শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৫৩)
শামীমা আহমেদ
ওপ্রান্ত থেকে রিশতিনার স্বর ভেসে এলো
---শিহাব তুমি কি আজ আসবে না?আমি তোমার অপেক্ষায়।
----আমিতো আসার কোন প্রয়োজন দেখছিনা।কেন অযথা অপেক্ষা করছো?
---তাহলে তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে?
---যেটা দুস্প্রাপ্য সেটার আশা ছেড়ে দেয়াই ভালো।আর তুমিতো জানো আমি খুব গোছানো একজন মানুষ।
---হ্যাঁ,সে আমি জানি আর এও বুঝতে পারছি,তোমার জীবনে এমন কারো আগমন ঘটেছে যে তোমায় এতটা শান্ত রেখেছে।
---তোমার জীবনও নিশ্চয়ই শূন্য হয়ে রয়নি?আর আমার জীবনে যাই ঘটুক,আমার সন্তান আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান!
সন্তানের কথা বলাতেই রিশতিনা যেন আরো কিছু জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলো!
আমাদের ছেলে দেখতে কার মতো হয়েছে?
কি নাম রেখেছো তোমরা?
শিহাব খুবই বিরক্তভরা স্বরে উত্তর দিলো,
আচ্ছা রিশতিনা,আমি এখন রাখবো। অনেক কাজ পড়ে আছে।বাই।
রিশতিনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শিহাব দ্রুতই কল কেটে দিলো।
রিশতিনা একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো
শিহাব তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে।অথচ তার জন্য কতইনা ভালোবাসার প্রকাশ ছিল একসময়! অবশ্য এতটা ভালবাসার সঠিক মূল্যায়ন সে করতে পারেনি।পরক্ষণেই রিশতিনা ভাবলো,আমিওতো কম বড় রিস্ক নেইনি।সেই আঠারো বছরের একটি মেয়ে কতটা সাহসিকতা আর বিশ্বাসের উপর ভর করে একজনের হাত ধরতে পারে।তার জন্য বাবা মাকে ত্যাগ করতে পারে।তবে সবই নিয়তি!
সব কিছুই আজ অতীতের। ব্যরিস্টার বাবার প্রবল চাপে,জীবনে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে তাকে বাবা মায়ের করায়ত্ত্ব হতে হয়।নিজের সন্তানকে ফেলে যেতে হয়।এত বছর চোখের দেখাটাও হয়নি। বাবা মায়ের ইচ্ছা পূরনে রিশতিনা ইংল্যান্ডে এল এল বি,এল এল এম কমপ্লিট করেছে। এখন ব্যরিস্টারি ডিগ্রির জন্য বাকী জীবন ন্যস্ত করতে হবে।দূর প্রবাসেও বাবা মায়ের তীক্ষ্ণ নজরিদারির মধ্যে রিশতিনার দিন কাটে।একরকম বন্দী দশায় জীবন কাটানো। ছকে বাধা চলমান জীবনে হঠাৎই একদিন রিশতিনার বাবার কোলন ক্যান্সার ধরা পরে।একেবারে খুবই অল্প সময় চিকিৎসার সুযোগ রেখে তা সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বাবার মৃত্যুকে খুব সহসা খুব কাছ থেকেই দেখলো রিশতিনা৷ তিনদিন আগে বাবার মৃতদেহ নিয়ে দেশে ফিরেছে রিশতিনা।কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে তার দাফন সম্পন্ন হয়।আজ চার বছর পর রিশতিনা দেশে এলো তবে বাবার মরদেহ নিয়ে। কোথায় গেলো আজ সেই দম্ভ আর দাপট! সবই একদিন ফুরায়।মাঝে কেবল কিছু জীবনকে তছনছ করে দেয়া।রিশতিনা বাবামায়ের একমাত্র সন্তান তাকেই সব দেখতে হচ্ছে। মাকে নিয়ে ওরা গুলশানের নতুন বাসায় উঠেছে।ঝিগাতলার বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। রিশতিনার সন্তানকে শিহাবদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে জাঁদরেল ব্যরিস্টার সাহেব স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে লন্ডন প্রবাসী হয়ে যান।রিশতিনার মনে আজ একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। পিতামাতার কাছে উচ্চশিক্ষা আর জীবনে স্ট্যাবলিস্টড হওয়া কি সন্তানদের আবেগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? অবশ্য
