১৬ জানুয়ারী ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী /৯২





উপন্যাস 



টানাপোড়েন ৯২

আনমনে জন্মদিন

মমতা রায়চৌধুরী




নদীর মন খারাপের জানালাগুলো একে একে বন্ধ করে দিতে লাগল ।কারণ ক্ষনেকের খুশি ভালোবাসা তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো । বিপাশা মাসিমনিকে নিয়ে কি ভুল ধারণাটা রেখেছিল সে।
অথচ  তুলনা হয় না মাসিমনির। একটা কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিপাশা মাসিমনি। মেসোমশাই তো একজন ঠক, প্রতারক , দুটো পুত্র সন্তান তার ভবিষ্যৎ কি হবে ? হাজারো চিন্তা মাসিমনির ।মনের ভেতরে রয়েছে দুঃখ-যন্ত্রণা, দুঃখ কষ্টগুলোকে যেন সে পাথর চাপা দিয়ে আছে, একেবারে হিমশীতল।
তাই কথা না বাড়িয়ে ঝরনা মাসি যখন বলল 'মামনি খেয়ে নেবে এস ?'
তখন শুধু নদী ওইটুকুই বলল ''ঠিক আছে তুমি খাবার টেবিলে আমাকে খাবার দাও।  আমি যাচ্ছি।'
নদী ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে খাবার টেবিলে বসল।
 খাবার টেবিলে বসে নদী জিজ্ঞাসা করল  'কি রান্না করেছ ঝরনা মাসি ? পায়েসের গন্ধ পেয়ে বলল 'মাসি পায়েস করেছ?'
ঝরনা মাসি বলল' তা করবো না। আজকে যে তোমার জন্মদিন মামনি।'

নদীর চোখে জল আসে ।'তোমাদের মনে আছে আজকে আমার জন্মদিন ।বাপি থাকলে রাত বারোটার সময় থেকেই শুরু হয়ে যেত হৈ-হুল্লোড় এখন তো আর বাপি….।'
ঝরনা বলে 'মন খারাপ করছো কেন 
মামনি ?তোমার মা সব আয়োজন করেছে। শুধু মায়ের আজকে বিশেষ কাজ না থাকলে বের হত না ।তাই আমাকে আগে একটু পায়েস খাইয়ে দিতে বলেছে। পরে মা আবার এসে তোমাকে পায়েস খাওয়াবে ।কাজেই দুঃখ ক"রো না।'
নদী হা  করে ঝরনার দিকে তাকিয়ে থাকে ।
তারপর আনমনে বলে' মা বলেছে তোমায়?'
ঝরনা বলে 'কালকেই তো বৌদি আমাকে বলল সব কিছু করে রাখবে কিন্তু ঠিকঠাক করে । পায়েস তো তোমার মায়ের হাতের করা।'
নদী ঝর্ণাকে  প্রণাম করে।
ঝরনা নদীকে কাছে টেনে আদর করে আশীর্বাদ করে আর বলে 'মাকে ভুল বুঝ না '।

