১৬ জানুয়ারী ২০২২

মমতা রায় চৌধুরী/৯১





উপন্যাস 


টানাপোড়েন ৯১

অবচেতনে  দাগ 

মমতা রায় চৌধুরী





সকাল থেকে নদীর মেজাজটা খাট্টা হয়েছিল। 
আজকের দিনটা কি সকলেই বেমালুম ভুলে গেল?
বাপি মারা যাবার পর থেকেই সবকিছুই যেন কেমন হয়ে গেছে তার জীবনে। মা ও তার কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। নদীর কি প্রয়োজন,কি পছন্দ-অপছন্দ
কিছুতেই এসে যায় না ।
মা আজকাল শুধু অফিস আর অফিস। আগের দিনগুলো কত ভালো ছিল ।মায়ের গন্ধ সারা দিনরাত মেখে থাকতো । আজকাল মায়ের গন্ধ
মনে করতে সময় লাগে। কত জ্বরের ঘোরে ভুল  বকেছে, মাকে কাছে পায় নি। অথচ একটা সময় ছিল বৃষ্টির দিনগুলোতে মায়ের কাজ ছাড়া হত না ।শীতের  রাতগুলোতে মায়ের গায়ে গা দিয়ে না শুলে যেন নদীর কিছুতেই ঠান্ডা কাটতো 
না ।আজ কোথায় গেল সেই সব দিনগুলো ?
বাপি অফিস থেকে এসেই প্রথমে নদীর খোঁজ করত ।আজ খোঁজ করার জন্য ঝরনা মাসি। নদীর কাছে আসে ঝরনা মাসি ।এসে জিজ্ঞেস করে   'আর কি লাগবে, না লাগবে? কিন্তু ঝর্ণা মাসির ক্ষমতা কতটুকু তার দাবি মেটানোর? বিশাল সমুদ্রে এক ফোটা জল।'
সারাদিন এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে নদী। সে তো 18 বছরে পা দিয়েছে । তার স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই আছে ।সেও তো চায় শীতের রোদ্দুরে গায়ে তাপ নিতে। সেও চায় এরকম নীল আকাশ ,সোনালী রোদ্দুর, তার মনে ভেতরে দাগ কেটে যাক।
হঠাৎই সে ট্রামে চেপে বসে। আজ ভালো একটা নীল লং গ্রাউন্ পড়েছে। যদিও নদীকে ড্রেসটা ওর মা গিফট করেছে।
নদী সদ্য কলেজে গেছে। কলেজে অনেক বন্ধু হয়েছে কিন্তু শৈশবের বন্ধুগুলো যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।কালেভদ্রে দেখা হয় তিন্নি তৃষার সাথে। ওই হাই, হ্যালো এইটুকু।
তারমধ্যে তো তৃষা চলে গেছে ব্যারাকপুরে ওদের নিজেদের ফ্ল্যাটে ।আজকাল তৃষা ফোনও করে না। এসব কথা ভাবছে বসে বসে এর মধ্যেই তার নজরে আসে,শুধু সদ্য যুবকেরা নয, বয়সী লোক গুলো যেন নদীকে গোগ্রাসে গিলতে চাইছে। অথচ এরাই কখনো দেখা যায় যে কোনো বাড়িতে গেলে কত ভদ্রভাবে কথা বলে কিন্তু ট্রামে বাসে ওদের দৃষ্টিও নেকড়ের ছোবলের থেকেও ভয়ঙ্কর।
হঠাৎ একটি পুরুষ কন্ঠ নদীকে ডাকে"অ্যাই স্বরূপা, স্বরূপা, স্বরূপা।'
নদী প্রথমে ভাবতে পারে নি যে ,তাকে কেউ ডাকছে। ট্রামে  এমন কে আছে যে তাকে
 ডাকবে ?তাই প্রথমে গা করে নি
পরে এক ভদ্র মহিলা বললেন "'এই মেয়ে তোমাকে কেউ ডাকছে?"
নদী পেছনটা ঘুরে তাকায় দেখে' অরুনাভদা।'
অরুনাভ ও আরেকটু এগিয়ে  কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে' কোথায় যাচ্ছ?'
নদী প্রথমত তার নামটা মনে হচ্ছিল ভুলে যেতে ব বসেছিল । নদীর ভালো নাম ধরে কেউ ডাকছে সে যেন একটু নস্টালজিক হয়ে যায়।
তার বাবার দেয়া ভালোবেসে বাবা মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছিল নাকি?
কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে এই নামটার অস্তিত্ব ক্রমশ অবলুপ্তির পথে।
