২৩ মার্চ ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৪০




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১৪০
এক নারীর পত্র
মমতা রায় চৌধুরী



১১,৩.২২ রাত্রি ২২.৩৮
রেখার জীবনটা তিতিবিরক্ত হয়ে গেল। ক'দিন ধরে রেখা লিখে উঠতে পারছে না ,বাড়িতে এত চাপ। স্কুলের চাপ তো রয়েছেই। কিন্তু তার মধ্যেও লেখা থেমে থাকে নি । এখন এ কি অবস্থা হল বাড়িতে যদি সব সময় একটা খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে , সব সময় মনের ভেতরে টানাপোড়েন নিয়ে কি করে পেরে উঠবে? এবার মনে হচ্ছে কয়েক দিনের জন্য ওকে নিজের দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। এ কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই একটা ফোন আসে।রিং হতে থাকে। ফোনের আর্তনাদে তড়িঘড়ি এসে ফোনটা রিসিভ করে বলল"হ্যালো'।
"কি ম্যাডাম লেখা কতদূর?"
"ও আপনি?'
কেন ভূত দেখার মত দেখলেন?
না ,তা ঠিক নয়।
আর হ্যাঁ 
"বেশ কয়েকদিন আমরা লেখা পাচ্ছিনা?"
রেখা একটু চুপ করে থাকে।
আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?
রেখা মনে মনে ভাবে নিজের সমস্যা নিজের কাছে রাখাই ভালো ।চার দেয়ালের বাইরে গেলে সেটা সমস্যা থাকে কোথায়? তাছাড়া তার সমস্যার সমাধান নিজেকেই করতে হবে।
অন্যের কাছ থেকে হয়তো কোনো সমালোচিত হতে হবে, নয়তো সহানুভূতি দৃষ্টিতে দেখবে।
"ম্যাডাম?"
"না ,না ,না কোন সমস্যা নেই।'
Ok
সামনে নারী দিবস ।বিশ্ব নারী দিবসে কিন্তু লেখা দিতেই হবে।কবিতা হোক, গল্প হোক, যাইহোক ওটা কিন্তু আলাদাই পাঠাতে হবে আর এটা যেমন লিখছেন ধারাবাহিক লিখতে থাকুন।
Ok
"ভালো থাকবেন।'
"আপনিও ভালো থাকবেন।'
ফোনটা রাখার পর ভাবতে লাগলো।
নারী দিবস, বিশ্ব নারী দিবস। যেখানে প্রতিনিয়ত ক্ষুন্ন হয় নারীর মর্যাদা। প্রতিনিয়ত বেআব্রু হয়, নারী ।যেখানে প্রতিনিয়ত পণ্যে পরিণত হয়
 নারী । যেখানে পবিত্র শিশু পর্যন্ত ধর্ষিত হয়,যেখানে বঞ্চিত, নিপীড়িত শোষিত, পদদলিত  নারী ।সেখানে বিশ্ব নারী দিবস হাস্যকর মনে হয়। শুধু কি তাই নারীকে বঞ্চিত হতে হয় এখনো শিক্ষা-দীক্ষা থেকে। যেখানে নারী তার আপন সগৌরব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়? যে নারী গৃহের সৌন্দর্য ও শান্তির চির উৎস কেন সেই নারীর জীবনে নেমে আসে অকালমৃত্যুর অভিশাপ! কেন নারী পরিণত হয় বিকিকিনির সহজ পণ্যে? কেন নির্মম, নিষ্ঠুর কোন সামাজিক প্রথা যুগে যুগে নারী জীবনকেই অশ্রুময়ী করে? কেন নিরুপমা দের আজও চিতা জ্বলছে?নারী যে তিমিরে সেই তিমিরেই।
তাই '"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী ,অর্ধেক তার নর।" তবে কেন নারীর এরূপ দশা?
'নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার' এই বার্তা কবে সত্য হবে?
