উপন্যাস
টানাপোড়েন ৯৩
ধূসর স্বপ্ন
মমতা রায় চৌধুরী
সারা সন্ধ্যে তো নদীর একটা উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে কাটলো। মায়ের জন্য ভালোবাসা ,মায়ের গন্ধ বারবার চোখে মুখে মেখে নেওয়া, মায়ের দেওয়া জিনিসগুলো বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দেখা ।আজ শুধু তার হৃদয়াকাশে শুধু মা আর
মা । কখন মা আসবে? কেন মাকে এত ভুল বুঝেছে সে? এসব ভাবতে ভাবতেই সে বারবার ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকি মারছে ।মায়ের গলা শুনতে পাবে বলে কিংবা যে গাড়ি এসে মাকে ছেড়ে দিয়ে যাবে ,সেই শব্দটা শোনার জন্য ইচ্ছে করছে। মা যখন আসবে মাকে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে । অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর,আবার ধীরগতিতে ঘরে এসে ওয়ারড্রবটা খুলে মায়ের দেয়া সেই দুলটি পরছে ।
অনেকদিন আগে নদী বলেছিল ' তার একটা ইউনিক ডিজাইন এর দুল চাই?'
আর তার এইটিন ইয়ার্সএ প্রথম গিফট ,তার ভালোলাগার গিফট ,তার মা তাকে দিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন কেমন একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এসেছে ।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে নদীর সেই ছেলেবেলার মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া নেতারহাট। আবছা ভাবে মনে আছে নেতারহাট এর সেই উঁচু উঁচু গাছগুলো যেন নীল আকাশ ছুঁতে
চাইছে ,চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ উপত্যাকা , সবুজের বন্যা।তার মধ্যে রয়েছে টলটলে জলের হ্রদ। তার বাপি তাকে ডাকছে 'মামনি ,মামনি, দেখ এই জায়গাটা কত সুন্দর। আয় আয় আমার কাছে আয়।'
বাবা দুই হাত বাড়িয়ে ডাকছে। নদী ও বাবার কাছে যাবার জন্য ছুটছে ,এই করতে করতে তার ঘুম ভেঙে গেছে। সে দেখছে, সে আছে বেলেঘাটার কাছে দেশবন্ধু পার্কের সেই ফ্ল্যাটে।
কতদিন বাপিকে দেখে নি। বাপির সঙ্গে কথা বলে নি ।বাপিকে কাছে পেতে চাইলেও বাপিকে ছুঁতে চাইলেও আর সেভাবে বাপিকে পায় না ।
'কেন এত তাড়াতাড়ি বাপিকে তারাদের দেশে চলে যেতে হলো? 'দুই চোখ জলে ভরে উঠলো।
মনটা কিছুক্ষণের জন্য বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে
গেল ।এর মধ্যেই গেটের বাইরে গাড়ির হর্ন পাওয়া গেল। যদিও ওই মাঠে অনেক গাড়ি এখানে পার্কিং হয় ।তবুও মা যে গাড়িতে আসে, সে গাড়ির আওয়াজটা যেন একটু
অন্যরকম ।নদী তার উপলব্ধিতে বুঝেছে। অন্তত তার কাছে তাই মনে হয়। তাই সে ছুটে যায় ব্যালকনিতে, গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।
'হ্যাঁ ,সত্যি গাড়ি থেকে তার মা নামছে।
তার মা এখনো কত সুন্দরী।'
মায়ের মত রঙ টা যদি নদীর হতো, মায়ের মত চুল, মায়ের মত চোখ।
সব বন্ধুদের কাছে শুনেছে নদীর মা সুন্দরী।
বন্ধুদের কাছে শোনা প্রশংসাসূচক বাক্য তার মায়ের জন্য তার গর্ব বোধ হতো। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। বাপি মারা যাবার পর সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেল।
এর মধ্যে ফোন বেজে উঠলো'রিংটোনে' আয় খুকু আয়,,..।,'
নদী জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল ছুটে এসে ফোনটা রিসিভ করতে গেল। সে স্বগোক্তিতে বলল 'ঠিক মামনি ফোন করেছে?'
সো উচ্ছ্বসিত ভাবে নামটা খেয়াল না করেই বললো" হ্যালো' মামনি'।
অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসলো' না রে ,আমি মাসিমনি বলছি স্রোতস্বিনী সোনা।"
নদীর স্রোতস্বিনী নামটা মাসিমনির দেওয়া।
নদী বলল' হ্যাঁ , মাসিমনি বলো।'
বিপাশা বলল'তোর ভাইয়েরা তোকে উইশ করবে?'
নদী বলল 'দাও না।
টুবলু টুকাইকে বিপাশা ডাকছে' আয় ,আয় ,আয়। দিদি ভাইকে উইশ করবি আয়।'
টুবলু টুকাই একসঙ্গে বলল। ' হ্যাপি বার্থডে দিদিভাই।'
নদী বলল' থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।'
টুবলু বলল' দিদিভাই ,আজকে কি কি রান্না হয়েছে?'
নদী বললো 'বলবো কেন? তোরা আসিস নি কেন?'
টুকাই বলল 'দিদিভাই ,মা তো নিয়ে গেল না?'
টুবলু বলল' এই ভাই,মিথ্যা কথা বলছিস কেন?
তোর তো অ্যাক্টিভিটি টাস্ক জমা দেবার ছিল বল?'
টুকাই ঢোঁক গিলে বলল' হ্যাঁ, দিদিভাই, অ্যাক্টিভিটি টাস্ক ও জমা দেবার ছিল?'