নদী কথা না বাড়িয়ে যেটুকু পায়েস দিয়েছে সেই পায়েস এর ভেতর দিয়ে খুঁজে বেড়াতে থাকলো মায়ের গন্ধ ।সেই ছোটবেলায় মা কি সুন্দর
 নদীকে আদর করে, আশীর্বাদ করে পায়েস খাইয়ে দিত ।সেই কল্পনায় সুন্দর ছবিটাকে  মনের ক্যানভাসে আনমনে দাগ কাটতে থাকে। তারপর এক নিমিষে পায়েস   শেষ করে দেয়।
ঝরনা বলে 'মামনি তাহলে এবার তোমার খাবারগুলো দিই? '
নদী  পেটে হাত দিয়ে বলে' ' আর পারবো 
 না ।আমাকে ক্ষমা করো ।আমি একটু পরে খাব মা কখন আসবে গো?'
ঝরনা বলে 'ঠিক আছে তুমি পরেই খেয়ো।'
আর বৌদির তো আজকে তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা ।তুমি তো জানো যে অফিসে কখন কি কাজ পড়ে যায়, ইচ্ছে থাকলেও তো বৌদি সবসময় বেরুতে পারে না, না?'
নদী ঘাড় নাড়ে শুধু। তারপর বলে 'পায়েসটা খুব ভালো হয়েছে মাসি।'
ঝরনা বলে 'বৌদি তো খুব ভালো রান্না করে। পায়েস তো ভালো হবেই ।তারপর তোমার জন্মদিন বলে কথা?'
ঝরনা নদীর সাথে কথা বলে এঁটো বাসনগুলো টেবিল থেকে তুলতে থাকে ,তারপর নাতা দিয়ে টেবিল মুছে নিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে ।রান্না ঘরে জিনিসপত্র গোছাতে থাকে ।হঠাৎ করে রান্নাঘরে একটা ডিস পড়ে যাবার আওয়াজ শোনা
 গেল ।কিছু ভাঙলো কিনা কে জানে?
নদী আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে মন ভালো করার জায়গায় চলে যায় অর্থাৎ ছাদে। সেখানে গিয়ে আলসেতে দাঁড়িয়ে মনের ক্যানভাসে দাগ কাটতে থাকে ।বাল্যকালের স্মৃতিগুলো ,শৈশবের নানা কথা ভিড় জমাতে থাকে। নদী তখনও পর্যন্ত জানে না তার জন্য কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। আফসোস করছে তার মাকে নিয়ে অ্যাতো বড় ভাবনা তার মনে জায়গা না দিলেই হত। এটা তো ঠিকই মায়ের একটা আলাদা জগত আছে। হঠাৎ নদীর ফোনে ফোন আছে।
নদীর ভালো লাগে না এই সময় ফোনটা রিসিভ করতে সে একান্তমনে শুধু নিজের কথাই ভাবতে চাইছে। 
শীতের কুয়াশা সরিয়ে সূর্যের মিঠে রোদ সারা আকাশ জুড়ে, তাই উষ্ণতাটুকু নদীর জীবনেও খুব দরকার। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল করলো তীর্থ।
নদী ভাবল' আরে পার্কের ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছে তীর্থ। এই সময় ওর এখানে কি কাজ?' একটু কেমন নদীর কৌতুহল হলো ব্যাপারটা দেখতে হয়। 
স্কুল লাইফের বন্ধু। 
কলেজের বন্ধু গুলোর থেকে অনেক আলাদা হয়। স্কুলের বন্ধুরা কলেজ লাইফের বন্ধুর ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। কি যেন একটা নিষেধের কাঁটাতারের বেড়া। যখন খুশি উপড়ে দিতে চায়। আর তীর্থ মনের দিক থেকে খুবই একাকী। ছোটবেলায় মা মারা গেছে।বাবা  আবার বিয়ে করেছে। সৎ মায়ের কাছে আরশোলার মত জীবন। হয়তো মনের সেই কষ্টগুলোকে ভোলার জন্য মাঝে মাঝে প্রকৃতির কোলে নিজেকে ধরা দিতে চায় নানাভাবে নানা খেয়ালে। হয়তো কিছু কিছু সময় ওর খেয়ালিপনা গুলোকে পাগলামো মনে হতে পারে কিন্তু সত্যিই যদি খুব গভীর অনুভূতি দিয়ে ভাবা যায় তাহলে দেখা যাবে তীর্থ এখান থেকেই তার একাকিত্বের জীবন থেকে মুক্তি পাবার রসদ খুঁজে বেড়ায়।
