২৯ আগস্ট ২০২১

মমতা রায় চৌধুরী 'র গল্প - অপত্য স্নেহ


 অপত্য স্নেহ



বুলু কাকিমা পুলিশ অফিসারের মেয়ে, নার্সিংহোম মালিকের স্ত্রী ,ঝকঝকে গাড়ি  করে যাতায়াত। আমি জয়িতা যখন প্রথম বউ হয়ে মল্লিকবাড়িতে ঢুকি। আমাকে দেখতে এসে একগাল হেসে বলেছিলেন -'বাঙাল ঘরের মাইয়া আনছো, একটু মানাইয়া, গোছাইয়া লইও কল্যাণী'।কথাটার মানে সেদিন বুঝতে পারি নি। আজ হারে হারে টের পাচ্ছি। আসলে আমি শাশুড়ি মার যতই আপন হবার চেষ্টা করেছি ১৪বছরে একটুও সক্ষম হই নি। ভেবেছিলাম এ বাড়িতে নতুন করে মাকে পাব। মেয়ের মত তিনি আমাকে কাছে টেনে নেবেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি মায়ের স্নেহ তো কপালে জুটল না। অনেক প্রত্যাশা ছিল মনের ভেতর। বড়লোক বাড়ি বিয়ে হয়েছিল। ঝি চাকরাই সব কাজ করে। তবে আমার ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। সব কাজ আমাকে করতে হতো। তাতে অবশ্য আমার কখনো কষ্ট হয়নি। কষ্ট হতো যখন বাবা-মা বা আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমাকে যখন তখন অপমান করা হতো ,অসম্মান করা হত। আসলে 'এই জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি'-এই কথাটা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে আমার শশুর -শাশুড়ি মার ক্ষেত্রে। ছেলেটি হুট করে বিয়ে করে ফেলবে ,তা তাদের স্বপ্নের ও কল্পনার অতীত ছিল। ভেবেছিলেন যে ছেলেকে তারা এত ভালবাসেন মা বাবার কথা মত পছন্দসই পাত্রী র সঙ্গেই তার বিবাহ হবে। কিন্তু তা হয়নি। তাই  উচ্চশিক্ষিতা বৌমার‌ প্রশংসায় প্রতিবেশীরা পঞ্চমুখ হলেও তাঁরা খুশি হতে পারেন নি।কত সম্ভ্রান্ত বাড়ির ইতিহাসে লুকিয়ে আছে ,এরকম অত্যাচারের কাহিনি। কোনদিন হয়ত সেগুলো চার দেয়ালের বাইরে বের হতেই পারে না। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় সন্তান না হওয়াতে। অলক্ষী ,বাজা এ তো উঠতে-বসতে কপালে জুটতো। এমনকি ছেলেকে অন্যত্র বিয়ের জন্য তোড়জোড় চলতে থাকে। আমি শুধু চোখের জল ফেলি নীরবেএবং স্বামীকে একদিন বলে ফেলি ,সত্যিই তো আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না ।এতে তোমার ফ্যামিলির কোন দোষ নেই।তুমি বরং অন্যত্র বিবাহ করে বংশের মুখ রক্ষা করো। স্বামী অবশ্য মুখ কাচুমাচু করে বলে এসব কথা তুমি ব'লো না ।মুখে হয় তো বলে কিন্তু ভেতরে হয়তো আছে তার অন্যরকম খিদে। সেটা ক্রমশ প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু আমার তো কোথাও যাবার জায়গা ছিল না ।তাই মুখ বুজে আমাকেও সব মেনে নিতে হয়। অনেকে ভাবে উচ্চশিক্ষিতা সে এসব কেন সহ্য করে, সে তো চলে যেতে পারে বা প্রতিবাদ করতে পারে?স্কুল জীবনে যখন আমি এই অত্যাচারের কথা শুনতাম তখন ভাবতাম কেন প্রতিবাদ করে না। এখন বুঝি প্রতিবাদ আমরা অনেকেই করতে চাই কিন্তু পরিবেশ প্রতিকূলতায় সব সময় তা হয়ে ওঠে না ।বিশেষত যদি সেই মেয়েটি আত্মনির্ভরশীল না হয়ে থাকে।

