১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১১০




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১১০
চিন্তার ভাঁজ
মমতা রায় চৌধুরী


বাড়িতে ঢুকেই রেখা মনোজের ঘরে হট টকের আওয়াজ শুনতে পেল। কখনো বলছে তোমাদের এত দিয়েও তোমাদের মনের আশা পূর্ণ করতে পারলাম না। কখনও কি  আমার কি নিজস্ব কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না ?আমার ভালো লাগা থাকতে পারে না ?আমি কার সাথে ভালো থাকবো, সেই সঙ্গী নির্বাচন করার ক্ষমতা আমার থাকবে না? কেন বলতে পারো প্রতি পদে পদে আমাকে এত কথা তোমরা শোনাও।'
রেখার কাছে সব কিছু যেন মুড়িঘন্ট হয়ে গেল।
রেখা ভাবছে 'কার সাথে কথা বলছে?'
কোথায় সারাদিন ক্লান্ত হয়ে ফিরলাম একটু বাড়িতে এসে খোশমেজাজে থাকবো। কালকে আবার অনুষ্ঠান 


আছে স্কুলে। তার কিছু স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে 
হবে । চিন্তার ভাঁজ পড়ছে কপালে। এর মধ্যে যদি বাড়ির একজন লোক সবসময় হটটক করতে থাকে। সেখানে কি ভালোভাবে কাজ করা যায়? রেখা এসব ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুমে দিকে যায় ,যাবার সময় লক্ষ্য করে মনোজের ঘরের জানালার নীল পর্দাগুলো যেন হাওয়ায় দুলছে। ওয়াশরুমে যেতে যেতেই রেখার পা মনোজের ঘরের কাছে এসে একটু থমকে দাঁড়ালো। রেখার আওয়াজ পেয়ে বাচ্চাগুলো চিৎকার শুরু করেছে। রেখা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে একবার হাঁক দিল'মিলি ,তুলি ,পাইলট এত চিৎকার কিসের?
রেখা যেই না  কথাটি বলেছে অমনি সঙ্গে সঙ্গে চুপ। রেখা কি জাদু জানে, ভানুমতি?আপন মনেই হাসতে থাকে।
এরমধ্যে ফ্রেশ হয়ে গোবিন্দের ভোগ চাপিয়ে , গোবিন্দকে শয়ন দিয়ে , রান্নাঘরে ঢুকলো ,মেপে জল নিল প্যানে, গ্যাস চুল্লিতে বসিয়ে দিল। তারপর ওদের জন্য একবারে মাংসের ঝোলটা গরম করে ভাতটা মেখে খাবার খাওয়াতে গেল।
কিন্তু কি আশ্চর্য  তুলি খাবার খেতেই  এলো না।
ওকে কোলে তুলে নিয়ে রেখা আদর করে খাওয়াতে গেল খাবার দেখলেই মুখ সরিয়ে নিচ্ছে। রোজ খাবার দেখলে পাগল হয়ে যায়।
রেখার মনের ভিতর একটা দুশ্চিন্তা ঢুকলো কী হলো কে জানে?
রেখাnএসে সেন্টুদাকে ব্যাপারটা বলছিল । সেন্টুদা বলল'বৌদি  ওর বোধহয় গ্যাস ফর্ম করেছে?_'
রেখা বলল' কে জানে, কি হলো?'
কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে 
গেল ।রান্নাঘরে ঢুকেই দেখল কফির জল ফুটে  একটুখানি হয়ে গেছে। কি আর করবে আবার আর একটু জল মেশাল। এবার ভালো করে দুধ ফেটিয়ে দিয়ে দিল। তারপর কপি ফেটানো হলো। এবার কাপে ঢেলে এককাপ নিজের জন্য,আর এক কাপ মনোজ এর জন্য নিয়ে মনোজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। এই সময় কফি না খেলেও হয় কিন্তু নেশার মত স্কুল থেকে ফিরে চা বা কফি খেতেই হবে।
রেখা দেখল' মনোজ চুপচাপ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। টিভি টাও বন্ধ। সিগারেট খাচ্ছে। রেখার পায়ের শব্দতেও তাকালো না মনোজ?'রেখা
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল তোমার কফিটা, বলেনহাত বাড়িয়ে দেয় কাপটা দেবার জন্য। মনোজ আপন-মনে তাকিয়ে আছে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে ।রেখার অস্তিত্ব যেন তার কাছে কোন মানেই রাখেনা। রেখার একবার কাছে গিয়ে মনোজকে ধাক্কা দিয়ে বলল 'তোমার কফিটা নাও ,ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।'
মনোজএকদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে 
থাকলো ।তারপর হাত বাড়িয়ে কাপটা নিল । মনোজের চোখের অভিব্যক্তি রেখা যেন আজকে বুঝতে পারছেনা ।কী আছে ওর চোখেতে? তবে এটুকু বুঝল চোখদুটো ছলছল হয়ে আছে ।রেখা আবিষ্কার করার চেষ্টা করলো কে এমন আঘাত দিল যার জন্য আজকে ওর চোখে জল?'