সন্তানকে লালন পালন করে তাদের কাছে পিতামাতার কিছু চাওয়া থাকতেই পারে সেটা কোন অন্যায় কিছু নয় কিন্তু কেন তবে আবেগ এসে সব কিছুকে ওলোট পালোট করে দেয়? রিশতিনা আজো এই দ্বিধা দ্বন্দের কোন উত্তর খুঁজে পায়না। রিশতিনার মায়ের জীবনে তার বাবার ভীষণরকম প্রভাব আর মাও তাতে একেবারেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এটা অভ্যস্ত হওয়া নয় এটা একপ্রকারের বশ্যতা।কিন্তু রিশতিনার জীবনে যতটুকু সময়ই সে শিহাবকে পেয়েছে শিহাব সবকিছুর সিদ্ধান্ত রিশতিনার উপরই ছেড়ে দিয়েছিল।রিশতিনার প্রথম প্রেম শিহাব।শিহাবকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব নয়। এত বছরেও শিহাবকে সে এক মূহুর্তের জন্য মন থেকে সরাতে পারেনি।
শিহাবের প্রস্তাবে রাহাত বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো।আপুকে শিহাব ভাইয়া তাদের জিগাতলার বাসায় নিয়ে যেতে চাইছেন। এতে তার সম্মতি থাকলেও মায়ের অনুমতিটা তো নিতে হবে।আর এক্ষেত্রে মাকে এখন পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানানোর সময় হয়েছে।তাছাড়া মাকে তো সব জানতেই হবে। রাহাত অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে মায়ের ঘরে চলে এলো।মা একটু অবাক হলেও বুঝতে পারলো রাহাত কিছু বলতে চাইছে। রাহাতের আগমন, শায়লার লুকোচুরি, রুহি খালার কানাডার খবর নিয়ে আসা, বড় জামাই নোমান সাহেবের দেশে আসা সবকিছুই মায়ের কাছে নান্সন প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আর সেদিন শিহাব নামটিও শুনেছে।যদিও তার সন্তানদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। রাহাত ,শায়লা ও শিহাবের ব্যাপারে মাকে একেবারে আদ্যোপান্ত সব খুলে বললো।একেবারে ওদের পরিচয় থেকে শুরু করে শিহাবের চার বছরের ছেলে আরাফ পর্যন্ত! সব শুনে মা ভীষণ আতংকিত হয়ে উঠলো! একদিকে মেয়ের মনের চাওয়া আরেকদিকে নিচতলার রুহি খালার কাছে তার এতদিনের মাথা উঁচু করে চলা শত সাহায্য নিলেও সম্মানের সাথে তা গ্রহন করা আজ যেন সবই ধুলায় মিশে গেলো।বিবাহিত মেয়ে অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া এতো একরকম ব্যভিচার! রাহাত মাকে ধীরে ধীরে সব বুঝালো।দিনে দিনে এই পরিবারের জন্য আপার কত স্যাক্রিফাইস, সেটার কতটুকু মূল্য আমরা দিয়েছি।কোন কিছু না ভেবেই রুহি খালার কথামতো আপুর চেয়ে অনেক বয়সের ব্যবধানের একজনকে আপুর জীবনসঙ্গী করেছি।আপুর মন মতামত কিছুই জস্নতে চাইনি।রাহাত মাকে বুঝালো আপুর সারাজীবন এখনো পরে আছে।বিবাহিত জীবনে আপু অসুখী হউক সে স্মরা চাইনা মা।তাহলে আমার এত শিক্ষা,চাকরী সম্মান অর্জন সবই বৃথা হবে।
মা যেন কিছুটা বুঝের মধ্যে এলো।
অস্ফুট স্বরে কেবল বললো,নোমান সাহেব কি এটা মানবেন?