ভেতরে ভেতরে এবার আমি আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথাই ভাবছিলাম। কেননা স্বামীর প্রতি যার গভীর আস্থা ,শেষ পর্যন্ত সেও যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার থেকে দুঃখের একটি মেয়ের জীবনে আর কি হতে পারে? আমার জীবনে চলতে থাকে মা না হতে পারার তীব্র যন্ত্রণা। সন্তান জন্ম দিয়ে নাকি সংসারের ভর্তি হওয়া যায় মল্লিকবাড়ির ধারণা অনুযায়ী। এভাবেই কাটতে থাকে বছর আমিও এ বাড়িতে স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি মার সেবা -যত্ন, আর তীব্র অসম্মান নিয়ে সময় কাটাতে থাকি। আবার সন্তান থাকলেও সে মায়ের কত যন্ত্রনা ,আমি আমার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি চারপাশের ঘটনা দেখে ,বিশেষত বুলু কাকিমাকে দেখে। কাকা মারা যাবার পর বুলু কাকিমার যা-কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল সমস্ত কিছুই মেয়েরা কাকিমাকে বুঝিয়ে নিজের নামে করে নেয়। আস্তে আস্তে সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বুলু কাকিমাকে আমি দেখতে পাই অন্য মাত্রায়। বুলু কাকিমা শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধুর স্ত্রী হওয়ার জন্য সেই সুবাদে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন আর আমার সঙ্গে গল্প করে যেতেন। এতে শাশুড়ি মা অসন্তুষ্ট হতেন। বুলু কাকিমা বাঙাল হওয়ার জন্য হয়তো আমার প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিলেন।এরপর বুলু কাকিমার কপালেও জুটল মেয়েদের থেকে লাথি-ঝাঁটা। এমন কি খাবার খেতে না দেওয়া ।শেষমেষ একদিন তো আমার কাছে এসে কেঁদেই পড়লেন এবং বললেন তুমি আমার মেয়ের মতো ,তাই তোমাকেই বলছি। আমাকে একটু খেতে দেবে? আমি বললাম -'সে কি কথা ,কাকিমা ?অবশ্যই অতিথি নারায়ন। আমি আরো সাহস করে বলতে পারি কারণ আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মা তার মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন প্রায় দুমাস হল। তখন সংসারের সমস্ত কিছুই আমার হাতে বিশেষত হেঁশেলের। তাই যখন কাকিমা দুপুরবেলায় একদিন হন্তদন্ত হয়ে আসলেন ,চুলগুলো উসকো খুসকো ,চোখের কোণে কালি এবং কেঁদে ফেললেন। আমি বললাম কাকিমা কি করবেন আপনাকে বাঁচতে হলে তো আপনাকে আইনের দ্বারস্থ হতেই হবে ।কি করে বৌমা ? তাহলে তো আমার পরিবারের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি সব বেরিয়ে পড়বে ।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -'তুমি পারবে তোমার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলতে? আমি তোমার সব কিছুই জানি ।একদিন আমিও  হয়তো তোমাকে বলেছি যে একটা সন্তান জন্ম দিতে পারলে না । সন্তানসুখে গর্বিত মা হিসেবে বলেছিলাম তখন। তবে আজ বুঝি তোমার সন্তান হয় নি ,তুমি ভালো আছো ।আমার সন্তান হয়েও তো আমি ভালো নেই । অপত্য স্নেহ এমন যে, তারা ভুল করলেও তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে পারি না। ওপরে থুতু ফেল লে তো মাটিতেই পড়ে ।এরা আমার সন্তান ।সুখে দুঃখে ভালো-মন্দে আমি জড়িয়ে আছি ।তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলব?আমি অবাক হয়ে গেলাম আর ভাবলাম মা এমনই হয়। উদাসী হাওয়া গায়ে এসে লাগল ।