কিছু নারী তো অবশ্যই শিক্ষার আলোকে এসে
তারা দেখিয়ে দিয়েছে তারা পুরুষের সমকক্ষ তারাও পারে শিক্ষিকা ,ডাক্তার ,নার্স , পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি নিজ নিজ  ক্ষেত্রে আসীন হতে ।
নিজেকে দিয়ে ভালই বুঝতে পারছি। উচ্চশিক্ষিতা, চাকুরিরতা তার পরেও কিভাবে শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্ছিতা, নির্যাতিতা।
 এ নির্যাতন না যায় কাউকে বলা না ,যায় সহ্য করা। অথচ একটি গ্রাম্য অশিক্ষিত নারী ও বোধ হয় এরথেকে অনেক বেটার আছে।
আজ উপন্যাসের একটা পর্বে বিশ্ব নারী দিবসের উপর লেখা লিখব। আজকে একটা পত্র লিখব অভিযোগ পত্র । না ঠিক অভিযোগ পত্র নয় নারীর ভেতরের শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন তার উপলব্ধির স্ফুরণ তাই নিয়ে।

প্রিয়তম,
শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রিয়তম বলে তোমাকে সম্মোধন করে ।আসলে আজ একযুগ হলো প্রায় এই নামে তোমাকে সম্বোধন করে আসছি। মানুষ তো অভ্যাসের দাস ।তাই।
আমি আজ তোমার প্রিয়তমা নই। আজ আমি একজন নারী হিসেবে তোমার কাছে কতগুলো প্রশ্ন রাখছি। এতদিন আমি চুপ করেছিলাম দেখি তাতে তোমাদের কোন ভাবান্তর হয় কিনা?
না ,তোমাদের বোধোদয় হবে না ।আসলে তোমাদের বোধবুদ্ধির ঊর্ধ্বে গিয়ে শিকড় চলে গেছে মাটির অনেক অনেক গভীরে । তাই তাকে সমূলে উৎপাটিত না করলে কখনোই নিজের দিকে তোমরা ফিরে তাকাবে না।
তুমি হয়তো ভাববে যে ,আজ আমার কি
 হলো ? আজ তোমাদের বাড়ির ছোট বউ এর একি হাল ! আশ্চর্য হচ্ছো না?মনে হচ্ছে না কথাবার্তাতে কেমন  অসংলগ্নতা। যাই বলো না কেন? আজ কিন্তু আমি একটু অসংলগ্ন ই হয়েছি।এবার ভাবতে বসেছ,আজ সকল গণ্ডি পেরতে কে এমন করে বুকে সাহস জোগালো, তোমাদের পুরুষশাসিত সমাজের বাইরে গিয়ে নিজেকে দেখার?তোমাদের হয়তো তাই মনে হবে যে ,একে যা বলেছি এ তাই করেছে। বিচার করার এত ক্ষমতা তো এবারের ছোট বৌ এর ছিল না মনে হতো যেন বোধবুদ্ধিহীন একটা জড়পদার্থ তাই না? এতোকাল তোমরা যা বলতে
তাই করে এসেছি । মুখে কোনও রা কাটি নি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি তোমাদের মন পাবার ।চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি । আসলে বোধহয় আমারও ভেতরে একটা রক্ষণশীলতার বীজ বোপিত হয়েছিল। তাই মন কাজ 
