০৭ নভেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত"১০



শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
                                              (পর্ব ১০)
   শামীমা আহমেদ 



                                          ছুটির দিনের সকাল। রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল।শিহাব এক ঘন্টায় ঝিগাতলায় তাদের নিজেদের বাড়িতে পৌছে গেলো।মাঝে পেট্রোল পাম্প থেকে বাইকে তেল নেয়া। পথে আর কোথাও থামল না। মা অপেক্ষায় আছে তাই আর দেরি করতে মন চাইছে না।সারা সপ্তাহ ফোনে কথা হয়, ভিডিও কলে কথা হয়, দেখা হয়।তবুও মাকে ছুঁয়ে না দেখলে সত্যিকারভাবে মায়ের কাছে যাওয়া হয় না। যতই ভিডিও কলে দেখা হউক।অবশ্য শিহাবের বাবা এ ব্যাপারটায় এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। শুধু পাশে বসে সবকিছু শোনে।শিহাবের বাবামায়ের কাছে অর্থাৎ দাদাদাদীর কাছে বড় হচ্ছে শিহাবের একমাত্র সন্তান  তিন বছর বয়সী  ছেলে আরাফ। সেও তার বাবার জন্য নাস্তা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। শিহাবের বাইকের আওয়াজ শুনলেই দৌড়ে বারান্দায় চলে আসে।
শিহাবদের ঝিগাতলার এই চারতলা বাড়িটি  ওদের নিজেদের । তিন আর  চারতলায় এক ইউনিট করে হলেও বাকীগুলি দুই ইউনিটে করা।আর সবই ভাড়া দিয়ে রাখা।তা প্রায় পনের বছর হয়ে এলো বাড়িটার। শিহাবের বাবা আমেরিকায় থাকতেই বাড়ির কাজে  হাত দেয়া। শিহাবের বড় ভাই শাহেদ তখন কলেজে পড়ছে আর শিহাব ক্লাস নাইনে।  একটা ছোট্ট দুইরুমের টিনের ঘর তোলা ছিল। নিজের এই জায়গাটায় ফ্যামিলি রেখে আমেরিকায় গিয়েছিলেন আজহার সাহেব,মানে শিহাবের বাবা। তারপর একেবারে বাড়ির কাজ শেষ হওয়া অব্দি বাইরে থেকে টাকা পাঠিয়েছেন। শিহাবের বড় মামা দেখভাল করে বাড়িটি করে দিয়েছেন।বাঙালি সমাজে বড়ভাইদের বোধ হয়  বোনদের জন্য এমন দায়িত্ব পালন করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে যায়।  যদি ভায়েরা বিষয়টি সেভাবে দেখে।শিহাবের বাবা এরপরেও বহু বছর  বিদেশে কাটিয়ে বাড়ির লোন চুকিয়ে দেশে ফিরেন।এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। খুবই গোছানো মানুষ তিনি। চোখে মুখে দেহে প্রকৃত বয়সের ছাপ পড়েনি মোটেও।নিজের দিকে ভীষণ খেয়াল।বিদেশ জীবন একা কাটিয়েছেন তাই নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। স্ত্রীকে বেশি যন্ত্রণা করেন না। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা পুরুষরা স্ত্রীদের বেশ সম্মানের চোখেই দেখে।তারা বুঝতে পারে, কত কঠিন ছিল তার একার জীবনে দুই সন্তানকে মানুষ করা।
এখন শিহাবের ছেলে আরাফকে নিয়ে তাদের সময় কাটে। বড় ছেলে শাহেদের পরিবার, তাদের এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তিনতলায় থাকছে। 
ওরা নিয়মিত যোগাযোগে আছে। শিহাবের ভাবী সুমাইয়া বেশ চমৎকার একটি মেয়ে।
উচ্চশিক্ষা নিয়েও ঘরকন্যা আর সন্তান লালনপালনে  সাংসারিক জীবনটাকে এনজয় করছে। এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই।শ্বশুর শাশুড়ী আরাফের  যত্নআত্তিতেও সবসময় হাসিমুখ। শিহাবের বড় ভাই শাহেদ যেমন গম্ভীর, তেমনি মৃদুভাষী। যিনি একটানা বিভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখন একটি বিদেশি ব্যাংকের এমডির পদে আছেন।