আজ নদী নামে সে বেশি খ্যাত। কিন্তু স্কুল-কলেজ সার্টিফিকেটে তো তার সেই নামটি রয়ে গেছে।
অরুণাভ কাছে এসে হাত নেড়ে বলে 'কি ব্যাপার অন্য মনস্ক ?তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম বললে না তো?'
নদী বলে 'এলোমেলো ভাবনা। ভাবলাম একটু বেরিয়ে পড়ি ।সামনে নামবো কলেজ স্ট্রিটে।'
অরুণাভ বলে  ভাবনাগুলো কিন্তু থাকা 
ভালো। জানো সব সময় মানুষ ঘড়ি দেখে অর্থাৎ টাইম মিলিয়ে জীবনটাকে যেন একটা ছকে বেঁধে রাখতে চাইছে কিন্তু ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে ও আলাদা একটা মাধুর্য আছে ,যে না বেরোবে সে কখনো উপলব্ধি করতে পারবে না।'
নদী একটু হাসে।
অরুণাভ বলে 'আজকে তুমি এত সেজেগুজে এসেছ ?কোনো 'কোন স্পেশাল ডে আছে?'
নদী বলে 'কেন শুধুমাত্র কিছু স্পেশাল দিনগুলোর জন্যই সাজতে হবে ।আমি যদি সেখানে কোন বৈচিত্র আনতে চাই, তাতে কি তোমার কোন অসুবিধা আছে?'
অরুনাভ ও হেসে বলে  'বেশ কায়দা করে উত্তর দিলে তো? গুড। আমার কোনো অসুবিধে নেই। বরং ভালো লাগবে।'
নদী একটু হাসে।
অরুণাভ বলে ' তোমার এলোমেলো ভাবনার সঙ্গে আজকে আমাকে নেবে?'
নদী কোন ভনিতা না করে বলল' না নেওয়ার কি আছে?"
অরুনাভ বলে অরুণাভ বলে তাহলে কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।'
স্বরূপা বলে ও শিওর। 
অরুনাভ বলে 'তাহলে চলো, আজ তোমার সাথে বাঁধি নানা ছন্দে।'
নদী বলে ও 'সিওর।'
আজকের বিশেষ দিনটা কি তাহলে এভাবেই বিশেষ হয়ে উঠবে ভাবতে থাকে নদী।
নদীর ধর্ম তো বয়ে চলা, গতি তার জীবন। তাকে আটকে দিলে তার ছন্দপতন ঘটে। তাই 18 বছর তার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।এইসব ভাবতে ভাবতে ট্রাম এসে দাঁড়াল কলেজ ট্রিটে।
নদী আগে হাঁটতে শুরু করল, অরুনাভ পেছনে
পেছনে।
অরুণাভ হঠাৎ বলে' এই নদী তুমি আগে আগে হেঁটে চলেছ আমি তো তোমার পেছনেই আছি।'
নদী শুধু হাসলো। তারপর তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে তার সানগ্লাসটা বের করে চোখে দিল।
নদী বললো 'একা একা হাঁটার মধ্যে একটা আলাদা মজা আছে।'
অরুনাভ বলে 'তাহলে কি সেই মজায় আমি তোমার ব্যাঘাত ঘটালাম?'
নদী এর কোন উত্তর দেয় না।
নদী মনে মনে ভাবছে 'সারা কলেজের মেয়েদের কাছে যে ছেলেটি হার্ট থ্রব। আজ তারই সঙ্গে পথ চলছে।'
আপন মনে নদী একটু হেসে উঠলো।
অরুনাভ  থমকে দাঁড়ালো। তারপর বলল' হেসে উঠলে কেন ?কিছু অড ব্যাপার ঘটল কি!'
নদী বলল ', না, না।'
হঠাৎই কফি হাউজের সামনে এসে অরুনাভ  বলল 'ঢুকবে কফি হাউসে?'
নদী কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ।এমন সময়ে নদীর ফোনে ফোন ঢুকলো। রিং হতে লাগলো। নদী ফোনটা রিসিভ করবে কি করবে না ভাবছে।
 এমন সময় অরুনাভ ও বললো 'তোমার ফোন বেজে যাচ্ছে ।দেখো ,আন্টি ফোন করল বোধহয়?'
নদী বলে 'সময় কোথায়?'
অরুনাভ ও বলল 'এভাবে বলছ কেন?'
নদী ভাবছে  'কথাগুলো কিভাবে সে অরুনাভকে বলবে ?জমানো ব্যথাকে তার অংশীদারে সামিল করবে?তাই নিজের দুঃখ নিজের কষ্টগুলো, যন্ত্রণা গুলোকে নিজের মনের ভেতরে রাখতে চায়। কথা না বাড়িয়ে ফোনটা চেক করলো।'