দোলা দিয়ে গেলো মনে প্রানে। তার দুদিনের মধ্যে শশুর শাশুড়ি মা বাড়িতে আসলেন। শাশুড়ি মা ,দেখি আদর করে আমাকে ডাকছেন ।আমি একটু অবাক হলাম বটে। তবে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় করে। তবুও খুব খুশি হয়েছি যে এভাবে এত স্নেহের সুরে আমাকে ডাকছেন । এক নিমিষে যেন জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ঘুচে গেল। মরা নদীতে বান ডেকে গেল।আমি গদগদ ভাবে যখন তার কাছে দাঁড়াই। উনি বললেন -'দেখো বৌমা তোমাকে আমি অনেক কটু কথা বলেছি কিছু মনে করো না। তবে তোমার কাছে অনুরোধ তুমি আমার ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও।  নইলে আমার বংশ রক্ষা হয় না। তুমি তো উচ্চশিক্ষিতা নিশ্চয়ই আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। তার জন্য যা করতে হয় আমি তার ব্যবস্থা করে দেবো। শুধু তুমি আমার ছেলেটিকে মুক্তি দাও। কথাটা শুনে আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল, আমি যেন আমার চোখের সামনে তখন সর্ষেফুল দেখছি। তারপর নিজেকে শক্ত করলাম আর ভাবলাম তাই তো আমার স্বামী একটি সন্তান‌‌ প্রত্যাশা  করে। কিন্তু আমি সেটা দিতে পারি নি।আমাদের মধ্যে সম্পর্কটায় যেন আস্তে আস্তে অনেকটাই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ভেবে দেখলাম আমাকেও প্রমাণ করার দরকার আছে। আমি কিছু করতে পারি আমার আইডেন্টিটি তৈরি করতে পারি। সারাটা রাত ভাবলাম খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম ,যখন চাঁদের স্নিগ্ধ মধুর আলো আমার শরীরে এসে পড়ল। ভাবলাম শাশুড়ি মার কথাটাই মেনে নেওয়া উচিত। পরেরদিন সকালবেলায় শাশুড়ি মাকে বললাম আমি রাজি । শাশুড়ি মা বললেন-বাহ ভাল ভাবনা। আমিও তোমার জন্য ভেবে রেখেছি। তুমি তো খুব ভালো গান করো। এ বাড়িতে তো তুমি সেভাবে গান করার সুযোগ পাওনি। তোমার জন্য একটা গানের স্কুল খুলে দেবো। জয়িতা খুব খুশি হলো। যে  গান একসময় তার প্রাণ ছিল। কলেজে গান গেয়ে কতজনার হৃদস্পন্দনে পরিণত হয়েছিল সে। শুধুমাত্র সজলকে ভালোবেসে এতটা সেক্রিফাইস করেছিল। তাই আজ শুধু সে নিজের জন্যই ভাববে। শাশুড়ি মা বৌমার মধ্যে একটা যেন চুক্তি হয়ে গেল। তবে মনে রয়ে গেল পুরুষ জাতির প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা। এ কেমন ভালোবাসা ,সন্তান জন্ম দিলেই কি শুধু ভালোবাসার অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়? সন্তান ই কি শুধুমাত্র দুজনকে বেশি নিবিড় করে বাঁধে?  আজ সন্তান হয়নি বলে সে সুখী হতে পারলো না সজলের সাথে। আর বুলু কাকিমা তার সন্তান থাকা সত্ত্বেও সেও সুখী হতে পারলো না। সন্তান না থাকার জন্য একটা সংসার ভেঙে যাচ্ছে ।আবার সন্তান থাকার জন্য অসহায় মা চোখের জল ফেলছে। এ কেমন অপত্য স্নেহ যার জন্য ভালোবাসার মানুষটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। আজ জয়িতার বারবার মনে পড়ছে গানটি-"আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ' সজলের সঙ্গে বাঁধা ছিল তার গান। আজ তাল কেটে গেলো ,সুর বেসুরো হলো। তবে আজ নতুন করে নিজেকে বেঁধে ফেলতে চাইলো গানের অপত্য স্নেহে। জয়ীতার চলার পথে থাকল শুধু গান আর গান।

1 টি মন্তব্য:

  1. অপত্য স্নেহে আপ্লুত হলাম।
    সার্থক নামকরণ । চিত্রদীপ

    উত্তরমুছুন

thank you so much