উপন্যাস
টানাপোড়েন ১০৯
দায়িত্বের বেড়াজাল
মমতা রায়চৌধুরী
যেমন মাথাটা ব্যথা করছে ঠিক তেমনি গলাটাও জ্বালাচ্ছে,খুসখুসে কাশি হচ্ছে। রেখা ভাবল বাড়িতে গিয়ে গরম জলে লবঙ্গ, লবণ ফেলে,কারগিল করতেই হবে। ওদিকে বড়দিকে আবার ফোন করতে হবে। কি দরকার ছিল আমাকে দেবার। এবার দায়িত্বটা অনিন্দিতার হাতে তুলে দিলেই পারতেন। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অটোস্ট্যান্ড পৌঁছালো।
বিধান এগিয়ে এসে বলল ' ও দিদি, চলুন।'
রেখা বলল 'ও বিধান ,আছো?'
বিধান অটোওয়ালা বলল'হ্যাঁ দিদি একটা ঝামেলা হয়ে গেল। না হলে আমি আগেই চলে
যেতাম ।আপনার সঙ্গে হয়তো দেখা হতো না।'
রেখে একটু উৎসুক হয়ে বলল 'ঝামেলা কেন
গো ?কি নিয়ে ঝামেলা?'
বিধান বলল' আর বলবেন না দিদি, আমারই লাইন ছিল ,আমি একটু অটোটা রেখে গেছিলাম একটু খেতে ,তার মধ্যে অন্যজনা লাইন দিয়েছে এই নিয়ে। তা দেখলাম ঠিক আছে যা। তুই আগে যা বাবা ।আমি না হয় পরেই গেলাম।'
রেখা হেসে বললো 'সত্যি তোমাদেরকে এই নিয়েও ঝামেলা পোহাতে হয় ,হ্যাঁ।'
বিধান বলল' ঝামেলা করলে
ঝামেলা । এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।'
রেখা বললো' তা ঝামেলাটা কে করলো ওই গেরা।'
বিধান হেসে বলল' দিদি, আপনিও জানেন?'
রেখা মুচকি হেসে বললো 'তা কি ভাবো আমরা কিছু খবর রাখি না?'
বিধান মাথা চুলকে বলল 'হ্যাঁ ঠিকই দিদি, আমারই ভুল।
রেখা বলল' ধুত ক্ষ্যাপা। ভুল আবার
কি ?তোমাদের যে জোরে জোরে চেঁচানোর আওয়াজ হয়, যে কোনো যাত্রী বলে দিতে
পারবে ।শুধু আমি নই।'
বিধান হে হে করে হেসে উঠলো।
রেখা বলল 'নাও এবার চলো। এ বাবা এ তো ফাঁকা ।ক'জন হলে ছাড়বে গো?'
বিধান বলল' কি বলি বলুন তো দিদি ?আমার তো সব প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেল। '
অন্য দু'জন প্যাসেঞ্জারকে আসতে দেখে হাসতে লাগলো আর অত্যন্ত ভালোবাসার সুরে বলল ', আসুন ,আসুন, আসুন। এই গাড়ি আগে ছাড়বে , এই গাড়ি আগে ছাড়বে।'
রেখা দেখল ', এত করে ডেকে নিয়ে আসলো। ওর গাড়ীতে না গেলে বেইমানি করা হবে।'
রেখা অটোতে উঠে নিজের জায়গা নিয়ে বসলো।
এর মধ্যে দু'জন ষন্ডামার্কা লোক এসে বসার চেষ্টা করল।
রেখা বলল সামনের সিট ফাঁকা আছে, বসুন না?
ষন্ডামার্কা চেহারার লোক দুজন রেখার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন মনে হচ্ছে চাহনিতে রেখাকে ভস্ম করে দেবে। লোক দুজনকে মোটেই সুচারু মনে হচ্ছে না। রেখাও ভয় পাওয়ার মেয়ে নয়। নিজেদের এরিয়া এখানে সবাই তাদের কে চেনে। সুতরাং এমন তেমন কিছু করলে মার খেয়ে ভূত হয়ে যাবে। রেখাও কটমট করে তাকালো দুজনের দিকে। দুজন লোক যা ভেবে বদ মতলব আঁটছিল, তা সে গুড়ে বালি ভেবে একটু কাচুমাচু হয়ে বলল' ও ম্যাডাম কেউ না কেউ তো বসবে ।আমরা বসেছি তাতে কি আপনার খুব অসুবিধা হচ্ছে?'
রেখাও দমবার পাত্রী নয়, বলল 'অসুবিধা না হলে কি আর আপনাদের বলছি।'
ষন্ডামার্কা চেহারার লোক দুজন বলল 'কিন্তু কেউ না কেউ তো …
রেখা তাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল' যখন আসবে তখন দেখা যাবে। আর কিছু প্রশ্ন?'