শিহাব বাইক বাড়িতে ঢুকিয়ে রুহুল আমিন চাচার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন। রুহুল আমিন আজ প্রায় পনের বছর যাবৎ এই বাড়ির কেয়ারটেকার সাথে দারোয়ানের দায়িত্বও পালন করছে। বাড়ির গ্যারেজের পিছনে তাকে সপরিবারে থাকতে দেয়া হয়েছে। শিহাব চারতলায় উঠে গেলো।দরজা খোলাই ছিল।অবশ্য এই ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই থাকে। সারাদিন শাহেদের দুই ছেলেমেয়ে সুনায়রা ও আরুশের দাদার বাড়িতে যাতায়াত। এই তিন নাতিনাত্নি নিয়ে শিহাবের বাবামায়ের বেশ সুন্দর সময় কাটে।তবে  শিহাব আর আরাফের চিন্তা তাদের মাঝে মাঝে অস্থির করে তোলে। শিহাব সেটা বেশ ভালো করেই জানে। তাইতো ছুটির দিনে আর দেরি করেনা একেবারে। আরাফ দৌড়ে এসে বাবার কোলে উঠল! বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। শিহাব  আরাফকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। আদরে আদরে দুটো গাল ভরিয়ে ফেললো। বাবা ছেলের এমন মধুর মিলনে, মায়ের উপস্থিতি হলো না কোনদিন, কী দূর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে!
শিহাবের মায়ের  একদিকে যেমন ছেলেকে কাছে পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে মায়ের আদর বঞ্চিত ছোট্ট ছেলে আরাফের জন্য বুকটা হু হু করে উঠে। চোখ জলে ভরে যায়। শিহাবের বাবা আজহার সাহেব এইসব আবেগী ব্যাপারস্যাপার বেশ শক্তভাবেই সামাল দিতে পারে।ঠিক তার বড় ছেলেটিও এমনি আবেগহীন, মৃদুভাষী  আর গুছানো, প্ল্যানড লাইফে দিন কাটান।শিহাব আরাফকে নিয়ে মায়ের পাশে বসলো।মা ছেলের কান্নার দৃশ্যে আরাফ অবাক হয়ে দেখছিল। মিনিট দশেক পরিবেশটা বেশ ভারী হয়ে উঠল।আরাফের জন্য আনা খেলনাগুলো শিহাব মায়ের হাতে দিলেন। তিনতলা থেকে ভাবী চলে এলেন। শিহাবকে বললেন, নাসতা খাবে এসো।মা বাবা আরাফকে নিয়ে টেবিলে বসো। ভাবি তিনতলায় থাকলেও এই ঘরের সব প্রয়োজনই বুঝে। বড় ছেলে শাহেদকে নিয়ে মা বাবার কখনোই কিছু ভাবতে হয়নি।
বউওটাও আল্লাহ তেমনি মিলিয়ে দিয়েছেন।পরিবেশের সাথে নিজেকে খুব সহজেই মিলিয়ে নিতে পারে। কিন্তু শাহেদ ভীষন প্র‍্যাক্টিক্যাল মানুষ। ঠিক বাবা আজহারুল ইসলামের মতনই।
শিহাব তার ভাবীর কাছে জানতে চাইল সুনায়রা, আরুশ ওরা কোথায়? ওদের পাঠিয়ে দাও একসাথে নাস্তা করি। তুমিও বসো।অনেকদিন গল্প করি না। সুমাইয়া তার  হাতের মোবাইলে শাহেদকে কল দিতেই শাহেদ বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিল। চাচ্চুকে পেয়ে তারা দারুণ খুশি!তারপর তারা আরাফের এই গল্প সেই গল্পে সারাদিন মেতে রইল। ওদের কাছে আরাফ একটা জ্যান্ত পুতুল! সেই জন্মের একমাস পর থেকেই ওরা বড়ভাইবোনের মত অভিভাবক। আরাফের মা কেন নেই সে প্রশ্ন ওরা করে না। এইটুকু জীবনে ওদের চাচার সবকিছুই ওরা প্রায় বুঝেছে। যদিও একজন ক্লাস এইটে আরেকজন ক্লাস ফাইভে পড়ছে। কিন্তু ওরা বুঝে আরাফের মা কাছে নেই আর কোনদিন আসবেও না।  
সুমাইয়া এখানেই সব খাবার পাঠিয়ে দিলো।সুমাইয়া খুব করেই জানে সুনায়রা আর আরুশ আজ আর তারা বাসায় যাচ্ছে না।নাস্তা শেষে ওরা আরাফের খেলনা নিয়ে খেলার  আনন্দে মেতে উঠল!
আজ এই চারতলার ফ্ল্যাটে রিশতিনাকে নিয়ে শিহাবের দিনগুলি অন্যরকম হতে পারতো!আর সেসব ভাবলেই শিহাব  বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়ে,,,



                                                                                                           চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much