি গুলো কেটে রেখেছে , টোটাল তরকারি সে করতে পারবে না । সময় থাকবে না তাই সে ব্রকলি আর আলু ভাজা , রুটির তরকারি করে নিল অন্যদিকে একটু ডাল ,বেগুন ভাজা আর মাছের ঝাল।'আর বাচ্চাগুলোর মেটের তরকারি।
এতক্ষণ পর ফ্লাক্স থেকে চা টা ঢেলে কাপে নিয়ে বসল খেতে। অন্য আর এক কাপে চা ঢেলে মনোজকে দিতে গেল। গিয়ে দেখছে মনোজ কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে ।ও দরজায় নক করে চায়ের কাপটা সামনে টি টেবিলে রেখে দিয়ে চলে আসল।
রেখা মনে মনে ভাবছে 'কার সাথে এত হেসে হেসে কথা বলছিল ?শুধু রেখার সঙ্গে কথা বলতে 
কষ্ট ।  রেখার সাত সকালে একটা গান ভীষণভাবে মনকে নাড়া দিল' 'মনের হদিস কে বা জানে, সে হদিস কে বা জানে,, কি যে থাকে মনের 
ঘরে। কেউ জানে না ,কেউ জানে না.. যে ধারণ করে।'
তাই রেখা মনে মনে ভাবল' যা হচ্ছে হোক, অত গুরুত্ব দিতে চায় না ।বেশি ভাবলেই বেশি
 কষ্ট । হাতের কাজগুলো দ্রুত সেরে নিয়ে স্কুলে বেরোতে হবে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও  সমু আর পার্থর দাম্পত্য জীবনের দৃশ্য টা যেন মনের পর্দায় হাওয়ায়  উড়ছে। কখনো মনে হয়নি তাদের নীলাভ আলোয়অন্ধকার আছে। মনের হদিশ পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much