ষন্ডামার্কা চেহারার লোক দুজন চুপ করে রইলো।
এর মধ্যেই বিধান আরো দুজন ভদ্রমহিলা কে ডেকে নিয়ে আসল।
বিধান বলল 'ও দাদা আপনারা দুজনেই সামনের সিটে যান দুজন লেডিজ এখানে বসে যাক।'
রেখা বলল 'আমি তখন থেকে আপনাদের দু'জনকেই একই কথা বলে যাচ্ছি।'
বিধান বলল 'ও দাদা, শুনতে পাচ্ছেন না।'
ষন্ডামার্কা চেহারার দুজন লোক বলল "ধেততেরি, আপনার অটোতে বসবই না। 'বলেই মেজাজ দেখিয়ে দুজন উঠে পড়ল।
রেখা ভাবল এই যা গরিব মানুষ বিধানের ও দু'জন প্যাসেঞ্জার নেমে গেলে তো খুবই ক্ষতি হবে,শুধুমাত্র রেখার জন্য। রেখা কি করবে সেটাই ভাবছে। রেখা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল। একদিকে লোকগুলোর লোভনীয় আচরণ অন্যদিকে বিধানের দুজন লোক নেমে যাওয়া মানে...।
এরমধ্যে বিধান দেখে বলে উঠল 'দেখি আপনারা কোন অটোতে যান?
অটোতে উঠে আবার নেমে যাওয়া আবার মেজাজও উপরি পাওনা হিসেবেদেখানো।,'
লোক গুলো কি একটা ভাবল ভেবে নিয়ে আবার বিধানের অটোতে উঠে
বসলো ।এবার ঠিক সামনের সিটে বসলো আর দুজন ভদ্রমহিলা রেখার কাছে বসলো।
বিধান বলল আজকে যদি আপনারা মেজাজ না দেখিয়ে এমনি বলতেন যে 'ঠিক আছে ভাই আমরা অন্য অটো দেখছি, তাহলে মেনে নিতাম । কিন্তু এইভাবে ?আজকে কি করে যেতেন আমরাও সেটা দেখে নিতাম ।আমাদের মধ্যে ইউনিটি নেই ভেবেছেন?'
ষন্ডামার্কা চেহারার লোক দুজনা কোন কথা বলল না ।বিড়বিড় করে দুজনে কি বলল সেটা শোনাও গেল না।'
রেখা তো মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল আর বিধানকে তাড়া দিল'বিধান তাড়াতাড়ি চলো।'
বিধান অটোতে স্টার্ট দিয়ে বলল 'এই তো যাচ্ছি।'
বিধান জিজ্ঞেস করল আপনারা কোথায় যাবেন? মানে কোথায় নামাবো?'
ষন্ডামার্কা চেহারার লোক দুজন বলল 'বুদ্ধ পার্ক।'
আর পাশের দুজন ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় নামবেন?
দুজন ভদ্রমহিলা বললেন' এইতো আমরাও বুদ্ধ পার্ক এ নামবো।'
বিধান বলল তাহলে মোটামুটি একই লাইনে আছেন সবাই।'
বিধান বলল 'দিদি আজকে একটু আপনার লেট হয়ে গেল না?'
রেখা বলল হ্যাঁ, তা একটু হলো বটে, কি আর করা যাবে বলো।'
বিধান চেঁচাতে লাগল বাগের মোড়, বাগের মোড়।
রেখা মনে মনে হাসতে লাগল অটোওয়ালাদের সবারএক রোগ ।যতক্ষণ ওদের কোটা পূর্ণ না হবে ,ওরা হাঁকতেই থাকবে ।
ড্রাইভার এর পাশে একটি সিট ফাঁকা ওটাকেও ফিলাপ করতে হবে।
বিধান আবার হাঁকতে থাকে বাগের মোড়, বাগের মোড়, বুদ্ধ পার্ক, বি ব্লক...।
রেখা মনে মনে ভাবতে থাকে বড়দি তো নাছোড়বান্দা কিছুতেই অনুষ্ঠান পরিচালনার ভার অন্য কারও হাতে ছাড়বেন না কিন্তু সেদিনকার অপমানটাও তো ভুলতে পারছে না রেখা ।যদি এখানে বড় দির কোন কিছু করনীয় ছিল
না ।এমন ভাবে ঘটনাটা ঘটলো। যদিও পরবর্তী ক্ষেত্রে বড়দির হস্তক্ষেপে এই ব্যাপারটা সামাল দেয়া গেল।
কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না বড়দির কথা তো ফেলতেও পারবে না।
এরইমধ্যে বিধান বলল' বুদ্ধ পার্ক এসে
গেছে ।নামুন ,নামুন, নামুন।'
রেখার ভাবনায় ছন্দ পতন ঘটল।
রেখা অটোতে একা আর কিছুক্ষণ পরেই রেখা নাববে। ম্যাগনেট হাউস পার হয়ে আরো একটু যেতে হবে।
বিধান বলল 'দিদি আপনার বাড়ি।'
রেখা ব্যাগ থেকে মানিব্যাগটা বের করে বিধানের ভাড়া মিটিয়ে দিল।
বিধান একগাল হেসে বলল' দিদি কাল কটার গাড়ি ধরবেন?'