করছিল মা-বাবার দেখানো আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে শ্বশুরবাড়িতে সবার কথাটাকেই মান্যতা দিয়ে আসার। তাই নিজের পরিশ্রম হলেও কষ্ট হলেও, বুকে পাথর চাপা দিয়ে হাসিমুখে চেষ্টা করেছি  সব কাজ একা হাতে করতে। অবশ্য আমার কাজ দেখে তোমরা উপরে হয়তো প্রশংসা করো নি কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রশংসা করেছ, যার জন্য কাজের মেয়ে টুনিকে ছাড়িয়ে দিয়েছ। তোমরা ভেবেছো আমি বোধহয় এসব কিছুই বুঝতে পারিনি। এতটা বোকা কিন্তু আমি নই। সব বুঝতে পেরেছি কিন্তু আমি কিছু বলিনি ।ওই যে শ্বশুরবাড়িতে পা দেবার আগে মা শিখিয়েছিল জীবনটাতে শুধু এড জাস্ট শুধু অ্যাডজাস্ট করে যাবি। তাহলে দেখবি সব থেকে বেশি ভালো থাকবি  ।তাই করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি আমার মায়ের উদ্দেশ্যে বলছি তোমরা অ্যাডজাস্ট করতে করতে তোমরা তৃণের থেকেও বেশি নরম হওয়াতে তোমাদেরকে পা দিয়ে দলিয়ে , মাড়িয়ে চলে গেছে সবাই। তাই পারলাম না। শেষ পর্যন্ত পারলাম না । কেন বলো তো ? ছোটবেলায়  আমাদের পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তু এক জেঠিমা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে কাজ করতে। দেশভাগের যন্ত্রণা জেঠিমাকে কুরে কুরে খেত। যে দেশকে আপনার করে ভেবেছিল আর তার নিজের রইল না অঝোরে শুধু চোখের জল ফেলতেন। ও দেশের ঐশ্বর্য ফেলে এসে এদেশে ঝিয়ের কাজ করতে হত।কাজ করতে বলতেন প্রায়ই  'মাইয়া হইয়া জন্মাইছ  ব্যাটাছালের পায়ের তলায় থাকইতে অইবো। যতই চেষ্টা কইরো না ক্যান উপুরে কিন্তুক কুনো দিনই উঠবার পাইরবে না । আবার কখনো কখনো বলতেন 'মাইয়া গো জীবন অইতাছে উদ্বাস্তুর জীবন ,যেহানেই যাউক হেইখানে হগল সময় উদ্বাস্তুর মত জীবন কাটাইতে অয়। মাইয়া মানুষের আবার আসল ঠিকানা কি। হগল সময় কারোর না কারোর অধীনে থাকইতে অয়। 'আসলে বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতো ,মাও ভালোবাসতো ।মেয়ে মানুষের এই আদর পরিবারের বাকিরা কেউ মেনে নিতে চাইনি ।সেই আদরেই বোধ হয় আমার ভেতরে একটা স্পষ্ট বাদী মনোভাব গড়ে উঠেছিল। যখন কোন কিছুর প্রতিবাদ করতাম তখন জেঠিমা আবার বলতেন ও 'মাইয়া তুমারে কয়ডা কথা কই। মাইয়া হইয়া এত জেদ রাইহ না। কপালের তাইলে কিন্তু অনেক কষ্ট।'
'ছোটবেলায় তখন শুধু ভাবতাম জেঠিমা কি যে বলে সবারই দুটো হাত দুটো পা । তাহলে সব সময় পুরুষ মানুষ যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারব না। প্রতিবাদ করব। তাই দেখতাম আমার ঠাকুমা যখন মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন মা কিন্তু চুপ করে থাক তো। মাকে কতদিন চোখের জল ফেলতে দেখেছি। যখন ঠাকুমাকে মায়ের পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলতাম ঠাকুরমা বলতো 
'এই মাইয়া ঘর করতি পাইরবো না। প্রতিদিনই শ্বশুর বাড়ি থেইকে লোক আইসবো। মাইয়ারে শিক্ষা-দীক্ষা 
দাও । এর তো লাজ-লজ্জা কিছুই নাই। পোলা মানুষের মত সারাদিনে টো টো টো কইরা ঘুইরা বেড়ায়।ঘরের কিছু কাজকর্ম শিখাইতে তো পাইরো?'
