শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ২৩)
শামীমা আহমেদ
শিহাবের সাথে কথা হওয়ার পর আজ দুপুরটা শায়লার বেশ অস্থিরতায় কেটেছে। দুপুরে শিহাবের কথাগুলোতে শায়লা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। কোথায় যেন একটা ভাললাগা মায়া ভালবাসা জমেছে তার জন্য আর তাকে কাছে পাওয়ার উদগ্রীব বাসনায় মনটা বারবার উদাস হয়েছে।খুব গোপন একটা অনুভুতিতে বারবার শিহরিত হতে থাকে তনুমন।মনে হচ্ছে শিহাবের স্পর্শ সে অনুভব করছে।শিহাবের নিঃশ্বাস সে শুনতে পাচ্ছে। শিহাবকে ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।
দুপুরে খাবারের টেবিলে মা বিষয়টি খেয়াল করলেন।মায়েদের চোখ বোধহয় কিছুই এড়ায় না। তবে সবটা তারা বুঝে উঠতেও পারেন না।তারা খুব সরলভাবেই সবকিছু দেখেন।নোমান সাহেবের সাথে শায়লার বিয়ে পর্বটা হয়েছে তা প্রায় বছর ঘুরে আসছে। কাগজপত্র পাঠাতে কী এতদিন লাগে? মা মাঝে মাঝে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেন। মা তো বুঝতে পারছেন না শায়লার অনীহাতেই বিষয়টি পিছিয়ে যাচ্ছে। আজকাল শায়লাকে বেশ আনমনা লাগে।মা ভাবছে হয়তো নতুন জীবন সাজানো নিয়ে শায়লা ভাবনায় ডুবে আছে।কিন্তু শায়লা যে ভীষণভাবে শিহাবের মাঝে ডুবে আছে সেটা আর মাকে কোনদিন খুলে বলা হয় না। নাহ! কোনদিন তা বলাও হবে না।
দুপুরের খাবার খেয়ে শায়লার নিজের রুমে আসতে প্রায় তিনটা বেজে গেলো। শায়লা টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে বিছানায় এলো। বিছানায় শুয়ে জানালায় আকাশের দিকে চোখ পড়লো।সাদা তুলোর মত মেঘ উড়ে উড়ে যাচ্ছে।আহ! একাকী উড়ে বেড়ানো!ওদের কত স্বাধীনতা! কিন্তু শায়লার শৃঙ্খলিত জীবন।তবে ইচ্ছে করলে শিহাব তাকে মুক্ত জীবন দিতে পারে।শিহাবের কথা মনে পড়তেই শায়লা ভাবলো কী জানি দুপুরের খাবার খেয়েছে কিনা? নাকি একা একা আলসেমিতে ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে?
শায়লা মেসেজ পাঠালো,
দুপুরের খাবার খেয়েছেন?
তৎক্ষনাৎ উত্তর ভেসে এলো। হয়তো চোখটা ফোনের দিকেই ছিল।
হ্যাঁ,খেয়েছি।
কি খেলেন আজ?
সেদিন মা আর ভাবী অনেক খাবার পাঠিয়েছে। সেগুলোই চলছে।
আচ্ছা, আপনাদের জিগাতলার বাসায় আর কে কে থাকেন?
শিহাব বুঝে নিলো, শায়লা তার সম্পর্কে জানতে চাইছে।
শায়লাকে আর অন্ধকারে না রেখে শিহাব একে একে সবার কথা বললো।সাথে আরাফের নামটিও জুড়ে দিলো।
শায়লা সবাইকে মিলাতে পারল কিন্তু আরাফ কে সেটা বুঝতে পারছে না। জানতে চাইল আরাফ কে?
আমার ছেলে।বয়স তিন বছর।ওকে একমাসের রেখে ওর মা চলে যায় বা বলা যায় চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
শায়লার কানে যেন কিছুই ঢুকছিল না।
শায়লার ভাবনায় শুধুই শিহাব। তার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে শুধুই শিহাব।অন্য সবকিছুই যেন অগ্রাহ্য।
শিহাব শায়লার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়।
শায়লা কিছুটা নীরব থেকে জানতে চাইল আরাফ কার কাছে থাকে?