নদী ছাদের থেকে ডাকল' অ্যাই তীর্থ ,তীর্থ,তীর্থ।'
নদীর কথা কিছু শুনতেই পারছে না  তীর্থ।
এমন সময় নদীর ফোনে ফোন আসে।,'রিং হতে থাকে।
'নদী এবার ফোনটাকে রিসিভ করে বলে 'হ্যালো'।
রুপসা বলে 'শুভ জন্মদিন মামনি অনেক অনেক ভালো থেকো সুস্থ থেকো আর তোমার মনের আশা পূর্ণ হোক। 
'নদী শুধু বলল থ্যাংক ইউ মামনি:
রুপসা বলে' খাবার খেয়েছো?'
নদী বলে' হ্যাঁ ,খেয়েছি পায়েস।'
রুপসা বলে 'আর কিছু খাও নি কেনো?'
নদী বলে' খিদে নেই।'
রুপসা বলে 'খিদে নেই কেন?'
নদী বলে 'অনেকটা পায়েস খেয়েছি । পায়েসটা খুব ভালো হয়েছে থ্যাংক ইউ মা।'
রুপসা বলল 'যাও নিচে যাও?¡ বাকি খাবারগুলো খাও ।,
নদী বলে' তুমি কখন আসবে?'
রুপসা বলল 'চেষ্টা করছি সন্ধ্যের মধ্যে ফেরবার।'
নদী বললো 'সাবধানে।'
রুপসা বলল' তোমার গিফট পছন্দ হয়েছে?'
নদী বলল 'না দেখা হয়নি।
  রুপসা বললো' ঠিক আছে, পরে দেখে নিও । 'তাহলে এখন ছাড়ছি কেমন মন খারাপ ক'রো না।'
নদীর মনটা যেন হঠাৎ করেই ফুরফুরে হয়ে গেল। তাই সে তরতর করে সে  নিচে নেমে আসলো। তার মা তার জন্য কি এনেছে? সরাসরি নিজের রুমে ঢুকে গেল। দেখল একটা কার্ডে খুব সুন্দর করে নিজের মনের কথা  প্রকাশ করেছে।
তারপর পি সি চন্দ্র জুয়েলার্সের প্যাকট। কৌতুহলী হয়ে বৃষ্টি খুলে ফেলল একটা খুব সুন্দর কানের দুল।।
নদী খুব খুশি হলো। তার মাকে কি একটা ফোন করবে?
মায়ের সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আবার মনের ভেতরে একটা কিন্তু কিন্তু ।রয়েছে।
সব কিন্তুর অবসান ঘটিয়ে মা কে ফোন করল। মায়ের ফোন বাজতেই ফোনটা রিসিভ করে বলল হ্যালো'।
নদী বলল 'আমি বলছি।'
রুপসা বলল' হ্যাঁ বল কি হয়েছে?'
নদী বলল'গিফটটা খুব সুন্দর হয়েছে।'
রুপসা বলল' তোমার পছন্দ হয়েছে তো মামনি?'
নদী বলল' হ্যাঁ।'
 রুপসা বলল 'ঠিক আছে রাখি এখন।'
নদী বলল ok
নদীর মনে কিছু কিছু দৃশ্য চিরদিনের মতো আঁকা হয়ে গেছে দাঁতে দাঁত চেপে ভুলতে চাইলেও যেন ভুলতে দিতে চাইছে না তার বারবার মনে হচ্ছে  মাকে নিয়ে এত কথা না বললেই পারতো ।মা আছে বলেই তার অস্তিত্ব। আসলেই ইদানিং মায়ের হঠাৎ হঠাৎ অফিসে বেরিয়ে যাওয়াটাই একদমই পছন্দ করছিল না অনেকে নানা রকম কথা ও বলছিল । সেই থেকে মানে মায়ের সঙ্গে একটা মনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। মা তাকে বেশি সময় দিতে পারছিল না।
নদীর মনে হতে লাগল এভাবেই তার এতটা মায়ের সঙ্গে  দূরত্ব সৃষ্টি হলো। আসলে কিছু কিছু সম্পর্ক দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে মরচে ধরিয়ে দেয়।'


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much