 মা কিন্তু চুপ করে থাকতো। মা পরে ভেতরে গিয়ে আমাকে আদর করে বলতো' এসব কথা বলিস না ঝাঁসির রানী' আর কাছে টেনে খুব আদর করত।'
আজ তাই সেই ছোট্টবেলার শক্তিটাকে আবার কাজে লাগাচ্ছি।
দেখলাম আমার ভেতরে যে  শক্তি আছে যার দ্বারা আমিও  প্রতিহত করতে
 পারি ।তাই আজ বাকশক্তির সাহায্যে সেটাকে লেখনি হিসেবে ব্যবহার করলাম আজ তাই প্রতিবাদ করছি।
এর ফল কি হবে আমি জানি।আর আমার ও বাড়ীতে ঢোকা হবে না । আজ যেন সেই জেঠিমার কথাটাই সত্যি হলো "মেয়ে মানুষের জীবন উদ্বাস্তুর মতোই।"আমি জানি আজকের পর থেকে আর তোমাদের বাড়িতে আমার জায়গা হবে না।আমি আমার নিজের আইডেনটিটি  তৈরি করে নিয়েছি । তুমি  খুব অবাক হচ্ছো না? বাবা, আমি এত কথা গুছিয়ে লিখতে পারলাম?আমি জানি তুমি মনে মনে হাসবে। পরে বলি একটা প্রশ্ন তোমার মনে জেগেছে তো ,সেই আইডেন্টিটি  কি? প্রথমে বলি আমি একজন নারী। নারীর ভেতর রয়েছে সেই শক্তি, দেবী দুর্গার রূপ। অসুর দলনী দেবী দুর্গা। নারীর একদিকে রয়েছে অসাধারণ ধৈর্য শক্তি কিন্তু ধৈর্যের অনেক পরীক্ষা দিলাম এই সংসারে,মন তোমাদের জুগিয়ে উঠতে পারলাম না ।আর সম্ভব নয়। তাই আমি এবার 
নিজেকে আবিস্কার করার নেশায় মেতেছি।
' জানো ,তুমি তো জানো আমি আগাগোড়াই নিরীহ অবলা জীবগুলোর প্রতি একটু ভালোবাসা সহানুভূতি দেখাই। এবার ওদেরকে নিয়ে কাজ করব ।তোমরা যে এত কিছু করেছ আমার সাথে তার পরেও বেঁচে থাকার তাগিদ পেয়েছি কোথা থেকে জানতে চাও ?ওই ছোট্ট ছোট্ট স্ট্রীট ডগ  ওদেরকে ভালোবেসে ।এখন দেখলাম মানব জীবন তো একটাই বার বার  পাব না এই জীবন।হয়তো অন্য রূপে আসব। এই জীবনে তুচ্ছাতিতুচ্ছ সাংসারিক কাজ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করে নাই বা ছোট করলাম। এবার আমি সেবার ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ 
করলাম ।জানো ,কারা আমার দিকে হাতটা বাড়িয়েছে? এইরকম অনেক অনেক অসহায় নারীরা একত্রিত হয়েছে এই 'নারী শক্তিতে।' কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা টা মনে পরে তোমার
' আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি'। আমরা এখন 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কেমন অবাক লাগছে না ?এ বাবা এ বাড়ির ছোট বউ । আজ মুখ খুলেছে ভাবছো। জানি বড় পিসিমা গুটিকয়েক গালমন্দ দিচ্ছে আর আমার শাশুড়ি মা হেসে মিছরির ছুরি শানিয়ে তোমাদের বাড়ির ছোট বউ এর বুকে বসাচ্ছেন।
আর কি কথাই না তোমাকে শোনাচ্ছেন
 বলো ?'বলেছিলাম এ রকম মেয়েকে বিয়ে করিস না '।
যদিও পাত্রী তোমাদের অভিভাবকরাই দেখতে গিয়েছিলেন সঙ্গে তুমি গিয়েছিলে ।এক দেখাতেই তোমার পছন্দ হয়ে গেছিলো। সেদিন যে তুমি আমার ভিতরে কি দেখেছিলে  কে জানে! তুমি আজকে ভাবছো তো কি শান্ত ভাবলেশহীন একখানা মুখ আজকে তার ভেতরে প্রতিবাদী সত্তা আমিও না খুব অবাক হচ্ছি ।তবে আমি তোমাকে কোনো দোষারোপ করছি না ।আমি জানি তুমি মায়ের ন্যাওটা  ।যতই তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালোবাসার চেষ্টা ক'রো না কেন মায়ের কথার উপরে তুমি উঠতে পারবে ?