আমার মায়ের সাথে।তবে ভাবীই ওর মায়ের সবটুকু আদর ভালবাসা দিয়ে যাচ্ছে।
আরাফের একটা ছবি পাঠাবেন? খুব দেখিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
শিহাব ওর মোবাইলে সেভ করে রাখা আরাফের ছোট্ট বেলার দুটো ছবি শায়লাকে সেন্ড করে।আর লিখে পাঠালো রিশতিনার স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলছি।
আরাফের ছবি দেখে শায়লা বুঝে নিল আরাফ তার মায়ের মত হয়েছে।কারণ শিহাবের সাথে মুখটা মিলছে না।খুব মায়াভরা মুখটা! শায়লা চোখে পানি ধরে রাখতে পারলো না।সব মেয়েই মনের ভেতর একটা ঘুমন্ত মাতৃত্ববোধ লালন করে। তবে সবার প্রকাশভঙ্গী এক নয়। আরাফকে দেখে শায়লার ইচ্ছে করছিল এখুনি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরি। এমন ফুটফুটে একটা শিশু মায়ের আদর বঞ্চিত।
শায়লা পরম মমতায় ছবি দুটো সেভ করে রাখলো।শায়লা বুঝতে পারে শিহাবের খুবই দূর্বলতম জায়গা এটা।যাক আর এ প্রসঙ্গে বেশিদূর না আগানোই ভালো।
শায়লা প্রসঙ্গ পাল্টালো।
আচ্ছা, আপনি কি কখনো সাগর দেখেছেন?
আমার খুব ইচ্ছে সাগরের বেলাভুমিতে হেঁটে বেড়াবো আর সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে পানি এসে পা ছুঁয়ে যাবে।
হ্যাঁ, একবার গিয়েছিলাম। কলেজ থেকে একদল বন্ধুরা মিলে। সেই তারুণ্য ভরা মনে সবার চোখেই একটা স্বপ্ন ছিল জীবনসঙ্গিনীর সাথে আবার আসবে।অনেকেই গিয়েছে এরপর।আমার আর যাওয়া হয়নি।
শায়লা ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে উঠে।বলে ফেলে আপন মনে, আমার খুবই ইচ্ছে তোমার সাথে সাগর দেখতে যাবো। তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পাশাপাশি দুজনে হাঁটবো। সাগরের ঢেউ বারবার বেলাভুমিতে আছড়ে পড়বে আর আমাদের পা ছুঁয়ে যাবে। উত্তাল বাতাসে এলোমেলো চুলে আমার মুখটা ঢেকে গেলে তুমি তা যত্ন করে সরিয়ে দিবে। আর আমি চোখ বন্ধ করে তোমার ছোয়া অনুভব করছি। প্রচন্ড বাতাস এলে তোমার বুকে মুখ লুকাচ্ছি।
দু'প্রান্তে দুজনেই নীরব। শিহাব শায়লাকে ভেবে নিচ্ছে নীল শাড়িতে।গলায় ঝিনুকের মালা। বাতাসে এলোমেলো চুলে বারবার শায়লার মুখটা ঢেকে যাচ্ছে আর শিহাব হাত দিয়ে তা সরিয়ে দিচ্ছে। শিহাব শায়লার উষ্ণতা অনুভব করছে।যেন খুব কাছে দুজনে। শিহাব তার শক্ত হাতের বাঁধুনিতে শায়লাকে জড়িয়ে আছে। যেন আর কিছুতেই সে শায়লাকে হারিয়ে যেতে দিবেনা।
সাগরের বিশাল বুক যেন ভালোবাসার এক অতল গহ্বর। মানুষ সেখান থেকে তার খুব সামান্যই তুলে আনতে পারে।
কল্পনায় দুজন হারিয়ে গেলেও দুজনারই জীবন অতীতে বাঁ ধা।কল্পনায় হিমালয় পার হওয়া যায় কিন্তু মানুষের মনের সাড়া পাওয়া অধরাই থেকে যায়।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much