দেখা যাক কি করা যায় মা।আপা তাকে ডিভোর্স দিবেন। তার দুটো সন্তান আছে এই তথ্য গোপন করার অভিযোগে। প্রয়োজনে আমরা আইনের আশ্রয় নেবো মা।আপুকে অমন দূরদেশে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় আমাদের ঘুম হবে না মা।তুমি রুহি খালাকে আমাদের এইসব কথা কিছুই জানাবে না। রাহাতের সরলমনা মা,তক্ষুনি দুহাত উপরে তুলে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইলেন আর এইসব জটিলতার সুষ্ঠু সমাধান চাইলেন।
শায়লা শিহাবদের জিগাতলার বাসায় যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
একটু আড়ষ্ট লাগছে।কিন্তু শিহাব অভয় দিয়েছে। তাছাড়া আরাফকে দেখতে ভীষণ মন চাইছে।রাহাতের আজ অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরি হচ্ছে।হয়তো অনেক কাজের চাপ পড়েছে।কিন্তু আজ আর কোনকিছু ফোন করে জানায়নি।রাত সাড়ে নয়টা বাজতে চললো। শিহাবের সাথেও আজ সারাদিন কোন কথ্য হলো না।সেই সকালে মেসেজ রেখে গেছে।যাক হয়তো ব্যস্ততা বেড়েছে। খুব শীঘ্রই হয়তো শায়লার জীবনে বিরাট একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। শি্ব এই বিষয়টিতে বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠেছে।আসলে একাকীত্ব এক সময় অসহ্য হয়ে উঠে।মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে তখন নিজ থেকেই স্বস্তি খুঁজে ফেরে।যেই শিহাব পরিচয়ের শুরুতে কিছু অলখিত শর্তে শায়লার সাথে দেখা দিয়েছিল আজ সেই শর্ত যে কোথায় ভেসে গেলো! শিহাব শায়লার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে।শায়লার এক বোবাপ্রাণীর মত দিন কাটাতো।বিয়ের পর নোমান সাহেব কল দিলে শায়লা কি কথা বলবে কোন কথাই খুঁজে পেতো না আর নোমান সাহেব বাংলায় কথা বলায় অতটা স্বচ্ছন্দ ছিল না। দীর্ঘ দিন বিদেশ জীবনে বাংলা বলা প্রায় ভুলেই গেছে। ভাষার বাধা থাকলে মনের ভাব কি আর প্রকাশ করা যায়? তাছাড়া নোমান সাহেবের তো শায়লার মন বুঝার প্রয়োজন নেই, তার বাচ্চাদের দেখভালের জন্য শায়লাকে প্রয়োজন। শিহাব আর নোমান সাহেবের মাঝে এতটাই পার্থক্য যে শায়লা বুঝে উঠতেভপারেবনা কেন বা কি ভেবে তার মা ভাই তাকে এই বিয়েটায় সম্মতি দিলো?
দরজায় কলিংবেল হলো।শায়লার এলোমেলো ভাবনায় ছেদ পড়লো।ডাইংএর ঘড়িতে রাত দশটা।বেশ রাত হয়েছে।মাকেও খাবার দিতে হবে। আজ বেশিই দেরি হয়ে গেলো। রাহাত বেশ হাসিমুখে বাসায় ঢুকলো আর শায়লার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিতে লাগলো।হাতের ব্যাগটা রেখে শায়লার দুই হাত ধরে আনন্দে দুলতেব্লাগলো! শুধু নাচতে বাকী।মা আর শায়লা রাহাতেরভেই কর্মকাণ্ড দেখে হেসে কুটিকুটি। কি হলো? কি হয়েছে বলবি তো? কি প্রমোশন হয়েছে? শায়লার জিজ্ঞাসায় রাহাত বলে উঠলো হু তবে তার চেয়েও বেশি কিছু!
মা আর শায়লা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।এবার মা এক কড়া ধমক লাগালো,বলবিতো কি হয়েছে? অমন ব্যাঙের মত লাফাচ্ছিস কেনো?
এবার রাহাত হুশে এলো! বললো,জানো আপু এতক্ষন কার সাথে ছিলাম আমি?
এতক্ষন শিহাব ভাইয়ার সাথে ছিলাম।প্রায় দুই ঘন্টা।অফিসের গাড়ি থেকে এইতো আর্টিসানের উপরে রেস্টুরেন্টটায় বসে কথা বললাম।ওখানে টেবিল টপে শিহাব ভাইয়া যেতে বলেছিল।কফি আর ডেসার্ট খাওয়ালো।আরো অনেককিছু খাওয়াতে চাইলো। আমি রাজী হইনি।আপু শিহাব ভাইয়া দারুন করে কথা বলে।খুবই মন খোলা প্রাণ খোলা মানুষ। আজকের দেখা কিন্তু মনে হলো অনেকদিনের চেনা।অনেক আপন হয়ে গেলো খুব তাড়াতাড়ি।তার বাইকে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিলো।আসলেও আপু, শিহাব ভাইয়াতো সত্যিই একটা হিরো!! রাহাতের কথায় শায়লা খুবই লজ্জা পাচ্ছিল।মা দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনে ঘরে চলে গেলো।ভাইবোনের এই সব কান্ডকারখানায় মা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো।
রাহাত একটু স্বাভাবিকে ফিরে এলো। শান্ত হয়ে বললো, আপু,খাবার দাও।আমি একটু শাওয়ার নিয়ে আসছি। কাল সকাল দশটায় শিহাব ভাইয়া তোমাকে নিয়ে জিগাতলার বাসায় যাবে।তুমি তৈরি থেকো।শায়লার মনের ভেতর এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো! বারবার শিহাবের মুখটা মনের মাঝে শায়লার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে।শায়লা রান্নাঘরে খাবার আনতে এগিয়ে গেলো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much