না, না ,না  আমি কিন্তু একবারও বলছিনা তুমি মায়ের অবাধ্য হও কিন্তু সব থেকে খারাপ লাগে কি জানো? আসলে একটা মেয়ে সে তো তার সর্বস্ব ছেড়ে একটা নতুন পরিবারে আসে। সবাই কে  মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে তার সঙ্গে যদি পরিবারের অন্য সবাই যাই করুক না কেন অর্থাৎখারাপ ব্যবহার করুক কিন্তু স্বামী যদি তার সঙ্গ দেয় তাহলে কিন্তু এত কষ্ট লাগে না। না আমার কোন কষ্ট নেই। আমি জানি তুমি চেষ্টা করলে হয়তো প্রতিবাদ করতে পারতে কিন্তু তুমি চেষ্টাই করোনি। শুধু কষ্ট হয় কোথায় জানো ?তোমার জন্য ।আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম । তুমি আমাকে ভালোবেসেছো হয়তো?কিন্তু তুমি বেঁধে রাখতে পারলে না। এজন্য আমার খুব কষ্ট হয় ।আমিও পারলাম না 
জানো ?চিরদিন নিজের নারী সত্তার অবমাননা আমি আর দেখতে পারলাম না । প্রতিনিয়ত কি শুনেছি তোমাদের বাড়িতে বলতো '
বাচ্চা না হওয়ার যন্ত্রনা  ,বাজা মেয়ে ছেলে  ।কিন্তু সত্যি করে বলো তো সত্যি কি আমার কোন দোষ ছিল তাতে ?ওই ব্যাপারটা নিয়ে আমি আর নাড়াচাড়া করতে চাই না। আমি বাজা মেয়ে মানুষ হয়েও কিন্তু কতগুলো অবলা জীব এর মা হয়েছিলাম ।বাড়ির সামনে দেখো নি আমার সন্তানদের?কি সুন্দর আর ওদের কাছে আমি মা হয়ে গেলাম।ওদের  ভালোবাসা মায়ের প্রতি সন্তানের বিশ্বাস ভালোবাসা উজাড় করে দিত ওরা। তোমাদের বাড়িতে ছিলাম আমি এই তৃপ্তি নিয়ে। তাই না পাওয়ার বেদনা আর আমাকে কুরে কুরে খেতো না। যদিও এর জন্য লড়াই করে নিতে হয়েছে ।আজকে যদিও বা আমি থাকতে 
পারতাম ।পারলাম না ।কেন বলতো? সত্যি কথাটা তোমাকে জানাচ্ছি 'তিন্নিকে যেদিন তোমরা মেরে ছিলে।সেদিন তোমাদের ক্ষমা করতে পারিনি।
তোমাকে চিঠি লিখতে গিয়ে আমার বুকের ভেতরটা বারে বারে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল।
 তার থেকেও সাংঘাতিক অন্ধকার বিষণ্ণতার দিন ছিল সেদিন ,যেদিন তোমরা আবারো তিন্নিকে মারলে  আমার উপর রাগ করে।  আমি ওদেরকে আদর করে খাবার খাওয়াতে গেছি কিন্তু সে তোমরা খেতে পর্যন্ত দিতে দিলে না। অমানুসিক কাজটা করেছিলে। সেদিন আমি কিছুই করতে পারলাম না। যদি কিছু করার ক্ষমতা না থাকে তোমাদের বাড়িতে থেকে কি লাভ বল তো ?তাই চলে এলাম। হ্যাঁ ,জানি অনেক রাগ অভিমান তোমাদের থাকবে। যাই থাকুক সেটুকুই আমার জন্য প্রাপ্য ।সেটা মাথায় তুলে নিলাম। তবে তুমি বলেছিলে একদিন ক্যান্ডেল ডিনার করাবে সেখানে শুধু তুমি আর আমি আর ক্যান্ডেল দুজন দুজনার দিকে ওই রকম একটা মায়াবী পরিবেশে তাকিয়ে থাকব পরস্পর পরস্পরকে আপন করে নেবো ,সে অতৃপ্তি আমার থেকে গেল। সে থাক কত আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায় ।সে নিয়ে আর আফসোস করি না।

আজ আমি নারী এই প্রথম যেন অনুভব করলাম।তাই আমার ভেতরে রয়েছে সেই 
শক্তি । মাতৃশক্তির জয়জয়কার হোক। আমি তার অংশীদার  ।তাই আজ নিজেকে প্রমাণ করার জন্যই বেরিয়ে পড়লাম, পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো ।ভালো থেকো ।
তবে অবশ্যই আমি তোমাকে  বলব আমার জন্য যদি তোমার কোথাও একটু সফট কর্নার থেকে থাকে, আমাকে ভুলে গিয়ে তুমি নতুন করে জীবন শুরু ক'রো ।আমি তো বারবার তোমাদের বাড়িতে এটাই শুনে এসেছি আমি আসার পর থেকে নাকি তোমাদের সংসারের সব থেকে বেশি অশান্তি শুরু হয়েছে। অশান্তি যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তাহলে তো শুধু শান্তি আর শান্তি। তোমার ওই হাসি মুখটা দেখতে চাই আর তোমাদের সংসারে যারা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী প্রত্যেকের মুখে হাসি টুকু থাক। 