রেখা বলল'' কফির সাথে বিস্কিট খাবে?'
মনোজ ঘাড় নেড়ে নিষেধ করল।
রেখা কোন কথা না বলে বেরিয়ে আসছে'তখন মনোজ নিজে থেকেই বললো ,'আজকে মা ফোন করেছিল?'
রেখাও জিজ্ঞাসু নেত্রে থেকে চোখের ভাষাতে বোঝাতে চাইল কেন?
মনোজ বললো' মা এ বাড়িতে এসে থাকবে?'
মনোজ যেন রেখার উত্তরের অপেক্ষায় উৎসুক ভাবে তাকিয়ে থাকলো।
যেন মনে হচ্ছে রেখার ' হ্যাঁ বা না 'এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। মনে হল যেন গোটা ভবিষ্যৎ টাই রেখার একটা  হ্যাঁ বা না উপর দাঁড়িয়ে আছে। 
রেখা শুধু হেসে বলল 'বাড়ি তোমাদের সুতরাং এখানে আমি কি মন্তব্য করব বলো?
মনোজi তখন বলল কিন্তু তোমাকে বলার একটাই কারন মা দিদি তো তখন ঝগড়াঝাটি করে সম্পত্তির সব টাকা-পয়সা বুঝে নিয়ে চলে গেছে। যদিও এটা আমরা সকলেই জানি যে আজকে দিদির উস্কানিতে আমাদের সংসার এত বড় অশান্তি। গয়নাগাটি টাকা পয়সা সবই তো নিয়ে চলে গেছে। মাসে মাসে ৬-৮ হাজার করে  টাকা পাঠাতে হয়। এজন্য অবশ্য আমার কোন দুঃখ নেই সম্পত্তি গয়নাগাটি কেউ কোনো কিছুর উপরে দুঃখ শুধু একটাই আমাদের মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত করল। তোমার সাথে যে ব্যবহারগুলো করেছে নিজের মা দিদি বলে বলব না একদমই ঠিক করেনি। 
এখন হঠাৎ কি কারণে। আজ সেটাইতো বুঝতে পারছিনা।
সংসার শুধু অশান্তি আর অশান্তি।
তবে মনোজ বলল 'আমি তো মাএর উপর কোন অবিচার করতে পারব না, মা যতই ভুল করুক না কেন ? রেখা বলল তো সমাধান হয়ে গেল।  আর কোন সমস্যা নেই।'
মনোজ অবশ্য মনে মনে ভাবল রেখাএই কথাটাই বলবে, সে  জানে অথচ রেখাকে মা দিদিরা কেউ মেনে নিতে ই পারল না মানুষের ভিতরে একটা টানাপোড়েন একটা চিন্তার ভাঁজ লক্ষ্য করা যায় গেল ।রেখা চলে গেল ঝড়ের বেগে। মনোজ জানে আবার নতুন কোন ঝড় আসতে চলেছেআর বাড়িতে। তাই শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে।।
মনোজ মনে মনে ভাবল কি করবে?.
তার দিদি সম্পত্তির লোভে মাকে হাতিয়ার করেছে। মাও তার বোধ বুদ্ধি সব হারিয়ে দিয়ে দিদির কথায় নাচছে। সব ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েও গেল ।তার পরেও এখন কি চাইছে,?
রেখাকে ব্যাপারে দোষ দেয়া যায় না আমিতো নিজে দেখেছি কত ভালো-মন্দ খাবার হলেও রেখাকে দেয়া হতো 
না । কিন্তু কখন ওর মুখ থেকে এসব কথা শোনা যায়নি।
মনো জ  মনে করতে থাকে একবার সরস্বতী পূজার সময় দিদিরা সবাই এসেছে ,মাসিরা এসেছে। চিংড়ি মাছের মালাইকারি ,মটন কষা,আর মোরোলা মাছের টক এছাড়া তো ডাল ,সবজি হয়েছিলই।
মনোজ সেদিন অনেক পরে 
খেয়েছিল ।খাবার পর এসে রেখাকে জিজ্ঞেস করেছিল 'চিংড়ি মাছ টা কেমন  খেলে আর মোরোলা মাছের টক?'
কেমন অবাক হয়ে মনোজ এর দিকে তাকিয়েছিল। তারপর মজা করে রেখা বলেছিল আজ সরস্বতী পুজো ,আমি তো মাছ খাব না, জানি না?'