ফোনটা চেক করে দেখলো একটা আননোন নাম্বার।
দুটো মিসকল হয়ে আছে।
নদী ভাবছে ফোনটা কি ঘুরিয়ে করবে, না করবে না ?একটা দ্বন্দ্ব চলছে মনের ভেতরে ।
এমন সময় আবার নদীর ফোন বেজে উঠল।
নদী ফোনের নম্বরটা পরখ করে দেখলো সেভ করা আছে কিনা?'
নদী দেখলো না এই নম্বরে কোন কিছু সেভ করা নেই। তাহলে' কে এমন ফোন করছে বারবার?'
এবার ফোনটা রিসিভ করল বলল' হ্যালো'।
অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসলো 'কে স্রোতস্বিনী?'
নদী বলল হ্যাঁ। তারপর যখন তার জন্মদিনের উইশ করলো তখন সে আনন্দে লাফিয়ে 
উঠল ।আজকে সকাল থেকে কেউ তাকে উইশ করে নি ।প্রথম মাসীমণি তাকে উইশ করেছে।
'শুভ জন্মদিন ।খুব খুব ভালো থেকো আর অনেক অনেক আনন্দে থেকো।'
নদী বলল ' অনেক ধন্যবাদ মাসীমণি।'
বিপাশা বলল'তোর কি আজকে নেট অফ আছে?'
বিপাশা বলল 'তোকে মেসেজ পাঠিয়েছি।'
নদী বলল' তাই?
বিপাশা বলল'আমি ভাবলাম রাগ করেছিস?'
নদী বললো 'কেন কেন,?'
বিপাশা বলল ' মনে হয়েছে তাই বললাম।'
নদী বলল' ঠিক আছে মাসিমনি।'
নদী মনের ভেতরে অজান্তে কিভাবে কালো পাহাড় গড়ে উঠেছিল। না জেনেবুঝে এভাবে মাসি র প্রতি, মায়ের প্রতি রাগ করা উচিত হয় 
নি ।
বিপাশা বলল 'ঠিক আছে ভালো থেকো কেমন? 'নদী বলল-'হ্যাঁ মাসিমনি আমি তোমার কথা মাথায় রাখবো।'
নদী নিজের মনে অনুতপ্ত হচ্ছে মাসিকে নিয়ে অনেকটা কষ্ট পেয়েছিল ,সেটা মনের ভেতরে রেখেছে কিন্তু এই ভাবনাগুলো একদমই ঠিক হয় নি। মাসির মনের ভেতরে রয়েছে দুঃখের পাহাড় ,যন্ত্রণাগুলো যেন কুরে কুরে খাচ্ছে।
 এবার অরুণাভ বললো ' তোমার কি কোন কারনে আজকে মনটা খারাপ?'
নদী বলল 'কেন?'
হঠাৎই নদী বলল 'আজকে থাক  আজকে কফি হাউসে ঢুকবো না ।একটু বাড়ি যাব।'
অরুনাভ বলল' বাহ খুব ভালো কথা।'
নদী খুব দ্রুত পায়ে বাড়িতে আসার রাস্তা ধরল। তার জন্মদিনেl প্রথম মাসিমনি উইশ করেছে ।সেই আনন্দে রাস্তা চলতে গিয়ে মনে হচ্ছে হে হাজারো পথ অতিক্রম করে ফেলেছে।
অরুনাভর   কাছে ব্যাপারটা কেমন রহস্যজনক মনে হলো।
নদী হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির রাস্তা ধরল।
বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজাতে থাকে ঝরনা মাসি হাই তুলে দরজা খুলছে।
দেখলেই বোঝা যায় আরামে ঘুম দিচ্ছিল।
ঝর্ণা বললো' তুমি খাবে তো এসো?'
নদী বলল 'কি রান্না করেছো ?'
ঝর্ণা বললো 'অনেক কিছু রান্না হয়েছে?
আজকে যদি তোমার পছন্দের জিনিস রান্না না করি তাহলে বৌদি এসে আমাকে খুব বকবে তাই?'
নদী কেমন একটা বা অন্য ভাবনার জগতে চলে গেল ।তাহলে কি তারই মনের ভেতরে একটা আলাদা ঘুনের বাসা বেঁধেছিল। তবে কি নদীর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যেতে বসেছিল? তার অবচেতন মনে কি দাগ কেটে যাচ্ছিল, সে সেটাকে আবিষ্কারে নিমগ্ন। এবার শুধু মায়ের অপেক্ষায় থাকে। মা তার জন্যে কী সারপ্রাইজ দেয় সেটা দেখার জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much