০২ জুন ২০২২

মমতা রায় চৌধুরী র ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৭৬




উপন্যাস 

টানাপোড়েন   ১৭৬

টেনশন


মমতা রায় চৌধুরী 




মহা সমস্যায় পড়েছে রেখা। একদিকে খাতার চাপ অন্যদিকে লেখা র চাপ আবার মনোজকে নিয়ে একটা মানসিক চাপ সব মিলিয়ে যেন ঘেটে ঘ হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বসে এসবই ভাবছে, হঠাৎ মনোজ বাথরুমে যেতে গিয়ে রেখাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলল 'তুমি ট্রেন ধরবে না?"
রেখা এতটাই ভাবনায় মগ্ন ছিল যে মনোজের আসার ব্যাপারটা টের পায়নি। তখনো ভেবে যাচ্ছে ঝড় কোন দিক থেকে তার জীবনে আসছে কে জানে? এই ঝড়কে সে সামলে উঠতে পারবে কিনা?
মনোজ এবার  চিৎকার করে বললো' কি ব্যাপার তুমি ট্রেন ধরবে না?"
রেখার ধ্যান ভাঙ্গে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মনোজের দিকে।
মনোজ কাছে গিয়ে হাত নেড়ে বলে *হ্যালো, কি হলো তোমার?'
রেখা বলল' কি?"
মনোজ বলল" সেটাই তো জানতে চাইছি।'
রেখা বলল' কি? কিছুই না।'
 মনোজ বলল' তুমি স্কুলে যাবে না? ট্রেন ধরবে তো? রেডি না হয়ে বসে আছো?,
'না আজকে স্কুলে যাব না।'
মনোজ অবাক হয়ে বলে 'কেন শরীর ঠিক নেই?'
', তা ঠিক নয়। ঝমঝম করে বৃষ্টির আওয়াজ শুনে বলল'বৃষ্টি হচ্ছে?'
এ বাবা বৃষ্টি হচ্ছে খেয়াল কর নি।
'যা গরম টা পড়েছিল বৃষ্টি হওয়াতে ভালই হচ্ছে। কালকে রাত্রেও তো খুব বৃষ্টি হয়েছে।'
ওদিকে তোমার তুলি  কিন্তু ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছে না।
রেখা বলল"এখানেও কি আমার দোষ?"
মনোজ বলল না তা ঠিক নয়।
 রেখা মনোজকে দেখছে আর অবাক হচ্ছে'কিভাবে কথা বলছে তাতে তো এখন মনোজকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না, কিছুক্ষণ আগেও মনোজকে কতটা টেন্সড দেখেছে।
সবাই বলে নারী চরিত্র বিচিত্র। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ও নাকি বোঝার ক্ষমতা নেই। পুরুষ চরিত্রই বা কম কিসে? শুধু শুধু আজ স্কুলটা কামাই করলো। আবার রেখা মনে মনে ভাবল ছুটিই তো গেছে। মানুষের থেকে ছুটির দাম তো বেশি হতে পারে না। রূপসার হাজবেন্ডের কথা শুনে মনের ভেতরটা কেমন ধড়াস করে উঠল। স্বাভাবিক ছন্দে ছিল সারাটা দিন হাসি ঠাট্টা করেছে ,মনের মত খাবার রান্না করেছে রুপসাকে দিয়ে অথচ সেই মানুষটির ঐরকম একটি কাজ করতে পারে ?এটা কল্পনার অতীত ছিল ।একটা পুরো ফ্যামিলি ভেসে যাবে না থাকলে সেটা কখনো ভাবতেই পারল না। নিজের সন্তানের কথা ও চিন্তা করলো না। দীক্ষিত হয়েও সদ্গুরুর কথাও চিন্তা করলো না। মানুষের মনে হতাশা ,অবসাদ ,অসহায়তা কোথায় টেনে নিয়ে যেতে পারে ,ভালোবাসার সবকিছুকে ছিন্ন করে চলে যেতে পারে ।এইসব ভাবতেই রেখার গা শিউরে উঠলো। ভেতরে ভেতরে কত বড় ঝড়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সে কথা একবারও রুপসা কে বলেনি। একবার যদি বলতো, হয়তো কিছু হলেও একটা সমাধান বেরিয়ে আসতো। আপনার জীবনকে মূল্য দিতে হতো না ।রেখাও সেই একই কথা ভাবছে মনোজ কদিন ধরেই ডিস্টার্ব আছে কিন্তু কি হচ্ছে, কি জন্য? সেটা রেখা জানে না।
মনোজ বলল 'তুমি স্কুলে গেলে না কেন?'
