১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায় চৌধুরী'র ধারাবাহিক ১০৮উপন্যাস




উপন্যাস 



টানাপোড়েন১০৮
সুখানুভূতি

মমতা রায় চৌধুরী


রেখা আজকাল কোন কিছুতে বেশি গুরুত্ব দিতে চায় না রাগ, অভিমান, ক্ষোভ এসব সে মেনে নিয়েছে ।এগুলো নিয়ে সে যত বেশি ভাববে তার মনের কষ্ট তত বাড়ে। কি দরকার? যারা তাঁর প্রতি বিরক্ত ,যারা তাকে নিয়ে বেশি রাগ অভিমান দেখায় ,সে তাদের প্রতি এগুলো করা ছেড়েই দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষটিই আর তার ভালোলাগার প্রতি কোন গুরুত্ব নেই। তাহলে কার কাছে প্রত্যাশা? বাবা-মা তো কবেই মারা গেছে। আছেন কাকু কাকিমা। তারাও সবসময় আমাকে নিয়ে ভাবেন। রেখার মনে হল  ট্রেন থেকে একটা ফোন করি কাকিমাকে।
ব্যাগ হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা বের করলো। ডায়াল করল নম্বর। ফোন বেজে গেল। 
কটা বাজে ,কাকিমা ফোন ধরছে না ?ওরে বাবা সাড়ে ছয়টা বাজে, নির্ঘাত ঠাকুর ঘরে গিয়ে বসে আছে। একটু পরে করছি ফোন।
উপন্যাসের নেক্সট পর্ব টা নিয়ে ভাবি, কাজে দেবে।
এরমধ্যেই জায়গা নিয়ে দুই ভদ্রমহিলার মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল।
এক ভদ্রমহিলা বলছেন 'জায়গাটা কি আপনার শ্বশুর মশাই কিনে রেখে গেছেন?'
আর এক ভদ্রমহিলা বলছেন " হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ , আমার শশুর মশাই কিনে রেখে গেছেন।
উঠুন জায়গাটা ছাড়ুন। আপনার তো লজ্জা হওয়া উচিত ।আপনি আমার জায়গাটায় বসে পড়লেন  ।দেখতে পাচ্ছেন আমার বাচ্চা  কোলে?'
রেখা খেয়াল করল 'সত্যিই তো ভদ্র মহিলার কোলে বাচ্চা।
আর বসে থাকা ভদ্রমহিলা বললেন' 'বাচ্চা আমারও আছে '।
বাচ্চা কোলে ভদ্রমহিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে  বললেন 'আপনার বাচ্চা কোথায়?'
বসে থাকা ভদ্রমহিলা  বলেন 'কেন বাড়িতে রেখে এসেছি?
যে ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন 'তিনি বললেন 'আপনার বাড়িতে ,এখানে নেই তো! ছোট বাচ্চা দেখছেন কোলে  আমি দাঁড়িয়ে যেতে পারি ?একটু সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখুন।'
বসে থাকা ভদ্রমহিলা বললেন 'সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখলে তো বসা যায় না। এত দূরের রাস্তা?"
রেখা ভাবে  বাহ দারুন তো এরাই তো উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠতে পারে। বাহ বাহ 'কি কথা বলছে দেখি ।
অন্য একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা বললেন এটাতো ঠিক , বাচ্চা আছে উনাকে তো আগে একটু জায়গাটা দিতে পারতেন?'
বসে থাকা ভদ্রমহিলা বললেন একে রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর।বাচ্চা থাকলে সাতখুন মাপ বলুন?আমাদেরও তো কোনো সমস্যা থাকতে পারে?'
বয়স্ক ভদ্রমহিলা বললেন' না, সে তো থাকতেই পারে । তবে..


দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা বললেন ঠিক আছে, আপনি একটু বসুন, তারপর নয় আবার আমাকে দেবেন, এই ভাবেই যাবো এত দূরের রাস্তা।'
বসে থাকা ভদ্রমহিলা বিড়বিড় করে বললেন পথে এসো বাবা। তারপর বললেন 'ভাবছি কি করব ?এখন আপনি দাঁড়ান।'
রেখা সব কথা শোনার পর বলল' ও দিদি, আপনি এদিকে আসুন  আপনি আমার জায়গাটায় বসবেন ,আসুন।'
ভদ্রমহিলা বললেন আপনার
 জায়গায় ?আপনি কোথায় যাবেন?'
রেখা বলল' আমি কল্যাণীতে নেমে যাব।'
বাচ্চা কোলে ভদ্র মহিলা বললেন' সব ই তো চাকদহ। আপনি একটু বসুন ।আমি কল্যাণী এলেই  বসব।'
রেখা মনে মনে ভাবল এই ভদ্রমহিলার তো দেখি নীতিজ্ঞান ঠিক আছে । খারাপ নয়।
তারপর বললো 'আপনি বসুন না, বাচ্চা কোলে নিয়ে আছেন।'
 বাচ্চা কোলে ভদ্রমহিলা বললেন ,'না আপনিও তো কোথাও না কোথাও যাচ্ছেন জার্নি করেই। আমার খারাপ লাগবে।
রেখা বলল' ঠিক আছে।'তাহলে আপনার বেবিটিকে আমার কাছে দিন।'
ভদ্রমহিলা একগাল হেসে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে বললেন ঠিক আছে দিদি একটু ধরুন তাহলে খুব ভালো হয়।
এবার হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে রেখার কোলে দিতে গেল কিন্তু বাচ্চা আসবে কেন ?এই বাচ্চা তো মনে হচ্ছে বেছে বেছে কোলে চাপে।
রেখাও খুব আদরের সঙ্গে বলল-এসো বাবা ,এসো,  আমার কোলে এসো সোনা বাচ্চা।'
ভদ্রমহিলা শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটিকে রেখার  কোলে দিতে পারলেন।
বাচ্চাটা কোলে এসে রেখাকে দুচোখ ভরে দেখতে লাগলো। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠলো। কি অপূর্ব হাসি ।রেখার মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
রেখা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ওর সাথে খুনসুটি  শুরু করে দিলো ।বাচ্চাটিও ঠিক রেখার মতো সঙ্গে সেট হয়ে
 গেল ।ভদ্রমহিলা দেখে খুব খুশি হলেন বললেন আমার ছেলের না সবার কাছে যেতে চায় না ।কিন্তু দেখুন আপনার কোলে কি সুন্দর রয়েছে।
রেখা বল হ্যাঁ এক নিমিষেই চিনে গেল কেমন।'
ভদ্রমহিলা বললেন' আসলে শিশু তো ওরা মানুষ চেনে। আপনার মনটা খুব ভালো।'
রেখা শুধু হাসল আর বাচ্চাটাকে গাল ধরে আদর করতে লাগল।
আর যে ভদ্রমহিলা ঝগড়া করছিলেন তার অবস্থাটা দেখার জন্য রেখা মুখটা ঘোরাল, দেখল নাক ডেকে অত ভিড়ের মধ্যে ঘুম দিচ্ছেন।
এরমধ্যে রেখার ফোন বেজে উঠলো। রেখা একটু  বিরক্ত হলো। এখন ব্যাগ খুলে হাতরে হাতরে তার থেকে ফোন বের করে রিসিভ করতে হবে ভেবে।এদিকে বাচ্চাটিও কোলে আছে।
ফোন বেজে কেটে গেল আবার ফোন বাজতে শুরু করলো ।এবার চেষ্টা করল ফোনটা বের করার ।মনে হচ্ছে যেন কোন আর্জেন্ট কল। বাচ্চাটাকে খুব সাবধানে সাইড করে নিয়ে ,ব্যাগটাকে কায়দা করে বের করল ।তারপর তার ভেতর থেকে হাতরে হাতরে ফোনটা বের করল। ফোন ধরতে ধরতে কেটে গেল। রেখা ফোনটা বের করে দেখলো কে ফোন করেছে।
অবাক হয়ে দেখল যে বড়দি ফোন করেছেন। রেখা ভাবছে এই সময় বড়দি কি কারনে? সাত-পাঁচ ভেবে ফোনটা ঘুরিয়ে করল। 
রিং হতেই বড়দি ফোনটা রিসিভ করে বললেন' রেখা তুমি কি বাড়ি পৌছে গেছো?_
রেখা বলল  'না ,দিদি। একটু দেরি হবে।'
বড়দি বললেন"তোমাকে কি ডিস্টার্ব করছি?'
রেখা অত্যন্ত আনুগত্যের সঙ্গে বললো 'এভাবে কেন বলছেন দিদি?'
বড়দি বললেন 'রেখা নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের 125 তম জন্মবার্ষিকী আমি চাই তুমি প্রোগ্রামটা অ্যারেঞ্জ করে সঞ্চালনা কর।'
রেখা বললো' কিন্তু দিদি,?
বড়দি বললেন  'আবার কি হলো?'
রেখা বলল 'দিদি ফেয়ারওয়েলএর অনুষ্ঠান ঘিরে বিতর্ক এবং  কেওয়াস সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারপরে আর এর মধ্যে থাকতে ইচ্ছে করছে না।'
বড়দি বললেন' আমি সব জানি ,বুঝি।'
