২০ সেপ্টেম্বর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী'র উপন্যাস "টানাপোড়েন" ৬

অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয়  মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন  



 

                       উপন্যাস-টানাপোড়েন (পর্ব-)

                                                     দ্বিধা


আজকাল বুম্বা বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে।  স্বতঃস্ফূর্তভাব পরবর্তী লক্ষ্য করা যায় না। আগে খাবার টেবিলে বসে অনর্গল দাদু ঠাকুমার সাথে যেত। আমি তোমার সেই রূপকথার গল্পটা বল না রাজকন্যাকে পাতালপুরীতে নিয়ে গেল দৈত্যরা এসে.. তারপর? ঠাম্মি হেসে বলেন"না দাদু ভাই, আর গল্প নয় এখন তোমার পড়ার সময় তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠো। পড়ার পরে তোমাকে গল্প শোনাবো কেমন?

বুম্বা ''ঠিক আছে ঠাম্মি  ।তাহলে কিন্তু দুটো গল্প? বলেই তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে ,পড়তে বসে যায়।

 খাবার টেবিলে বসে ঠাকুরমা দাদু নাতির এই সম্পর্ক বৌমা মানতে পারে না। ভাবে তার ছেলের মাথাটা চিবোচ্ছে এই বুড়ো বুড়ি।কাজেই কি করে এদের হাত থেকে তার ছেলেকে রক্ষা করা যায় তার প্লান আটতে থাকন। ছেলে সুধাময় বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের কান ভারি করা হয়। মাঝেমধ্যেই ছেলে-বৌমার মধ্যে কটা কথা কাটাকাটি হয়। একদিন তো বৌমার কথাতেই স্পষ্ট হলো বুম্বা ,এরপর তো তোমাকে খাবার টেবিলে একা একাই খাবার অভ্যাস করতে হবে তখন কোথায় গল্প পাবে ?

বুম্বা, ঠাকুমা -দাদুর দিকে তাকিয়ে । সুরূপা লক্ষ্য করেই আমল না দিয়ে বলে  'নাও ।অত বায়না করো না।'

প্রভাদেবী বলেন 'কি এমন বায়না করে দাদুভাই ।দু' একটা গল্প শুনতে চায় ।

 বৌমা 'হ্যাঁ আপনারা ওই আস্কারা দিয়ে দিয়েই ওর মাথাটা খাচ্ছেন।'

প্রভাদেবী আর কোন কথা বাড়ান না। 

সদানন্দ বাবু নিজের স্ত্রী প্রভাদেবীকে বলেন  'ছাড়ো না, ওদের সন্তান। ওরা যেভাবে মানুষ করতে চায় করতে দাও। 

মাঝেমধ্যেই নাতি বুম্বা পড়ার ফাঁকে ঠাকুমা- দাদুর ঘরে ঢুকে পড়ে ।এসেই ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে ।ছোট ছোট দুই হাত ধরে যখন গলা জড়িয়ে ধরে প্রভাদেবীর ।প্রভাদেবী যেন স্বর্গ সুখ পান। প্রভাদেবী আদরের সুরে সঙ্গে বলেন ' কি দাদুভাই। কি মতলব তোমার'?

বুম্বা -কানের কাছে এসে বলে( আবদার করে) 'ঠাম্মি আমাকে কিন্তু তিলের নাড়ু খাওয়াবে? '

প্রভাদেবী 'এই কথা ।খাওয়াবো দাদুভাই'। 

দরজার কাছে একটু তাকিয়ে থেকে আবার ছুটে এসে ঠাম্মিকে বলে -'মাকে কিন্তু ব'লো না।'

প্রভাদেবী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। 

তখনি ছুটে চলে যায় পড়ার ঘরে। সেদিন তো হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে বুম্বা ।কি মারটাই না মারলে ওর মা। 

প্রভাদেবী ছুটে এসে বলেন-'বৌমা এত মারছো কেন?'