তখন নদী হেসে ফেললো
'তা বেশ তোরা কবে আসবি?'
কিছুক্ষণের জন্য তারা চুপ করে গেল। যেন মনে হলো দুই ভাই নিজেদের সঙ্গে চোখে চোখে কথা বলে নিল। তারপর বললো ,'দেখি কবে যাওয়া যায়?'
এবার টুকাই বলল 'এবার বলো না দিদিভাই, কি রান্না করেছে মাসিমনি,?'
নদী বলল ', আমি জানি না ।কী করে জানব? আমি কি খেয়েছি? কি রান্না হয়েছে বলবো। তবে আমি প্রথম খেয়েছি পায়েস ।সেটা মামনি করে গেছে ।অপূর্ব হয়েছে, অপূর্ব ।কি মিস করছিলাম ভাই তোদের জন্য।'
টুকাই একটু চুপ থাকলো তারপর বললো 'ও আর কি রান্না হয়েছে সেটাই জানো না?'
টুবলু বলল'কেন দিদিভাই তুমি খাওনি?'
নদী বলল হ্যাঁরে সেজন্যই তো জানি না শুধু পায়েস খেয়েছি।'
টুকাই বলল' ও ও ও।'
বিপাশা বলল 'নে অনেক হয়েছে, তোদের
কথা ।এবার আমাকে একটু ফোন টা ছাড় তো?'
দুই ভাই মাকে ফোনটা দিয়ে দুজনেই একে ওকে ডেকে চলে গেল মাঠে খেলতে।
বিপাশা বলল 'হ্যাঁরে দিদি ফেরেনি?
নদী বললো ' না মাসিমনি।'
'সে কিরে ও কি এই সময়ে অফিস থাকে?'
নদী বলল' হ্যাঁ মাসিমনি কোন কোন দিন দেরিতে আসে।'
বিপাশা বলল 'ঠিক আছে, মা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে ।তুমি চিন্তা ক'রো না কেমন ।ভালো থেকো আর তোমার জন্য একটা গিফট আছে। পরে পাঠিয়ে দেবো। অনেক আদর আর ভালোবাসা থাকলো। ভালো থেকো।'
নদী বললো' তুমিও ভালো থেকো মসিমনি।'
কথা বলতে বলতে রাত আটটা বাজে। নদী ভাবছে মা এখনো আসলো না আজ আমার জন্মদিন। এরইমধ্যে ঝরনা মাসি এসে ডাকছে মামনি মামনি মামনি এসো সেই একটু পায়েস খেয়েছো কিছু খেয়ে নাও বৌদি কিন্তু আমাকে এসে বকবে?
নদী বলল না মা আসুক তারপরে খাব।
ঝর্ণা বললো না বাবা-মা আসলে আবার কেউ একটু খেয়ে যাও।
নদী বলে আমায় ক্ষমা করো মাসি আজকে আমি মায়ের হাতে খাব।
ঝরনা বলে মাঝে মাঝে তুমি এমন ছেলেমানুষি করো না দেখো আমাকে কত কথা শুনতে হবে।
নদী ঝরনাকে জড়িয়ে ধরে বলে 'তোমাকে কিছু বলবে না মামনি, দেখো, আমি বলব সব দোষ আমার।'
ঝর্ণা বললো' হ্যাঁ সেইতো।'
ঝরনা চলে গেল নিচে। নদীর বন্ধুরা সবাই একে একে উইশ করতে থাকলো। এবার কোনো বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেনি। মনটা খারাপ ছিল বলে নদী সেভাবে কিছু চায় নি।
নদীর বন্ধুরা সবাই এবার এক্সকার্শনে যাবে বলে ঠিক করেছে ।সেই জায়গাটা কোনটা হবে সে নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। কেউ বলছে সিমলিপাল ,কেউ বলছে নেতারহাট, কেউ বলছে অন্য কিছু?
নদীর কাছে অপশন চেয়েছে। নদী নিজেও দ্বন্দ্বে ।কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
এরমধ্যে নিচে একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেল নদী ছুটে গেল একেবারে উচ্ছ্বসিত ভাবে। ব্যালকনি থেকে উৎসুকভাবে দেখছে' মা নামছে কিনা গাড়ি থেকে?'
'কিন্তু এ কি মাকে ওভাবে কয়েকজন ধরে নিয়ে আসছে কেন? কি হয়েছে মায়ের?'
নদী ব্যালকনি থেকে ছুটে আসলো ঘরে, ঘর থেকে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেলো নিচে বুকের ভেতরে তখন হাতুড়ির ঘা দিচ্ছে। ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেছে। পাগলের মত নদী ছুটছে তখন।
ঝরনা মাসি নদীর পেছনে পেছনে ছুটছে ,আর বলছে 'কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?'
নদী কোন কথাই শুনলো না। কয়েকজন এসে মাকে শুইয়ে দিল বসার ঘরটাতে।
'নদী কিছু ভেবে পাচ্ছে না কি হয়েছে মায়ের? 'মায়ের চেহারাটা কেন এরকম অবিন্যস্ত বানকেন আলুথালু বেশ ?হাজারো প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় নদীর মনে নদীর মন চলতে চলতে যেন কোথায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। আজ তার জন্মদিনে অন্যভাবে মেতে উঠতে চেয়েছিল। তার মায়েরে এই অবস্থা দেখে তার দেখা রঙিন স্বপ্নগুলো যেন কোথায় হারিয়ে গেল।ফিকে হয়ে গেল তার জন্মদিনের সমস্ত কল্পনা। পরিণত হল ধূসর স্বপ্নে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much