রেখা বলল' এর পরে কি করা ঠিক হবে দিদি?'
বড়দি বললেন 'তুমি হালটা ধরো। এরপর যদি অন্যরা কেউ কিছু বলে সেটা আমি দেখব।'
রেখা বলল ', আপনি অনিন্দিতাকে দিয়ে দিন না?'
বড়দি বললেন 'তুমি খেপেছো রেখা। 'বদনাম করে ছেড়ে দেবে স্কুলের।'
এরমধ্যে ওই ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন 'ও দিদি বাচ্চা আমাকে দিন। আপনি কথা বলুন।'
রেখা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝাতে চাইলেন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
অন্যদিকে ট্রেন মদনপুরে আসতেই যাত্রীরাএতো হইচই বাধিয়ে দিল ,বড়দির কথাগুলো শোনা যাচ্ছে না।
রেখা বলল' দিদি আমি বাড়িতে গিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলব।'
বড়দি বললেন ঠিক আছে। ঠিক আছে।
রেখা ফোনটাকে এক হাতে ধরে এবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন' দিদি আপনি আস্তে আস্তে এদিকে চলে আসুন ।আমিতো নামবো ।আপনি আমার এই জায়গাটা বসুন ,আসুন।
ভদ্রমহিলা একগাল হেসে বললেন' হ্যাঁ এই তো যাচ্ছি।'
তারপর ভদ্রমহিলা বললেন ', কি উপকার যে করলেন আপনি?'
রেখা বলল 'না ,নাকি এমন করেছি ।কেউ না কেউ তো এই জায়গাটা বস্তুই সেখানে আপনি না হয় বসবেন।
ভদ্র মহিলা বললেন সব ঠিক আছে কিন্তু আপনি এতো সুন্দর করে বললেন আপনার ব্যবহারটা আমার খুব খুব ভালো লেগেছে আর আমার বাচ্চাকে এতক্ষণ কোলে করে রাখলেন।'
রেখা বলল বাচ্চারা তো ভগবানের রূপ ওরা কত সুন্দর একটু না হয় কোলেই নিলাম।
ভদ্রমহিলা রেখার সামনে এসে দাঁড়াতেই বললেন  আপনি বসে ওকে কোলে নিন।
ভদ্রমহিলা বললেন হ্যাঁ হ্যাঁ ।তারপর জায়গাটায় কোনরকমে বসলেন ,বসে বাচ্চাটিকে, কোলেনিলেন। আসলে একটু হেলদি তো।
মায়ের কোলে যেতেই বাচ্চাটি চোখ মেলে তাকাল এতক্ষন ঘুমিয়ে পড়েছিল তারপর আর একবার কাউকে যেন খোঁজার চেষ্টা করলো বাচ্চার মা বুঝতে পেরে বলল দিদি ও দিদি দেখুন আমার বাচ্চা আপনাকে খুঁজছে কেমন?
রেখা বললো ভালো থেকো সোনা ।টা টা।
ভদ্রমহিলা বললেন ভালো মানুষ বাচ্চারাও বোঝে।
রেখা হেসে ব্যাগগুলো নিয়ে গেটের কাছে চলে গেল আর বলল সাবধানে যাবেন আপনারা।
ভদ্রমহিলা বললেন হ্যাঁ দিদি আপনিও আবার যদি কখনো দেখা হয় কথা হবে।
রেখা শুধু হাসল।
ট্রেন থামতে রেখা নেমে পড়ল তারপর জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে ভদ্রমহিলার তার বাচ্চার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো।
ভদ্রমহিলা ভাবনার নেম ট্রেন ছেড়ে দিল রেখা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তাকে স্পর্শ করে যে সুখানুভুতি তার অনুরণনে জেগে উঠেছিল তা কিছুতেই ভুলতে পারছে না ।আজ রেখার একটি সন্তান থাকতে পারতো  হৃদয় কাঁদে একটি সন্তানের জন্য ।কখনো দুই হাতে ছোট ছোট আঙ্গুলের স্পর্শ করে আমাকে আদর করবে আধো আধো কথা বলবে এই অনুভূতিগুলো স্বর্গীয় অনুভূতি রেখার জীবনে সেটা কোনদিনও পূর্ণতা পাবে না ,ভাবতেই রেখার দুচোখ জলে ভরে উঠলো।
অথচ রেখা মনোজের দাম্পত্য জীবনে হঠাৎই কেন এরকম ছন্দপতনের মতো ঘটনা ঘটতে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন তাদের সম্পর্কের ভেতরে একটা মরচে ধরেছে কিন্তু রেখা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সম্পর্কটাকে ধুয়ে-মুছে ঝকঝকে করে নিতে কোনো অবস্থাতেই যাতে ভেঙে না যায়। তাই মাঝে মাঝে ভাবে একটু চেষ্টা করলে কি তাদের দাম্পত্য জীবন টা মধুর হতো না ?আসতো কিনা  একটি টুকটুকে, ফুটফুটে ছোট্ট অতিথিরহাতছানি? ভরে যেত কিনা অপূর্ব স্বর্গীয় সুখানুভূতিতে? চলে যেত কিনা তাদের দাম্পত্যের  টানাপোড়েন? এই ভাবনাগুলো ভাবতে ভাবতেই হাঁটতে থাকে অটো স্ট্যান্ডের দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much