ওই দেখো শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি তোমার কথা কিছু বলবো মাথা থেকেই চলে যাচ্ছে।
শোনো ,তোমার মাঝে মাঝে গ্যাসের প্রবলেম হয় তুমি কিন্তু ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া টা করো আর পারলে জলের পরিমাণটা একটু বেশি খেয়ো।
আরেকটা কথা তোমার দিদি বারবার বলত না তোমার দিদির দুঃসম্পর্কের কি রকম ননদ হয় সে নাকি খুব ভাল মেয়ে। এখনো তোমার জন্য ওয়েট করছে। এবার তুমি তাকে গ্রহণ করে ধন্য হও।
শোনো ,তোমার রাত্রিতে অন্ধকারে ভয় লাগে আমি জানি। তাই ব্যালকনির আলোটা জ্বেলে রেখো আর মাঝে মাঝে উঠে তোমার জল খাওয়ার অভ্যাস আছে ।জলের বোতলটা কাছে রেখো।
চিন্তা নেই আইনগতভাবেই তোমাকে ছাড়পত্র দেব। কাগজপত্র রেডি করে আমাকে পাঠিয়ে দিও আমার ঠিকানা তোমাকে আমি দিয়ে দেবো।
এটাই বেশ ভাল হল ।তোমার পক্ষে ও 
ভালো ।আমার পক্ষেও ভালো ।তোমার পরিবারের পক্ষে ও ভালো ।তবে আমার পরিবারের পক্ষে ভাল কিনা জানিনা ।আমার পরিবার বলতে আর কে আছে বল তো ?মা, বাবা সে তো কবেই তারা পর করে দিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মামা মামি তারা তো বরং খুশী হবে ।এত কথা তো তাদের আর শুনতে হবে না ,আর তাছাড়া তাদের আপদ বিদায় হয়েছে। কি ভালো নাম 
না ?তোমাদের বাড়িতে ,মামার বাড়িতে ও আপদ। আজ আর এ সব আমার মনে দাগ কাটে 
না ।জানো ,আগে খুব কষ্ট পেতাম ।কত চোখের জল ফেলেছি। সারারাত হয়তো ঘুমোতে পারিনি কিন্তু তুমি কিন্তু দিব্যি নাক ডেকে ঘুমিয়ে আছো একবারও খোঁজ নাওনি।
আজ আমি মুক্ত ।মুক্তবিহঙ্গ নীল আকাশে ওড়ার পালা। তাই নিজেকে উৎসর্গ করলাম 'নারী শক্তি দুর্গা' তে। ওদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এরকম অসহায় বিপন্ন নারীদের নিয়ে কাজ করা এবং তাদের 
সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিলাম ওদের মত এরকম একটি ভাল কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে খুবই ধন্য মনে হচ্ছে। অন্তত কারোর জন্য তো কিছু করতে পারব? জানি এই নিয়ে তোমাদের বাড়িতে বিদ্রূপের ঝড় উঠবে। সে উঠুক একটা জিনিস তো থাকতেই হবে। তোমাদের মধ্যে না হয় আমি বিদ্রূপ সমালোচনা ঘৃণার পাত্র হয়ে চিরজীবী হয়ে থাকলাম।আর একটা কথা ,যদি কখনো তিন্নি ফিরে আসে। ওকে আর আঘাত ক'রো না। আমি তো তোমাদের বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি
পারলে ওকে আমার নাম করে একটু খেতে দিও।
তবে এইটুকু আমার দাবি যদি মান্যতা দাও,
 দেবে ।না দিলে আর কি করবো? তবে জেঠিমা আমিও উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়ে উঠব। এতদিন গলিপথে ঘোরাফেরা করেছি এবার সঠিক রাস্তায় চলবো।
আবার বলি ভালো থেকো, নতুন ভোর কুয়াশার চাদর সরিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সোনালী রোদ্দুর,স্বর্ণালী সন্ধ্যা বার বার ফিরে আসুক তোমার জীবনে। শুরু হোক নতুন জীবন।

ইতি 
তোমার 
কোন এক সময়ের পরিচিতা
৮.৩.২২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much