বৌমা বলেন-'দেখুন আমার ছেলেকে শাসন করার সময় আপনি এখানে আসবেন না। একেতেই আপনাদের আশকারাতে আমার ছেলের মাথাটা যাচ্ছে।'

প্রভাদেবী ঘরে চলে আসেন‌ চোখের জল ফেলেন।

সদানন্দ বাবু প্রভাদেবীর কাছে এসে তাঁকে সান্ত্বনা দেন আর বলেন আজকাল দিন পাল্টে গেছে প্রভা ।আজকাল বয়জ্যেষ্ঠদের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই এদের। ওদের ছেলে যেভাবে মানুষ করতে চায় ওদের করতে দাও। কষ্ট পেওনা। 

সুধাময় বাড়িতে আসলেই শুরু হল তুমুল ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত সুধাময়কে স্ত্রীর কাছে হার মানতে হলো। ওদের ফ্ল্যাট কেনাই ছিল। শুধু মাত্র সুধাময়ের মনে একটা দ্বিধা তৈরি হয়েছিল ,বাবা -মাকে রেখে কি করে ফ্ল্যাটে যাবে? কিন্তু ছেলের কথা ভেবে আজকে তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। তাই মা -বাবার রুমে এসে জানিয়ে দিয়ে গেল আগামী ৭দিনের মধ্যে তারা কলকাতার ফ্ল্যাটে শিফট করছে। 

প্রভাদেবী বলেন  'হ্যাঁ তোদের সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করবি ,তোদের তো ফ্ল্যাটে যেতেই হবে। তবে একটা অনুরোধ বাবা । নাতিকে আমাদের কাছে মাঝে মাঝে নিয়ে আসিস। 

সুধাময় বলে "ঠিক আছে মা।"

এত তাড়াতাড়ি মা বা-বা মেনে নেবেন ,সুধাময়এর ও কল্পনার অতীত ছিল। সুধাময় এর আর কোন বাঁধা রইলো না। শেষ পর্যন্ত সুরূপার জয় হলো। 