মনোজ বোকার মত দেখার কথাগুলো সব মেনে নিয়েছিল।
পরের দিন যখন ইলিশ মাছের তেল ঝোল হয়েছিল সেদিনও খাওয়ার পর মনোজ এসে বলেছিল ইলিশের তেলঝোলটা কি ভালো হয়েছিল না গো?
রেখা সেদিনও হেসেছিল তবে হাসির মধ্যে লুকিয়ে ছিল প্রচ্ছন্ন মলিনতা, চোখের কোনে জল চিকচিক করছিল।
ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সরে গিয়েছিল কাজের অজুহাত দেখিয়ে।
 সেদিন মনোজ খুব কষ্ট পেয়েছিল।
এরকম ঘটনা প্রায় লেগেই থাকত। এই ছোট ঘটনাগুলোই একসময় মহীরুহ আকার ধারণ করেছিল ওর বীজ নিহিত ছিল ছোট ঘটনার মধ্যে। রেখাও কষ্টগুলোকে হজম করতে শিখেছিল সহ্যশক্তি টাকে  বাড়িয়েছিল।
একদিন মনে পড়ে একটা নতুন কিছু খাবার হলেই মনোজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে না খাওয়ার অছিলায় পাতে রেখে দিত আর বলতো রেখা এটা খেয়ে নিও।
মনোজের মা বলেছিল কেন রে তোকে যেটা খেতে দিয়েছি তুই না খেয়ে ওর জন্য রেখে দিচ্ছিস তোর বউকে কি আমরা না খাইয়ে  রাখি?'
মনোজ বলেছিল' খেতে পারলাম না তাই রেখে দিলাম।'
মনোজের মা বলেছিল' তাহলে আগে বললি না কেন, তুলে নেয়া হতো?'
মনোজ ও কথার কোন উত্তর দেয়নি।
পরিবার থেকে তো কত কষ্ট পেয়েছে রেখা মনোজ এর থেকেও অনেক আঘাত পেয়েছে কারণে-অকারণে আজকে মনটা খুবই ভারাক্রান্ত রেখার জন্য।
এরইমধ্যে দেখল মনোজ রেখা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। মনোজ বেরিয়ে রেখাকে বলল' রেখা, রেখা, রেখা।'
রেখা কেমন একটু আশ্চর্য হয়ে
 গেল ।বেশ কয়েকদিন পর মনোজ রেখা কে ডাকছে।
রেখা কাছে গিয়ে বলল 'আমাকে ডাকছো?'
মনোজ  বলল 'তুমি কিছু বললে না?'
রেখা বলল' কোন ব্যাপারে?'
মনোজ  বলল 'কেন মায়ের ব্যাপারে?'
রেখা বলল তুমি বোধহয় খেয়াল করো নি  আমি উত্তরটা কিন্তু দিয়ে দিয়েছি।'
মনোজ  বলল'এটাই তোমার লাস্ট উত্তর?'
রেখা বলল  ' তাছাড়া আমি কি বলতে পারি বলো?
তিনি তার নিজের বাড়িতে আসবেন ছেলের কাছে থাকবেন আমি কি বাধা হয়ে দাঁড়াবো ।এটা কখনো আমার কাম্য নয়।
মনোজ বলল সে আমি জানি? কিন্তু..?
রেখা বললো ' কোন কিন্তু নয়?'
মনোজ বলল কিন্তু রেখা তুমি তো জানো আসলেই দিদি কল কাটি নাড়বে আর বাড়িতে অশান্তি?
রেখা বলল 'তা হয়ত হবে আর তাছাড়া তোমার মা যখন আমাকে পছন্দই করেন না ,আমার মনে হয় যদি অশান্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় আমার আলাদা জায়গায় থাকা উচিত।'
মনোজ চুপ করে কথাগুলো শোনে।
মনোজ বলল 'তুমি এরকম কথা বলছো কেন ?তুমি আলাদা জায়গায় থাকবে?'
রেখা বলল 'ঝগড়া করে তো কোনো লাভ নেই।'
মনোজ বলল আমি নিজে এ নিয়ে  টেনশনে আছি রেখা।'
রেখা বললো আর একটা টেনশন তোমাকে বাড়িয়ে 
দিচ্ছি ।মনোজ ভ্রু কুঁচকেজিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালো আর বললো কি?
রেখা বলল 'তুলি , পাইলট কোন খাবার খাচ্ছে না।'



মনোজ বলল' সে কি? এ তো চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো।'একটু অন্যমনস্ক ভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
রেখা বললো' একবার মন্টু ডাক্তার কে ফোন করো ব্যাপারটা খুলে বলো।'অত চিন্তা নিয়ে বসে থাকলে হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much