রেখা বলল 'কালকে একটু বেলায় বেরবো গো।
পরের ট্রেনটা ধরবো।'
বিধান বলল ঠিক আছে যদি আমি ওই সময় যাই তাহলে আপনাকে তুলে নেব।'
রেখা বলল 'ঠিক আছে।'
বাড়িতে ঢুকে কলিং বেল বাজালো, কলিংবেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে' জয় শ্রী কৃষ্ণ ,জয় শ্রী কৃষ্ণ, জয় শ্রী কৃষ্ণ।"
মনোজ এসে দরজাটা খুলল তারপর দরজাটাকে না ভেজিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।
রেখা অবাক হয়ে গেল রেখাকে একবার জিজ্ঞেসও করল না ভালো-মন্দ।
রেখা দরজা বন্ধ করতে করতে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।
এরপর ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল ওয়াশরুমে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে গোপালের সন্ধ্যারতি করে কফি করবে বলে রান্নাঘরের দিকে গেল।
তাড়াতাড়ি দু'কাপ জল প্যানে দিয়ে গ্যাসের চুলায় বসিয়ে দিল। আজকের রেখা ঠিক করে নিয়েছে আজকে ব্ল্যাক কফি খাবে কিন্তু মনোজ এর জন্য ব্ল্যাক কফি চলবেনা। তাড়াতাড়ি কফি বানিয়ে এসে বসল বসার ঘরে ।রেখা ওখান থেকেই মনোজকে ডাকতে লাগল এই শুনছো,এই শুনছো?'
কোন সাড়া না পেয়ে রেখে চলে গেল মনোজের ঘরে।
রেখা গিয়ে দেখে মনোজ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। তারপর অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে বলল' কিগো তোমাকে কখন থেকে ডাকছি সাড়াই দিচ্ছ না।'
মনোজ এবার ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে বললো কি জন্য ডাকছ?'
রেখা বলল 'তোমার জন্য কফি করেছি খাবে না?''
মনোজ বলল 'না'।
রেখা অবাক হয়ে বলল' তুমি কফি খাবে না আমি বানালাম।'
রেখা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো অনেকক্ষণ পর মনোজ কি ভাবলো কে জানে তারপর বলল ঠিক আছে এখানে দিয়ে যাও।
রেখা মনে মনে ভেবেছিল দুজনে একসাথে বসে কফি খাবে। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে করছিল একসময় স্কুল থেকে ফিরলে মনোজই কফি এনে রেখার মুখের সামনে তুলে ধরতো। আর আজ…?
রেখা কিছুক্ষণ মনোজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল সাক্ষী থাকলো শুধু ঘর, ঘরের আসবাবপত্র ।মনোজ কিন্তু ল্যাপটপেই মনোনিবেশ।'
তারপর রেখা ধীরে ধীরে ভেতরের কষ্ট, যন্ত্রণা কে পাথর চাপা দিয়ে চোখের জল গোপন করে হিম শীতল হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো বসার ঘরের থেকে কফির কাপটা হাতে তুলে নিয়ে মনোজের ঘরে গিয়ে দিয়ে আসলো আর বলল তোমার কফি থাকলো খেয়ে নিও।
রেখা কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে আসলো আপন মনে নিজেই কফি খেতে খেতে ফিরে যেতে চাইল তার সোনালী দিনগুলোতে কিন্তু তারই মাঝে হঠাৎই মনে হলো বড়দিকে তো একটা ফোন করা দরকার। নম্বর ডায়াল করে ফোন লাগাল বড়দিকে।
কিন্তু ফোনটা ব্যস্ত ফলে রেখা ফোনটা রেখে দিল ফোনটা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই রেখার ফোন বেজে উঠলো। রিং হতে থাকলো 'তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম...।'
রেখা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে বড়দির
ফোন ।সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যাঁ বড়দি বলুন।''
বড়দি বললেন 'তাহলে কালকের ব্যাপারটা কিন্তু না ক'রোনা রেখা।'
রেখা বলল কিন্তু…
বড়দি বললেন "আর কিন্তু নয় রেখা তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে ।'
রেখা বলল'এবার যেন ওরকম সিনক্রিয়েট না হয় বড়দি.।'
বড়দি বললেন না এবার আর কোন সিনক্রিয়েট হবে না।'
রেখা বলল 'আপনি তো কালকে থাকবেন তাহলেই হবে।'
বড়দি হেসে বললেন 'আমি কালকে থাকতে পারছি না ,রেখা ।একটা আর্জেন্ট কাজ আছে।'
রেখা বলল' তাহলে দিদি?'
বড়দি বললেন 'আমি তো তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি সেরকম যদি কিছু হয় ,তুমি কিছু বলতে চাও ললাল পরের দিন আমি স্কুলে গিয়ে আচ্ছা করে ঝারবো। রেখা চুপ করে থাকলো।
বড়দি বললেন 'তাহলে তুমি আগামীকালের জন্য প্রস্তুতি নাও। ভালো থেকো কেমন.,…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much