কিন্তুএখানে এসেই সেই সমস্যাটা আরো বেশি করে দেখা দিল। ছেলে বুম্বা দিনকে দিন মনমরা হয়ে যাচ্ছে। লেখা পড়ায়  মন নেই। সুধাময় একদিন ছুটির দিন দেখে বাবা-মায়ের কাছে ছেলেকে নিয়ে আসলো। কিন্তু সুরূপা আসলো না। আগে থেকে বলেই রেখেছিল সুধাময় মাকে ফোন করে। তাই ছেলে নাতির পছন্দমত সব খাবার বানিয়েছিলেন প্রভাদেবী। বুম্বা ঠাকুমা দাদুর কাছে এসে আগের মত সতেজ হয়ে উঠলো। এরমধ্যে সুধাময়ের মনের  মেয়ে মোমবাতি এসেছে বলে দু'জনে উঠোনে খেলতে নেমে গেল। আর ঠাম্মির কাছ থেকে তিলের নাড়ু নিয়ে খুশিতে ডগোমগো হলো। বুম্বার আনন্দ যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল।সুধাময় ভাবতে লাগলো এ বাড়িতে এসে বুম্বাকে আগের মত দেখতে পেয়ে সুধাময় খুব খুশি  হল। কিন্তু মা -বাবাকে মুখ ফুটে বলতে পারল না। ফিরে যাবার সময় বুম্বার সে কি কান্না। শুধু বাবাকে বলতে লাগলো ' বাপি ঠাম্মি দাদুকে নিয়ে চল না কলকাতার ফ্ল্যাটে? সুধাময় ছেলেকে সান্তনা দেবার জন্য বলল পরের বার এসে নিয়ে যাবো ।আসলে সুধাময় এর ভেতরে দ্বিধা তৈরি হয়েছে ।সেটা যে তৈরি করেছে তার স্ত্রী সুরূপা। যদি কলকাতার ফ্ল্যাটে তার বাবা-মাকে নিয়ে আসে তাহলে সুরূপা সঙ্গে সুধাময়ের তুমুল ঝগড়া হবে। তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে চায় না। সুধাময় সে কথাটা তার বাবা-মাকে খুলে বলতে পারে নি ।তাই ঠিক করেছে এবার থেকে একটু কম আসবে মা-বাবার কাছে। যাবার সময় যতদূর দেখা যায় বুম্বা দূর থেকে তাকিয়ে থাকে তার ঠাকুমা দাদুর দিকে। দাদু ঠাকুমা হাত নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে দাদুভাই পরের রবিবার এসো। আমি তোমার জন্য তিলের নাড়ু আর নতুন একটা গল্প বলবো। বুম্বা খুশি হয়ে চলে যায়। এবার বাড়িতে গিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করতে থাকে আর দিন গুনতে থাকে রবিবারের। শনিবার দিন রাত থেকে ওর ভেতরে উত্তেজনা দাদু -ঠাকুমার কাছে যাবে বলে। কিন্তু পরের দিন রবিবার যাবার সময় হলেও যখন তার বাবা তাকে নিয়ে যায় না ।এমনকি ও ঠাকু মা ফোন করলেও যখন ফোন ধরতে দেয়া হয় না ।তখন সে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সুরূপা এসে ছেলেকে ভালো করে ধমকায় আর বলে এবার থেকে আর তোমার ওখানে যাওয়া হবেনা। তোমায় শুধু পড়াশোনা করতে হবে ভালো করে এই কথাটা মাথায় নিয়ে নাও। ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েছ। বুম্বা জানে এটা কিসের ভালো স্কুল যেখানে দাদু ঠাকুমা কে নিয়ে কোন কথাই কেউ বলে না। ও যদি কারো কাছে সে গল্প করতে চাই তারাও সেটা শুনতে চায় না। তারা মোবাইলের নানা গেমস গুলোর কথা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এরমধ্যে বুম্বা জানে তাদের ফেলে আসা গ্রামের ঠাকুমার গায়ের গন্ধ ঠাকুমার হাতের তৈরি নাড়ুর অসাধারণ স্বাদ ।ঠাকুমা -দাদুর বলা গল্প সমস্ত যেন নগন্য বলে মনে হয় শহরের পড়ুয়াদের কাছে। শহরের দামি দামি রেস্তোরাঁর খাবার এর কাছে বুম্বার ঠাকুমার নগণ্য তিলের নাড়ুর মূল্য কিসের?বুম্বার ভেতরে যে ওলট পালট হচ্ছে। তার ভেতরে যে কতটা কষ্ট হচ্ছে সে খবর রাখার প্রয়োজন করে নি কেউ ।এমন কি ওর বাবা-মা ও। আজকে বুম্বা নিজের ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে ওঠা কষ্টটাকে চাপা দেওয়ার জন্য। সে ভেবে পায়না শহরের মানুষগুলো এত নিষ্ঠুর কেন। এই শহর যেমন সবুজহীন, এমনি মানুষগুলো নিষ্ঠুর। সে ফিরে পেতে চায় তারা গ্রামবাংলার সবুজ গাছপালার স্পর্শ বেড়ে ওঠা গ্রামের  জয় -নিতাইদের সহজ-সরল সান্নিধ্য, ফিরে পেতে চায় ঠাকুমা দাদুর স্নেহ ভরা দুটি শীতল হাতের স্পর্শ। তাই একদিন স্কুল ছুটির শেষে সে নিজেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ফেরার সময় পার্কের কাছে একটি পুকুরে ধারে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করতে থাকে তারপর হাতে একটা নুড়ি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে জলে। সে ভাবতে থাকে সে যে চুপিচুপি মশারি সরিয়ে তার ঠাকুমার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়তো তারপর তার ঠাকুমা তাকে কাছে টেনে ফিসফিস করে বলতো দাদুভাই আজকে কি মতলবে বোম্বা তাকে জড়িয়ে ধরে কত কথাই না বলতো আজকে তার ঠাকুমার গায়ের আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ তার কল্পনায় একবুক নিঃশ্বাসে টেনে নিল তার ভেতরের যে কষ্ট সেই কষ্টটা সে কাউকে বাড়িতে গিয়ে শেয়ার করতে পারে না। মা তো শুনতেই চায় না কোনো কথা। সে ভেবে পায়না তার ঠাকুমা দাদু কলকাতার ফ্ল্যাটে আসলে তাদের কি এমন অসুবিধা হতে পারে সে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যায় এখানে তার না আছে সঙ্গী সাথী, সে কিছুতেই এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারছে না।


মাঝে মাঝেই তার মা ঠাকুমা দাদু সম্পর্কে নানারকম মিথ্যে কথা বলে তার মনটাকে বিষিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে তার মনে দ্বিধা তৈরি করতে বাধ্য করছে তার শিশুমন সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না।



ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"৬ ক্রমশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much