"ভালো লাগলো না। তুমি আছো 
বাড়ীতে ।ভাবলাম আমিও থেকে যাই।'
'শুধু এই কারণে থেকে গেলে?'
রেখা বলল' হ্যাঁ।'
মনোজ যেন খুশি হতে পারল না।
রেখা সেটা বুঝতে পেরেই বলল 'আরেকটা কারণ অবশ্যই ছিল?'
মনোজ বলল' কি?'
রেখা বলল''খাতা '
মনোজ বলো 'তাই বলো?'
"তোমার রথ দেখাও হলো কলা বেঁচাও হল।'
'এভাবে কেন বলছো আমি কি তোমার জন্য ছুটি নিতে পারি না, নাকি কখনো নিই  নি?'
মনোজ কি একটা বলতে গেল কিন্তু না বলে আবার ভাবনায় মগ্ন হল ।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ফোন ঘেটে যেতে লাগলো।
রেখা মনে মনে ভাবছে "মনোজের মনের ভেতরে কি হচ্ছে কে জানে ?মনটা যদি এই মুহূর্তে পড়তে পারতো তাহলে মনে হয় সব থেকে ভালো
 হতো ।তবে যাই হোক স্কুলে না গিয়ে ভালোই করেছে। ওর মন একদম ভালো নেই ।কি কারনে? কাকেই বা বলবে?'
এমন সময় বাইরে মিলির আর ওর বাচ্চাদের চিৎকার শোনা গেল।
রেখা বললো 'দেখ তো কি হলো,?'
কিন্তু মনোজের কোনো হেলদোল নেই। অন্য সময় হলে রেখা রেগে যেত ।এখনো রাগ হচ্ছে কিন্তু মানুষটাকে ঘাটাতে চাইছে না।
রেখা নিজেই দরজা খুললো ,খুলে দেখল দুজন অচেনা যুবক এসে আশ্রয় নিয়েছে সানসেট এর নিচে। রেখা বলল' তোমরা চেঁচাচ্ছ কেনো?'
ওরা সবাই লেজ নেড়ে কিউ কিউ কিউ  আওয়াজ করলো।
রেখা ওদের গায়ে হাত বুলাতে লাগল।
তারপর অচেনা ছেলে দুটিকে জিজ্ঞেস করল 'তোমাদের বাড়ি কোথায়?'
যুবক দুজন বলল 'রেল গেটের কাছে।'
তোমরা এদিকে কি করতে এসেছো?
"আমরা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলাম বৌদি ।এখন আরো বেশি জোরে বৃষ্টিআসাতে আপনাদের এই জায়গাটাতে একটু আশ্রয় নিয়েছি।"
আশ্রয় নিয়েছ সে জন্য কোন ব্যাপার নাই, কিন্তু যখন দেখছ ওরা চেঁচাচ্ছে তাহলে তোমাদের নো অন্য কোন জায়গায় যাওয়া উচিত ছিল।
আরও তো অনেক বাড়ি আছে?'
ছেলেদুটো কোন কথার জবাব দিল না। রেখার কেমন সন্দেহ হতে লাগলো। কিছুদিন আগে 'এ 'ব্লগে চুরি  হয়েছে।
দিনকাল ভাল নয়। আবার মনে মনে ভাবল অকারনে সন্দেহ যেন ক্রমশ মানুষের মনে বাসা বাঁধছে । ভালোও তো   হতে পারে ।হয়তো সত্যি সত্যিই বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আশ্রয় নিয়েছে। রেখার এরকম করে বলাটা ঠিক হলো না বোধহয়। তারপর বলল' ঠিক আছে, না 
দাঁড়াও ।তবে বেরোনোর আগেতোমাদের ব্যবস্থা নিয়ে আসা উচিত ছিল রেনকোট বা ছাতা।
তাছাড়া বৃষ্টিটা তো কাল রাত থেকেই হচ্ছিল সকালের দিকে একটু কমেছিল তারপর আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ছেলেগুলোকে বলার কোনো স্কোপই  দিল না।
আমি তো এদের চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখি তোমরা।
ছেলেগুলো বলল "এগুলো আপনার পোষা?'
এদের কেও এক অসহায় অবস্থায় 
পেয়েছিলাম ।পোষা নয়, তবে এদের আমি খাবার দিই,সেই করোনাকালীন পরিস্থিতি থেকে। তারপর এর বাচ্চাকাচ্চা হল। এরাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। এখন এরা এখানেই থাকে।'
ছেলেগুলো বলল "বাহ আপনার মত কজন করেন? দেখে খুব ভালো লাগলো।"
রেখা বলল 'ভগবান করাচ্ছেন তাই করছি।'
ছেলেগুলো ওদের গায়ে হাত বুলাতে লাগলো। মিলিরাও কেমন শান্ত হয়ে বসে রইল।
এরইমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে পার্থ যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। রেখা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ডাকলো পার্থ ,পার্থ।
পার্থকে আসতে দেখেই ছেলে দুটো তাড়াতাড়ি করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল।
পার্থ এসে বলল'কি হয়েছে বৌদি?'
'তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?'
আরে মায়ের হঠাৎ করে পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে আমি বললাম দেখো তোমার গ্যাস ফর্ম করেছে জল বেশি করে খাও আর বললাম অ্যান্টাসিড খেয়ে নিতে। এন্টাসিড নেই ফুরিয়ে গেছে সেটা আগে বলেও নি।
'ও তাই তুমি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দোকানে যাচ্ছ ।তাই তো ?সঞ্জীবনীতে।'
হ্যাঁ একদমই তাই?
'তুমি আজকে স্কুলে যাওনি বৃষ্টি বলে?'
হ্যাঁ খানিকটা তা বলতে পারো?
পার্থ বলল কেন অন্য কিছু কারণ আছে নাকি?
আরে তোমার দাদা যখন যায়নি তারপর আমার খাতাও রয়েছে দেখলাম খাতাগুলো দেখে ফেলতে হবে থেকে গেলাম।
মাসিমাকে ওষুধ কিনে দিয়ে এসো না বাড়িতে দাদার সাথে একটু গল্প করবে?
সে ঠিক আছে দেখছি আমি।
রেখা চাইছে মনোজ সবার সাথে এনগেজড থাকুক। একাকীত্ব না আসুক। একা থাকলেই হাজারো চিন্তা মাথায় ঘুরবে।
"তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?'
আর বোলো না হঠাৎ করে দেখছি মিলি আর বাচ্চারা এত চিৎকার করছে তোমার দাদাকে বললাম দেখো কেন চিৎকার করছে ওর তো কোনো হেলদোল নেই, তো ,আমি দরজা খুলে দেখি দুটো অচেনা ছেলে দাঁড়িয়ে।
পার্থ বলল "বাহ দারুন ব্যাপার তো?"
"কেমন দেখতে ছেলে দুটো?"
"ধুর ,আমি কি অত ভালো করে দেখেছি নাকি?
তবে শ্যাম বর্ণ, দো হারা।"
এইযা বৌদি যা বর্ণনা দিচ্ছ এই ছেলেদুটো তো মোটেই ভালো নয়।
রেখার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। অবাক হয়ে পার্থ মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
'ওরা গেল কখন?"
হ্যাঁ আমি হয়তো খেয়াল করিনি তবে তুমি ঢুকছো দেখে ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে। আমিও আর ডাকিনি ভাবলাম হয়তো তাড়া আছে এই জন্য বেরিয়ে যাচ্ছে।
আসলে আমাকে দেখে নিয়েছে ওই জন্য ওরা বেরিয়ে আছে ওদের মতলব মোটেই ভালো নয়। এখন পুলিশ ওদেরকে খোঁজ করছে। চুরি হয়েছে না এ ব্লকে।
'কিন্তু ওদের কথাবার্তাতে তো সেরকম মনে হল না।'
'নইলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল আমাকে দেখেই ওরা চলে গেল কেন?'
'সেটা অবশ্য ঠিক।'
"আমার না ভীষণ ভয় লাগছে জানো?,একেতো আমরা দুজনাই বেরিয়ে যাই।'
অত টেনশন নিও না তো আমরা আছি তো পাশাপাশি তাছাড়া তোমার ব্যাটেলিয়ান তুমি দেখে যাও অত সহজ ব্যাপার নয়।
চুরি ব্যাপারটা হয়েছে এখন সবাই সতর্ক আর আমি তো সারাদিন বাড়িতেই  থাকি ।যদি কাজ না পড়ে যায় ।মিলি তুলিদেরচিৎকারে আমরা নিশ্চয়ই চলে আসব।'
"ঠিক আছে, বৌদি, আসছি ।আমি পরে আসার চেষ্টা করছি।'
রেখার যেনো আরও একটা চাপ বেড়ে গেল। এযে ঘরে বাইরে সর্বত্র টেনশন আর টানাপোড়েন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much